যে বই প্রকাশনার অলঙ্কার, বাজারে তারই কাটতি বেশি
Boibhashik Publication: কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা এত অল্প সময়ের পরিসরে যে পরিমাণ ব্যাবসা দেয়, তার তুলনা অন্য কোনোকিছুর সঙ্গেই চলে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায় সরাসরি বইমেলায়।
বইমেলা আসন্নপ্রায়। সারা বছর ধরে বহু যত্নে একটু একটু করে এক একটি বইয়ের ভাবনা বাস্তবায়িত করেন প্রকাশকেরা। ছোট ছোট স্বপ্ন। এক পা দুই পা ফেলে এগিয়ে যাওয়া। দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে এল বৈভাষিক। বইমেলার প্রস্তুতিপর্বের অভিজ্ঞতা তাঁদের কাছে ঠিক কেমন? ইনস্ক্রিপ্টের 'রবিবারের রোয়াকে' বৈভাষিকের কর্ণধার মাধবী মজুমদারের সঙ্গে আলাপচারিতায় সিন্ধু সোম।
প্রকাশক হিসেবে এটা আপনার কততম বইমেলা? এবং আগের থেকে কতটা বদলেছে সেই অর্থে বইমেলার পরিবেশ? করোনাকালের আগে এবং পরে কি কোনও বিশেষ পরিবর্তন এসেছে? কীভাবে তার সঙ্গে বোঝাপড়া করছেন?
বৈভাষিকের এবারে ষষ্ঠ বইমেলা। এবারে বৈভাষিকের আস্তানা স্টল নাম্বার ৪৩০। ৭ নম্বর গেটের সামনেই আমাদের স্টল। শারদোৎসবের পরেই বাঙালির দ্বিতীয় বৃহত্তম ইভেন্ট এই বইমেলা। এরকম একটি ইভেন্টে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া শুধুমাত্র গৌরবের নয়, অদ্ভুত এক শিহরণও জাগায় মনে।
মাঝখানে ২০২১ সালে বইমেলা হয়নি করোনা অতিমারির প্রকোপের কারণে। তারপর থেকে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে। এর একটা পজিটিভ ইমপ্যাক্ট তো আছেই সামগ্রিক ব্যাবসার উপরে। যত অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়বে, তত পাঠকের সংখ্যাও বাড়বে। বইমেলায় আসবে আরও বেশি পরিমাণে পাঠকরা।
প্রস্তুতি নেন কীভাবে বইমেলার?
বইমেলার জন্যে কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নেওয়া হয়। প্রাথমিক একটি তালিকা তৈরি করা হয় কোন কোন বই বইমেলায় প্রকাশিত হবে তার। সেই তালিকা বদলাতেও থাকে অহরহ। নতুন নতুন বই যোগ হয়, অল্প হলেও কিছু বই বাদও যায়।
বইমেলার আগে বা পরের আঞ্চলিক মেলাগুলিতে কি যাওয়া সম্ভব হয়? কীভাবে দেখেন সেই অংশগ্রহণ? বইয়ের বিক্রিই বা কেমন অঞ্চলিক বইমেলায় এখন?
বৈভাষিক এখনও ছোটো প্রকাশনা। আমাদের লোকবল কম। তাই আঞ্চলিক মেলায় সরাসরি অংশগ্রহণ সে'ভাবে সম্ভব হয় না আমাদের পক্ষে। তবে, অন্যান্য প্রকাশনার মারফত আমাদের বই অনেক মেলাতেই পৌঁছে যায়। যেহেতু সরাসরি মেলায় অংশগ্রহণ করে উঠতে পারি না, তাই বিক্রির হিসেব-নিকেশ সে'ভাবে দেওয়া আমাদের পক্ষে মুশকিল।
বই নিয়ে কোনও বিশেষ ভাবনা? মানে নতুন কী কী বই আসছে এ'বছর? তার মধ্যে আশা রয়েছে কোন বইগুলির উপর?
