খোদ ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ হয়েছিল ক্রিসমাস! কেন জানেন?
Christmas Banned: ইংল্যান্ডে ঘোষণা করে দেওয়া হল ক্রিসমাস, ইস্টারের মতো এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলো আর পালন করা যাবে না। তারপর...?
কলকাতায় আজ যে ক্রিসমাস পালনের রমরমা, তা মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশেরই প্রভাব। তবে সেই ইংল্যান্ডেই নাকি একবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ক্রিসমাস পালনকেই। রীতিমতো আইন এনে বন্ধ করা হয় বড়দিন পালনের সমস্ত উদযাপন। তারপর?
এই গোটা ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়ক। দক্ষ সেনাপ্রধানের পাশাপাশি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও যথেষ্ট কুশলী ছিলেন তিনি। তবে একই সঙ্গে ব্রিটিশ জেনারেল তথা রাষ্ট্রনায়ক অলিভার ক্রমওয়েল ছিলেন প্রবল ভাবে পিউরিটান ধর্মবিশ্বাসে আস্থাবান। ১৬৪৯ সালে রাজা চার্লসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের প্রোটেক্টরেট হিসেবে সিংহাসনে বসেন অলিভার ক্রমওয়েল। ইংল্যান্ডে সেনাশাসন অবশ্য ১৬৩৯-র সময় থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। সে সময় দুর্দান্ত সমরকুশলতা দেখিয়ে শিরোনামে আসেন অলিভার ক্রমওয়েল। পিউরিটান বিশ্বাসে আস্থাবান ক্রমওয়েল দেশ চালানোর পাশাপাশি আরও একটি মহৎ দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। সেটি ছিল দেশকে অবক্ষয় মুক্ত করা। আর সেই পথেই এগিয়েছিল সেনাশাসিত দেশ।
ক্রিসমাসের নামে এমন সব উৎসব-পার্বন দেশের সংস্কৃতির জন্য মোটেও ভালো কথা নয়। এমনই একটা ভাবনা থেকে ১৬৪৪ সাল নাগাদ ক্রিসমাস উদযাপন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে জারি করা হয় অধ্যাদেশ। পার্লামেন্টে পাসও হয়ে যায় সেটি। দেশ তখন গৃহযুদ্ধে ছারখার। সে সময় হঠাৎ করেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল ক্রিসমাস পালন। পিউরিটানদের কাছে আদতে এ ছিল মস্ত একটা অপব্যয়ের উৎসব। স্বাভাবিক ভাবেই খ্রিস্টানদের একটি বড় অংশ ব্যাপারটিকে ভালো ভাবে নেয়নি। তবে সে সব ব্যপারে মাথা না ঘামিয়েই বড়দিনের সঙ্গে জড়িত সমস্ত উদযাপন, ক্রিয়াকলাপ, এমনকী গণসমাবেশ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হল। যথারীতি এই স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত মোটেও খুশি মনে মেনে নেয়নি দেশের জনগণ। প্রকাশ্যে ক্রিসমাস নিষিদ্ধ হলেও গোপনে বড়দিন পালন কিন্তু চলতেই থাকল।
আরও পড়ুন: মাছ-সবজির নিলামে শুরু ক্রিসমাস! কেষ্টপুরের বড়দিন এক অজানা অধ্যায়
১৯৪৫ সালে পার্লামেন্ট 'ডিরেক্টরি অফ পাবলিক ওয়ার্শিপ' নামে প্রার্থনার বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রবর্তন করা হল। যেখানে ঘোষণা করে দেওয়া হল ক্রিসমাস, ইস্টারের মতো এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলো আর পালন করা যাবে না দেশে। ১৯৪৭ সালে আরও জোরালো নিষেধাজ্ঞা এনে জারি করা হল আরও একটি অধ্যাদেশ। যেখানে আইন অমান্যে জরিমানার কথাও ঘোষণা করে দেওয়া হল না। এতদিন পর্যন্ত বড়দিন উপলক্ষে দেশ জুড়ে ছুটি থাকত। সেই ছুটি পাল্টে মাসে একটি করে ধর্মনিরপেক্ষ সরকারি ছুটি ঘোষণা করল শাসকমহল। ক্রিসমাস নিষিদ্ধ করা নিয়ে ক্ষোভ ক্রমশ ফুটতে শুরু করে রাজ্য জুড়ে। ৪৭ সাল নাগাদ কেন্ট-সহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় দাঙ্গাও বাঁধে এই নিয়ে। নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নানা জায়গায় সংগঠিত হতে থাকে নানাবিধ সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। 'দ্য ওয়ার্ল্ড টার্নড আপসাইড ডাউন' নামের গীতিনাট্যটি ছিল তেমনই একটি প্রতিবাদ।
