খোদ মমতার বিরুদ্ধেই তোপ! তমলুকে হেরে হঠাৎ কেন ভোলবদল ‘তাজা নেতা’ দেবাংশুর?
Debangshu Bhattacharya Facebook Post: রবিবার ফেসবুকে সেই ক্ষোভ নিয়ে মুখ খোলেন দেবাংশু। দলনেত্রীর বক্তব্যকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করেই নিজের কাজ করার খতিয়ান দিলেন তমলুকের পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী।
লোকসভা ভোটে তৃণমূল তমলুকে আস্থা রেখেছিল দেবাংশু ভট্টাচার্যতে। প্রতিপক্ষ ছিল প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। যাকে লড়াইয়ের প্রতিটি ধাপে কার্যত কৃষ্ণের মতোই সাহায্য করে গিয়েছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। তমলুক শুভেন্দুর গড়। ফলে সেখানে দেবাংশুর লড়াই সহজ ছিল না। যে তেরোটি আসনে গো-হারা হেরেছে তৃণমূল, তার মধ্যে অন্যতম তমলুক। অভিজিতের কাছে প্রায় ৭৭ হাজার ৭৩৩টি ভোটের হেরেছেন তৃণমূল প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্য। এবার সেই তমলুকে হারের জন্যই দলনেত্রীর তোপের মুখে পড়তে হল দেবাংশুকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে বরাবরই সুনাম রয়েছে দেবাংশুর। তৃণমূলের জনপ্রিয় গান 'খেলা হবে'-র রচয়িতা দেবাংশুর তৃণমূলে উত্থানপর্ব তাক লাগানোর মতোই। তবে লোকসভা ভোটে তমলুকের মতো জরুরি কেন্দ্র দখল না করতে পারায় স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভ এসে পড়েছে দেবাংশুর উপরে। তবে দেবাংশুও ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয়। ফেসবুককে অস্ত্র করেই উত্থান দেবাংশুর। তাঁর যোগ্যতা বা পরিশ্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই সেই ফেসবুকেই উত্তর দিলেন দেবাংশু।
আরও পড়ুন: ফেসবুক থেকে টার্গেট সংসদ! দেবাংশু ভট্টাচার্যের উত্থানের গতি অবাক করবে…
এতদিন প্রায়শই মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে 'মা' সম্বোধন করতেও শোনা গিয়েছে দেবাংশুকে। এবার সেই দলনেত্রীর বিরুদ্ধেই গর্জে উঠলেন তাজা নেতা। সূত্রের খবর, সম্প্রতি দেরি করে প্রচারে বেরোনো নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষোভের মুখে পড়েন দেবাংশু। শনিবার দেবাংশুকে ভর্ৎসনা করে মমতা বলেন, ‘তোমাকে আরও পরিশ্রমী হতে হবে। তোমার মতো বয়সে যখন আমি ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম তখন সকাল ৭টায় প্রচারে বেরিয়ে যেতাম। আর শুনছি তুমি বেলা ১২টার আগে বাড়ি থেকেই বেরোওনি। এমনকী ভোটের দিন নন্দীগ্রামে যাওনি।’
তার পরেই রবিবার ফেসবুকে সেই ক্ষোভ নিয়ে মুখ খোলেন দেবাংশু। দলনেত্রীর বক্তব্যকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করেই নিজের ‘পাগলের মতো’ কাজ করার খতিয়ান দিলেন তমলুকের পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী। তিনি লিখেছেন, ‘‘সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে টয়লেট সেরে, স্নান করে, এক বাটি ছাতুর শরবত খেয়ে রোজ বেরিয়ে পড়তাম সকাল ৮–টার মধ্যে। প্রবল রৌদ্রে দুপুর ১ টা পর্যন্ত প্রচার চলত। তারপর ঠিকানায় ফিরে একটু গা ধুয়ে, দুপুরের খাওয়া সেরে পুনরায় ৩ টে নাগাদ রওনা দিতাম। চলত রাত্রি ৯-টা পর্যন্ত.. কখনও কখনও সেটা সাড়ে দশটাও বাজত। রাতে নিমতৌড়ির বাড়িতে ফিরে খাবার খেয়ে শুরু হত বিভিন্ন নেতা, কর্মীদের সাথে বাড়ির অফিসে অভ্যন্তরীণ মিটিং , কখনও কখনও সেসব মিটিং চলেছে রাত্রি ২-টো পর্যন্তও..। মিটিং শেষে ঘুমিয়ে আবার পরের দিন সকালে ৬ টায় ওঠা..। তমলুকের দলীয় কর্মীরা, যারা সেই বাড়িতে প্রায়শই আসতেন তারা সকলেই এই রুটিন জানেন।’’ অর্থাৎ দেবাংশুর কথায়, তিনি যথাবিধি পরিশ্রম করেছেন এবং যথাসময়ে প্রচারেও বেরিয়েছেন।
এখানেই শেষ নয়, নিজের পরিশ্রমের ‘প্রমাণ’ হিসাবে তিনি লিখেছেন, ‘‘মার্চে ওজন ছিল ৮৩ কিলো। যা আজ কমে ৭৭.. সৌজন্যে শেষ আড়াই মাস। এই ৬ কিলো ওজনের বিনিময়ে ৬ লক্ষ ৮৭ হাজার মানুষের ভালবাসা পেয়েছি, আশীর্বাদ পেয়েছি। সেটাই আমার কাছে এই নির্বাচনের নির্যাস...।’’ দেবাংশু জানান, পরিশ্রমে নিজের ১০১% দিয়েছি। যা করতে পারি তার বেশি করেছি। আমার টিম, আই প্যাকের কয়েকজন এবং পর্যবেক্ষক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় উন্মাদের মত পরিশ্রম করেছে। সাথে প্রাণপাত করে দিয়েছেন বুথ স্তরের দলীয় কর্মীরা..'