আমরা সাধারণত বইমেলা থেকে বইমেলা এই সময়কালটাকে ‘কেতাবি বছর’ হিসেবে ধরি! তো, এই কেতাবি বছরে বৈভাষিক থেকে ২০টার কাছাকাছি নতুন টাইটেল আসছে। সবকটা বই নিয়েই আমরা ভীষণভাবে আশাবাদী। আমাদের মনে হয়েছে প্রত্যেকটিই ভালো কাজ, তাই প্রকাশ করছি। তবে এ'বারে দু'টি বিষয়ের উপরে আমরা একটু বেশি জোর দিয়েছি— এক, উপন্যাস বিভাগ। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের ‘এখানে ডেরেক বসে আছে’ ইতিমধ্যেই তুমুল পাঠকপ্রিয়, কৌশিক চক্রবর্তীর ডার্ক সাইকোলজিক্যাল উপন্যাস ‘হত্যার নির্জন মনোলগ’ আসছে। অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘অগ্রন্থিত অমলেন্দু’ বইতে তিনটি উপন্যাস থাকছে। এ'ছাড়াও অর্ক দেব অনূদিত প্যালেস্তাইনের আহেদ তামিমি-র উপন্যাস ‘ওরা আমায় সিংহ বলত’ আসছে।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, পুরোনো কিছু বই নতুন রূপে আসছে। সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকটি নতুন অলংকরণ সহযোগে আসছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চাঁইবুড়োর পুঁথি’-ও নবেন্দু সেনগুপ্তর অলংকরণ সহযোগে আসছে। এ'ছাড়া, ভুবনমোহন রায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘সুন্দরবনের সাত বৎসর’ বইটির প্রথম মুদ্রণের ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ আসছে। এই মুদ্রণে হিতেন্দ্রমোহন বসুর পঁয়ত্রিশটি অলংকরণ ও প্রচ্ছদ ছিল। সবটাই থাকছে এই নতুন সংস্করণে।
বিশ্বদীপ দে-র গদ্য সংকলন ‘হলুদ ট্যাক্সি’ বৈভাষিক থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯ সালে এবং তা পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে অচিরেই। বিশ্বদীপের দ্বিতীয় গদ্য সংকলন ‘লাস্ট ট্রাম’ এ'বারে প্রকাশিত হচ্ছে।
একটি আকর গ্রন্থ এ'বারে প্রকাশিত হচ্ছে বৈভাষিক থেকে। ‘অর্ধেকের খোঁজে: ভারতীয় নারীর হাজার বছরের নির্বাচিত কবিতা’। অনুবাদ করেছেন অমৃতা সরকার। এ'রকম বৃহৎ পরিসর ধরে কবিতায় নারীভাষ্য নিয়ে কাজ বাংলা ভাষায় এর আগে হয়েছে বলে আমার ব্যক্তিগতভাবে জানা নেই।
অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ সংকলন ‘জাক লাকাঁ: তত্ত্বে ও প্রয়োগে মনোবিশ্লেষণ’ গতবছর প্রকাশিত হয় বৈভাষিক থেকে। এই বইটি অ্যাকাডেমিক পরিসরে বিপুল পাঠকপ্রিয় হয়। এইবছর অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের আধুনিক তত্ত্ববিশ্ব এবং বিশ্বসাহিত্যপাঠ নিয়ে প্রবন্ধ সংকলন আসছে ‘আধুনিক তত্ত্ববিশ্ব এবং বিশ্বসাহিত্যের গ্রন্থিপাঠ’।
আপনাদের থিম কী? অভিমুখটা কী? আপনারা কী ধরনের বইয়ে জোর দেন?
যে-কোনো প্রকাশকেরই সম্ভবত এক ও একমাত্র থিম হচ্ছে ভালো বই। যে বই তার মতানুসারে ভালো, সেই বই-ই সে ছাপে। বৈভাষিক সবরকম বই-ই প্রকাশ করে। সে'খানে সিরিয়াস অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধও থাকতে পারে, আবার তথাকথিত ‘পাল্প’-ও থাকতে পারে। কিন্তু বৈভাষিকের টার্গেট হচ্ছে ওয়ান টাইম রিড বই প্রকাশ না করা। যদি পাল্প ফিকশনও ছাপে বৈভাষিক, তা যেন ফিরে ফিরে পড়তে হয় পাঠকদের সেই লেখার গুণগত মানের জন্যে, যেন মনে দাগ কেটে যায় সেই কাহিনি, এটাই আমাদের লক্ষ্য।
এখনও পর্যন্ত আপনাদের যে বইগুলি বিক্রি হয়েছে, তার মধ্যে অলঙ্কার কোন বই গুলি? আর বাজারে কাটতি বেশি কাদের?
যে বইগুলো আমাদের অলংকার, সেই বইগুলোরই বাজারে কাটতি বেশি। এ'রকম বই একাধিক আছে। শুধুমাত্র কয়েকটা নাম এখানে বলছি। প্রথম থেকে শুরু করলে অনিন্দ্য সেনগুপ্তর সাই-ফাই কাহিনি ‘অপার্থিব’ ও ‘অন্ধযুগের সৃজনসঙ্গী’, অদ্বয় চৌধুরী ও অভিষেক ঝা সম্পাদিত কাশ্মীরের ছোটোগল্পের অনুবাদ সংকলন ‘কাশ্’, অর্ক দেব সম্পাদিত সাক্ষাৎকার সংকলন ‘কথাবার্তা’ এবং প্রবন্ধ সংকলন ‘গণিকাসম্বাদ’, বিশ্বদীপ দে-র গদ্য ‘হলুদ ট্যাক্সি’ এবং পত্র-আখ্যান ‘নক্ষত্রের রাত’, রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের ‘গোয়েন্দা কানাইচরণ সিরিজ’, অধীশা সরকারের ‘বিদ্যুৎলতা বটব্যাল সিরিজ’, অর্ক চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ সংকলন ‘জাক লাকাঁ’, অর্ক চট্টোপাধ্যায় ও অদ্বয় চৌধুরী সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলন ‘নবারুণ ভট্টাচার্য: মনন ও দর্শন’ এবং ‘সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়: মনন ও দর্শন’, হিরণ মিত্রর স্কেচসহ গদ্যের বই ‘ব্যক্তিগত চার্লি’, সোহিনী সেনগুপ্তর রূপকথার অনুবাদ সংকলন ‘রাজকন্যার দোয়াত-কলম’, পীতম চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতা-কেন্দ্রিক গদ্যের বই ‘শহরোক্তি’, দীপায়ন দত্ত রায় সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলন ‘পাঠকের প্রস্তুতি’, শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘এখানে ডেরেক বসে আছে’। এই নামগুলো মনে পড়ছে এই মুহূর্তে।
পাঠকের চাহিদা না বিষয়ের জোর—কোনটা মাথায় রেখে বই করেন?
