সাতে সাত! যতবার ডার্বি ততবারই হারের ভবিতব্য কেন ইস্টবেঙ্গলের?

Kolkata Derby Result: বর্তমান ইস্টবেঙ্গল দলে খেলোয়াড়দের আবেগ এবং গোল খেলে কামব্যাক করার মানসিকতা কতটা আছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের তিন বছর দশ মাসের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত হল। ফের একবার ডার্বির রং সবুজ মেরুন। জনি কাউকো, হুগো বুমো, মনবীররা ফের মুখে হাসি ফোটালেন বাগান সমর্থকদের। বছর আসে বছর যায় ইস্টবেঙ্গলের ভাগ্যের শিকে আর ছেঁড়ে না। সিজনের শুরুতে স্টিফেন কনস্টেনটাইন আত্মবিশ্বাসী থাকলেও অচিরেই চিড় ধরেছে তাতে। অপরদিকে, দুরন্ত ফুটবলের নিদর্শন রাখল মোহনবাগান। আগুনে ফর্মে ছিলেন হুগো বুমো। তার সঙ্গে নজর কাড়লেন তরুণ ডিফেন্ডর আশীষ রাই। প্রথমার্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করলেও সেকেন্ড হাফে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণের দুর্বলতা ফের সামনে চলে এল। এদিন গোল এল হুগো বুমোস এবং মনবীরের পা থেকে। কাকে ছেড়ে কাকে আটকাবেন ইস্টবেঙ্গল ফুটবলাররা? বুমোসকে আটকালে আক্রমণে উঠছেন কাউকো। কাউকোকে আটকালে এগিয়ে আসছেন লিস্টন কোলাসো। লিস্টনকে বাধা দিলেন গোল করে যাচ্ছেন মনবীর।

ডুরান্ড কাপে মোহনবাগানের আক্রমণ বনাম ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্সের খেলা দেখেছিল সকলে। শেষ পর্যন্ত সুমিত পাসির আত্মঘাতী গোল না হলে হয়তো পয়েন্ট নিয়েই ফিরত ইস্টবেঙ্গল। সেই ম্যাচে সুমিত পাসি ছিলেন, এই ম্যাচে কমলজিৎ সিং। ৫৬ মিনিটের মাথায় দূর থেকে গোল লক্ষ্য করে নীচু শট নিয়েছিলেন বুমো। কমলজিৎ ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা বাঁচালেও বল হাতে লেগে গোলে ঢুকে যায়। এই ভুল এত বড় মঞ্চে! মানতে পারছেন না সমর্থকরা। মিনিট দশেকের মধ্যেই দ্বিতীয় গোলটি পেয়ে যায় তারা। এবারে ইস্টবেঙ্গলের ছন্নছাড়া রক্ষণের সুযোগ নিয়ে লাল-হলুদের জালে বল জড়িয়ে দেন মনবীর সিং। স্কোর শিটে নাম না তুলতে পারলেও খেলাকে একপ্রকার চালনা করলেন জনি কাউকো এবং লিস্টন কোলাসো। ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্ডারদের নড়তে পর্যন্ত দেননি তাঁরা

ডার্বির রঙ সবুজ মেরুন

আরও পড়ুন-রাত পোহালেই ডার্বি! চুনী থেকে ভাইচুং- একনজরে কলকাতার ডার্বি নায়করা

তবে প্রথমার্ধে দু’টি পেনাল্টি নাকচ করে দেওয়ায় রেফারির দিকে আঙুল তুলছেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা। একবার ক্লিইটন, আরেকবার জর্ডান- এই দু’জনকে বক্সে ফাউল করা হলেও পেনাল্টি দেননি রেফারি সিআর শ্রীকৃষ্ণ। ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্সের অন্যতম স্তম্ভ ইভান গঞ্জালেস ফার্স্ট হাফে ভালো খেললেও অত্যন্ত নিষ্প্রভ। ১৬ মিনিটের মাথায় অসাধারণ সুযোগ পেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। নাওরেমের ক্রস থেকে হাওকিপের শট দুর্দান্ত ভঙ্গিতে বাঁচিয়ে দেন মোহনবাগানের গোলকিপার বিশাল কায়েথ। এইটেই ছিল ইস্টবেঙ্গলের সবচেয়ে ভালো সুযোগ। তবে কমলজিৎ যেভাবে প্রথম গোলটি খেয়েছে তা মেনে নিতে পারছেন না প্রাক্তন খেলোয়াড়রাও। এই প্রসঙ্গে সন্দীপ নন্দী বলেছেন, “টেকনিক্যালি খুব দক্ষ না হলে এই ধরনের বলের মোকাবিলা করা কঠিন। গোলকিপারের সামনে ড্রপ পড়া বল সবসময়েই বিপজ্জনক। বুমোর শটে জোর ছিল, গোলকিপারের সামনে ড্রপ পড়ল। কমলজিতের শরীর বলের লাইনে ছিল না। বলের লাইনে যদি কমলজিৎ শরীর নিয়ে যেতে পারত, তাহলেও বলটাও জালে জড়াত না। আমার দেখে মনে হল, বলটা যখনই ওর সামনে ড্রপ পড়েছে, তখন ওর মাথা আর কাজ করেনি।”