নিজের হারের পিছনে মূলত দুটি কারণের দিকেই আঙুল তুলেছেন দেবাংশু। তার একটি হল ‘টাকার কাছে হার’! দেবাংশু লিখেছেন, ‘‘নিজেদের সবটা দেওয়ার পরেও অর্থের কাছে হেরে গিয়েছি। এত কোটি কোটি টাকার বিরুদ্ধে আমাদের স্বল্প ক্ষমতার লড়াই ব্যর্থ হয়েছে। গোটা জেলায় নেতা-কর্মী নয়, ভোট করিয়েছে কেবল টাকা।’’ তিনি জানান, ‘‘নিজেদের সবটা দেওয়ার পরেও বেইমানি আর অর্থের কাছে হেরে গিয়েছি। এত কোটি কোটি টাকার বিরুদ্ধে আমাদের স্বল্প ক্ষমতার লড়াই ব্যর্থ হয়েছে।’’ তিনি আঙুল তুলেছেন নন্দীগ্রাম বা ময়নার মতো জায়গায় তৃণমূলের সাংগঠনিক দুর্বলতার দিকেও। লিখেছেন,‘‘নন্দীগ্রাম-ময়নার বাকচা অঞ্চলে তৃণমূল নাম উচ্চারিত হলে মারধর, এমনকি প্রাণহানিও সেখানে নতুন নয়। দলের ঝান্ডা বাঁধার লোক অবধি সেখানে নেই। সেই পরিস্থিতে সবটা এতটা একপেশে হয়ে গিয়েছিল, এক সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল এই নির্বাচন এখন লড়া, না লড়া সমান ব্যাপার। তবুও আমরা হাল ছাড়িনি! দেবাংশু কথায়, পরিস্থিতির সুযোগে আমার বিপরীতের প্রার্থী আধা বেলা প্রচার না করেও জিতে গিয়েছেন.. আর আমি পাগলের মত বুথ বুথ ঘুরেও জিততে পারিনি।’’
তমলুকের মতো জরুরি কেন্দ্রে যে দেবাংশুর উপরে আস্থা রেখেছিল তৃণমূল নেতৃত্ব, সেই দেবাংশুর গলায় এ হেন সুর শুনে স্বাভাবিক ভাবেই হতবাক তৃণমূলের নেতামন্ত্রীরা।রবিবার তাঁর এই ফেসবুক পোস্টের পরেই জোর বিতর্ক শুরু হয়ে যায় বিষয়টি ঘিরে। তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনু সেন এই পোস্ট দেখার পর নিজের বিরক্তি গোপন রাখেননি। তাঁর মতে, নিজের ভাল চাইলে তরুণ দেবাংশু নেত্রীর কথা অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন। তৃণমূল নেত্রীর কাছে বকাঝকা খেয়েছেন, এমন নেতানেত্রী কম নেই তৃণমূলে। একসময় তৃণণূল নেত্রী মহুয়া মৈত্রও যথেষ্ট বকা খেয়েছেন মহুয়া। আবার বিপদের দিনে মহুয়ার পাশেই দেখা গিয়েছে মমতাকে। দলের বেশিরভাগ সদস্যই বিশ্বাস করেন, মমতা যা বলেন, তা আসলে ভালোর জন্যই বলেন। শুধু রাজনীতিতেই নয়, দলের অন্দরেও বড় দিদি, অভিভাবকের মতোই থাকেন মমতা। তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনু এ সম্পর্কে জানান, ‘‘দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই শেষ কথা, তাঁর বলা কথাকে কনট্রাডিক্ট না করে শিরোধার্য করা উচিত। তিনি যা বলেন, আমাদের ভালোর জন্য, দলের ভালোর জন্য।’’
আরও পড়ুন: তমলুকে দেবাংশুকে জেতানোর প্রশ্নে তৃণমূলই হাত তুলে নিচ্ছে?
আসলে দলীয় শৃঙ্খলা অনুযায়ী, দলের ভিতরের কথাবার্তা দলের অন্দরেই থাকার কথা। সে নিয়ে বাইরে কথা বলা শোভন তো নয়ই, তা দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী। তবে কি দলের কনডাক্ট ভেঙে নিজের বিপদই ডেকে আনলেন দেবাংশুকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অভিষেক, বারবার দেবাংশুকে ভাতৃসম বলে আখ্য়া দিয়েছেন। সেই দেবাংশুই ভোটে হারতেই পাল্টি খেলেন ১৮০ ডিগ্রি। এমনকী দলনেত্রীর ভর্ৎসনা ঘিরে যে ভাবে জট পাকিয়েছেন দেবাংশু, তাতে দলীয় অন্তর্কলহের দিকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ফের। দু'দিন আগেই শুভেন্দুর সুরে সুর মিলিয়ে দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধেই তোপ দাগতে দেখা গিয়েছিল দেবাংশুকে। তিনি দাবি করেছিলেন, দু'নৌকায় পা দিয়ে চলে দলের বিভিন্ন পদ সামলানো যায় না। ভোটে লড়তে গিয়ে তাঁকে এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। সেই নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়। সেই বিতর্কের রেশ ফুরোতে না ফুরোতেই নয়া বিতর্কে জড়ালেন দেবাংশু। দলনেত্রীর বকাঝকার উত্তরে যে উগ্রতা তিনি দেখিয়েছেন, তাতে তার রাজনৈতিক কেরিয়ার চাপের মুখে পড়বে না তো? নানা মহল থেকে আপাতত উঠছে সেই প্রশ্নই।