পাঠক ভালো বই খুঁজে খুঁজে পড়ে। বিষয় ভালো হলে পাঠকের চাহিদা এমনিতেই তৈরি হয়।
পেপারব্যাক ছাপেন? না ছাপলে কেন ছাপেন না?
পেপারব্যাকও ছাপি, তবে পরিমাণে খুবই কম। এই মুহূর্তে মুলত হার্ডবাউন্ড বই-ই আমরা বেশি ছাপি।
পিওডি না অফসেট? কী বলবেন?
দু'রকমই হয়। সুবিধে ও প্রয়োজন অনুসারে।
আপনাদের হাউজের কোনও বাঁধা-ধরা লেখক রয়েছে?
না। কোনো লেখকের সমস্ত বই (ধরন ও সংখ্যা দুই দিক থেকেই) আমাদের প্রকাশনা থেকে প্রকাশ করা নিয়ে আমরা একটু ভিন্নধর্মী ভাবনা-চিন্তা রাখছি এই মুহূর্তে। কিন্তু নতুন প্রজন্মের লেখক যাঁরা ভালো লিখছেন বা সম্পাদনা-অনুবাদ করছেন তাঁদের নিজস্ব জঁর অনুযায়ী, তাঁদের সকলেরই একটি বা একাধিক বই বৈভাষিক থেকে প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে।
বইমেলায় স্টল পাওয়া নিয়ে একটা ক্ষোভ দেখা যায় প্রকাশকদের। তা নিয়ে কী মত আপনার?
বৈভাষিক ২০১৯ সাল থেকে একক স্টল পেয়ে আসছে। আমরা তার জন্যে বইমেলার আয়োজক পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড-কে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
কলকাতা বইমেলায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে এমন কোনও ভিন্ন লক্ষ্য থাকে কি যা কলেজস্ট্রিটে সে'ভাবে পাওয়া যায় না? মানে প্রচার-পরিচিতি, বা বিক্রি, বা ওয়ার্ড-অব-মাউথ তৈরি হওয়া—ইত্যাদি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আর কি!
বইমেলার বিক্রি অনেকটাই ভিন্নধর্মী। এত সংখ্যক পাঠক সে'খানে উপস্থিত হয়, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয় অনেক সময়েই। এত বিপুল সংখ্যক পাঠকের সঙ্গে অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে সরাসরি যোগাযোগ একটা আলাদা প্রভাব ফেলেই। কলেজস্ট্রিটেও এ'টা ঘটে, কিন্তু সারা বছর ধরে ঘটে। তাই তার তাৎক্ষণিক প্রভাব হয়তো সে'ভাবে অনুভব করা যায় না, যেটা বইমেলায় যায়।
শেষ প্রশ্ন, বাংলা বইয়ের বাজারে এখন অনলাইনেও ছাড়ে কিনতে পারছেন বিভিন্ন ক্রেতারা। কারণ ক্রেতারা আর কলকাতার ঘেরাটোপে আটকে নেই। সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ, বাইরের রাজ্যের প্রবাসী বাঙালিদের কাছে, এমনকি বাংলাদেশেও পৌঁছে যাচ্ছে বই। যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই উন্নত হয়েছে। কিন্তু সেই অর্থে বিক্রি কি বেড়েছে? আর এই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগে একজন প্রকাশক হিসেবে কলকাতা বইমেলাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? মানে, আবেগ সরিয়ে রেখে কেবলমাত্র ব্যবসার দিক থেকে যদি ভাবি, বইবিক্রির ক্ষেত্রে, বইয়ের প্রচারের ক্ষেত্রে কলকাতা বইমেলা ঠিক কী ভূমিকা পালন করছে আজকের দিনে?
আমরা যেহেতু ছোটো প্রকাশনা, তাই আমরা এই মুহূর্তে প্রতি বছর উন্নতি করছি বিক্রির নিরিখে। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা এত অল্প সময়ের পরিসরে যে পরিমাণ ব্যাবসা দেয়, তার তুলনা অন্য কোনোকিছুর সঙ্গেই চলে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায় সরাসরি বইমেলায়।