ইস্টবেঙ্গল কিন্তু ভালোই শুরু করেছিল। রক্ষণে লোক বাড়িয়ে মোহনবাগানের আক্রমণ প্রতিহত করে কাউন্টার অ্যাটাক করে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার ছক কষেছিলেন ইস্টবেঙ্গল কোচ স্টিফেন কনস্ট্যান্টাইন। সেই স্ট্র্যাটেজিতে প্রথমার্ধে তিনি সফল হন। ম্যাচের প্রথমার্ধে খেলা ছিল সমানে সমানে। মোহনবাগান বলের দখল বেশি রাখলেও সেভাবে আক্রমণ দানা বাঁধছিল না। উল্টে কাউন্টার অ্যাটাকে বেশ কয়েকটি ভাল সুযোগ তৈরি করে ফেলেছিল ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু হুগো বুমো গোল করে দেওয়ার পরেই কার্যত ছন্নছাড়া হয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। ময়দানের প্রাচীন প্রবাদ “পিছিয়ে পড়া ইস্টবেঙ্গল, খোঁচা খাওয়া বাঘের থেকেও বিপদজনক।” কালকের পারফর্ম্যান্স এই প্রবাদকে ফের ভুল প্রমাণ করল। এক গোল খেয়ে কামব্যাক করা কি যায় না? ইস্টবেঙ্গলই তো কতবার করেছে এর আগে। আসলে সবটা নির্ভর করে খেলোয়াড়দের মানসিকতার উপর। কালকে গোল খাওয়ার পর কার্যত সারেন্ডার করে দিয়েছিল লাল হলুদ বাহিনী। প্রথমার্ধের যে কাউন্টার অ্যাটাকগুলি উঠে আসছিল দ্বিতীয়ার্ধে তার রেশমাত্র দেখা গেল না। অন্যদিকে দ্বিতীয়ার্ধে আরও চেপে ধরলেন হুগো বুমো, মানবীর, জনি কাউকোরা। শেষ পর্যন্ত ২-০ গোলে ফের একবার ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে দিল মোহনবাগান। একদিকে যখন ডার্বি জিতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে মাঠ ছাড়ছেন মোহনবাগান সমর্থকরা, তখনই মাঠের অন্যপ্রান্তে চোখে জল এবং ভারাক্রান্ত মনে রাস্তার দিকে এগোচ্ছেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা।

তবে মোহনবাগান সমর্থকরা যতই ‘রিমুভ এটিকে’ করুক না কেন, লক্ষ্য করে দেখবেন এই ‘এটিকে’ নাম যোগ হওয়ার পর থেকে কোনও ডার্বি হারেনি মোহনবাগান। ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি আই লিগে ইস্টবেঙ্গলকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল মোহনবাগান। এরপর থেকে মোহনবাগানের নামের সঙ্গে জুড়ে যায় ‘এটিকে’। আইএসএল-এর প্রথম ডার্বিতে, ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর আইএসএলে এসসি ইস্টবেঙ্গলকে ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল এটিকে মোহনবাগান। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আইএসএলের ডার্বিতে এসসি ইস্টবেঙ্গলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল রয় কৃষ্ণ, ডেভিড উইলিয়ামস এবং জাভি হার্নান্দেজ গোল করেছিলেন। গত বছর ২৭ নভেম্বর এসসি ইস্টবেঙ্গলকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল এটিকে মোহনবাগান।

ডার্বি অভিষেকেই হ্যাটট্রিক কিয়ান নাসিরি

২০২২ সালের ২৯ জানুয়ারি, কিয়ান নাসিরির হ্যাটট্রিকের সৌজন্যে ৩-১ গোলে জিতেছিল এটিকে মোহনবাগান। এসসি ইস্টবেঙ্গল প্রথম গোল করলেও কিয়ান নাসিরি হ্যাটট্রিক করে সবুজ-মেরুনকে জিতিয়েছিলেন এবং গতকাল ফের একবার হুগো বুমো এবং মনবীরের গোলের সুবাদে ২-০ গোলে ডার্বি জিতে নেয় মোহনবাগান। এই ভাবেই টানা সাতবার ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে কার্যত ‘সপ্তম স্বর্গে’ মোহনবাগান।

এরপরেই প্রশ্ন ওঠে কী এমন হল যে টানা সাতবার ডার্বি হারছে ইস্টবেঙ্গল। প্রথমত, প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। ২০২০ সালে আইএসএলে ইস্টবেঙ্গল কীভাবে খেলেছিল তা সকলের মনে আছে আশা করি। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নিজেদের ইনভেস্টর সমস্যা মেটায় ইস্টবেঙ্গল। এরপর আইএসএল শুরুর মাস দেড়েক আগে জানা যায় ইস্টবেঙ্গল আইএসএল খেলছে। সেই দেড় মাসে কোনওভাবে একটি টিম তৈরি করে আইএসএল খেলতে নামে তারা। তারপরে তথৈবচ ভাবে হারতে হয় সবার কাছে। দেড় মাসে টিম তৈরি করলে প্রস্তুতির সময় পাবে কখন! পরের বছর আবার সেই ইনভেস্টর সমস্যা, আবার দল তৈরি করতে দেরি, আবার আইএসএলে গিয়ে ভরাডুবি।