তবে তাতেও বদলায়নি কিছুই। ১৬৫২ সাল নাগাদ ক্রিসমাস নিষেধাজ্ঞাকে আরও শক্তিশালী করতে পার্লামেন্টে পাস হল আইন। জানিয়ে দেওয়া হল, কোনও দোকানপাট বন্ধ রাখা যাবে না ক্রিসমাসের দিন। কোনও ভাবে যাতে উৎসবের আঁচটুকু এসে না ঠেকে বাসিন্দাদের প্রাণে। ১৯৫৫ সালে সেই নিষেধাজ্ঞা আইন হল আরও কড়া। কিন্তু ১৯৫৬ সাল থেকে পার্লামেন্টে জমা পড়তে লাগল অভিযোগ। ক্রিসমাস রদ আইন ভঙ্গ করার একাধিক অভিযোগ। লন্ডনেও বন্ধ ছিল একাধিক দোকানপত্তর। বড়দিনের উৎসব পালন থেকেও দূরে ছিল না বাসিন্দারা। এমনকী পার্লামেন্টের সদস্যদের বাড়ির পাশেই বেশি করে আয়োজন করা হয়েছিল উৎসব অনুষ্ঠানের। অর্থাৎ ক্রিসমাসের অনুষ্ঠানের উপর জারি করা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিস্বর ক্রমশ জোরালো হচ্ছিল দেশ জুড়ে। ১৯৫৭ সাল নাগাদ লন্ডন কর্তৃপক্ষকে কাউন্সিল অব স্টেট বারবার মনে করিয়ে দেয় আইনের কথা, আইন কার্যকর করার কথা। কিন্তু তা রাজধানীর বাইরে আদৌ ততটা জোরালো ভাবে কার্যকর করা গিয়েছিল কি! সে বিষয়ে পার্লামেন্টের ভিতরেও যথেষ্ট অস্পষ্টতা ছিল।
তবে সত্যি কথা বলতে এই আইন প্রণয়নের ব্যপারে অলিভার ক্রমওয়েলের ভূমিকা ছিল সামান্যই। হ্যাঁ, আইনে সই করেছিলেন তিনি, ওইটুকুই। আসলে দেশ জুড়ে জেগে ওঠা গৃহযুদ্ধ সামাল দিতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। এমনকী ১৯৪৭ সালে যখন ওই নিষেধাজ্ঞাটি পাস হয়, সে সময়ে পার্লামেন্টেও উপস্থিত ছিলেন না তিনি। কিন্তু রাজ্যের শাসক হিসেবে এর বদনাম গিয়ে পড়েছিল ক্রমওয়েলের উপরেই।
শেষপর্যন্ত ১৬৬০ সালে তুলে নেওয়া হয় সেই ক্রিসমাস নিষেধাজ্ঞা। দ্বিতীয় চার্লস ওই বছরই সেনার হাত থেকে দেশের গদি ফের নিজের দখলে নেয়। শেষ হয় সেনাশাসন। তার সঙ্গেই ওঠে ক্রিসমাস ব্যানও। কিন্তু এই সাড়ে তিনশো বছরে ক্রিসমাস নিষেধাজ্ঞা আর তার সঙ্গে ক্রমওয়েলের নাম যেন ক্রমশ কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে। আরও একটি গল্প কীভাবে যেন রটে গিয়েছে যে বড়দিনের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল মিন্স পাই নাম সুস্বাদু খাবারটি। তবে সেই গল্প বোধহয় পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ শুধুমাত্র বড়দিনেই নয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানেই বেশ জনপ্রিয় খাবার ছিল ওই পদটি।
আরও পড়ুন: যিশু নেই, সান্তা নেই! ক্রিসমাসে বেথলেহেমের এই চেহারা আগে দেখেনি বিশ্ব
ওই বছর থেকেই ফের পুরোদমে দেশ জুড়ে শুরু হয় ক্রিসমাস পালন। পুরো বারো দিন ধরে উৎসব উদযাপনের ছাড়পত্র পেয়েছিল সেবার ইংল্যান্ড। পুরনো সমস্ত ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনা হয় দেশ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ মেতেছিলেন উৎসবের আমেজে। যে উৎসবের রেশ ফুরোয়নি সাড়ে তিনশো বছর পরেও। আজও ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিনই। যার পরশ এসে একদিন পড়েছিল এ দেশেও।