দ্বিতীয়ত, ঘন ঘন দল পরিবর্তন। এবার তুলনামূলকভাবে আগে ইনভেস্টর এবং দল পেয়ে গেলেও সেই দলের গুণগত মান নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেই যায়। লক্ষ্য করে দেখবেন, ২০২০ সাল থেকে মোহনবাগানের দলে একটু একটু করে পরিবর্তন হয়েছে। কখনও এডু গার্সিয়া এবং জাভি হার্নান্ডেজ ছেড়ে দিয়েছেন বলে দলে এসেছেন জনি কাউকো, হুগো বুমো। তিরি ছেড়ে দিয়েছেন বলে সেই জায়গায় এসেছেন ব্র্যান্ডন হ্যামিল। আক্রমণ ভাগে রয় কৃষ্ণ এবং ডেভিড উইলিয়ামসের জায়গা নিয়ে নিয়েছেন পেত্রাতস-মনবীর জুটি। অর্থাৎ পরিবর্তনগুলি সময় নিয়ে ধীরে ধীরে হয়েছে ফলত দলে সেরকম প্রভাব পড়েনি। অপরদিকে, ইস্টবেঙ্গল তিনটে সিজনে তিনটে সম্পূর্ণ নতুন স্কোয়াড খেলিয়ে দিয়েছে। কোচ ইনভেস্টর সব বদলে গেছে। দলটার নিজেদের মধ্যে বন্ডিং তৈরি হয়নি।

তৃতীয়ত, খারাপ বিদেশি চয়ন। আগেই বলে রাখি, বিগত দু’টি সিজনের তুলনায় এই সিজনের বিদেশি চয়ন তুলনামূলক ভালো হয়েছে। অন্তত ভারতের মাঠে অভ্যস্ত কয়েকজন বিদেশিকে ইস্টবেঙ্গল স্কোয়াডে রেখেছে। কিন্তু বিগত দু’টি বছরে ইস্টবেঙ্গল যেই ধরনের বিদেশি এনেছে তা অত্যন্ত খারাপ মানের। চার-পাঁচ বছর আগে ইস্টবেঙ্গলে যেই মানের বিদেশি ছিল সেই মানের বিদেশি যদি বিগত দু'বছরে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলত তাহলে ফলাফল নিঃসন্দেহে আলাদা হত। র‍্যান্টি মার্টিন্স, আল আমনা, জেমি কোলাডো বা বোরজা গোমেজের মতো বিদেশি ইস্টবেঙ্গলের ধরে রাখা উচিত ছিল। এছাড়াও জবি জাস্টিন, ব্র্যান্ডন, চুলোভা, লালড্যানমাওয়ার মতো ভারতীয় খেলোয়াড় ছেড়ে দেওয়াও ম্যানেজমেন্টের অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত।

আরও পড়ুন- পুরুষদের সমান বেতন! ভারতে মহিলাদের ক্রিকেট কতটা অক্সিজেন পাবে

এই আবেগটাই এখন আর দেখা যায় না

চতুর্থ কারণটি হল, বর্তমান ইস্টবেঙ্গল দলে খেলোয়াড়দের আবেগ এবং গোল খেলে কামব্যাক করার মানসিকতা কতটা আছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ৪-৫ বছর আগে যখন অর্ণব মন্ডল মেহতাব হোসেন, লালরিন্ডিকারা ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলতেন তখন তাঁদের মধ্যে একটা আবেগ কাজ করত দলকে জেতানোর। ডার্বিতে তার প্রতিফলন দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে এত ঘন ঘন খেলোয়াড় বদল হচ্ছে যে, তারা এই ক্লাবটিকে শুধুমাত্র একটি ক্লাব ভেবে খেলছেন। ফলত ক্লাবের থেকে আবেগ সরে যাচ্ছে, সেই জন্যে ম্যাচ জেতার সেই বাড়তি তাগিদটা এখন আর চোখে পড়ে না। অন্তত বিগত ডার্বিগুলিতে তো চোখে পড়েনি।

এরপর ডার্বি হারের কারণ নিয়ে কোচ হয়তো খেলোয়াড়দের সঙ্গে বসবেন, অনেক বিশ্লেষণ হবে, ভিডিও অ্যানালিসিস হবে, ইস্টবেঙ্গল হয়তো এরপর কয়েকটি ম্যাচ জিতবেও- তবু সমর্থকদের মনে প্রশ্ন থেকেই যাবে, আবার কবে ডার্বি জিতবে লাল হলুদ!

More Articles