রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়া যিশুর যন্ত্রণাকে এঁকেছিলেন নন্দলাল, যামিনীরা
Jesus in Paintings : সব থেকে মর্মান্তিক চিত্রটি করেছেন নন্দলাল বসু। সেখানে তিনি দেখাচ্ছেন যিশু তাঁর নিজের কাঁধে নিয়ে চলেছেন মৃত্যুদণ্ড ক্রস-কে।
বাংলার মানুষের জীবনে যিশুর প্রভাব এবং মনে যিশুর আসন, প্রভাব হিসেবে দীর্ঘ আর আসন হিসেবে চিরস্থায়ী। শুধুমাত্র শহর নয় গ্রাম সমাজেও নানা ভাবে যিশু এবং মাতা মেরির আপন আসনটি সযত্নে রক্ষিত। সত্যি কথা বলতে কী, যিশুকে নিয়ে তার চলে নিজের সঙ্গে নিজের এক নিজস্ব সাত কাহন। রাজা প্রাণ নেবেন বলে ছোট্ট শিশুর কপাল লিখন। মা বাপের কী জীবনপণ চেষ্টা তাদের সন্তানকে রক্ষা করার! গাধার পিঠে চড়ে রওনা হলেন তারা মিশরের রাস্তায়। বঙ্গ দেশের গ্রাম সুবাদের মানুষ এই কাহিনির আড়ালে দেখতে পেল, ছোট্ট এক কালো শিশুর বাবাও রাজার দণ্ডাদেশের হাত থেকে নিজের বাচ্চাকে রক্ষা করতে কীভাবে পাড়ি দিচ্ছেন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। তাই হয়তো সেই কারণেই কালাচাঁদের জন্য যেমন বঙ্গদেশে কীর্তন রচিত হয়, একইভাবে বেথলেহেম সন্তানের জন্যও বঙ্গদেশে কীর্তন রচিত হয়। এইভাবেই যিশুর জীবন চর্চার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বাংলার মানুষের মন। ঠাকুর গদাধরের একবার ভাব সমাধি হয়েছিল ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো মা মেরির কোলে ছোট্ট যিশুর ছবি দেখে। আবার সেই ঠাকুর গদাধরের অনুগামী হবেন সংকল্প করে বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভাইরা যখন আটপৌরে ধুনি জ্বেলে বসেছেন, তখনও তাদের চর্চিত কথনে উঠে এল বাইবেল। সেই দিনক্ষণ মিলে গেল যিশুর জন্মের দিনের সঙ্গে। এমনভাবেই বাংলায় যিশু চর্চার একটি নতুন দিক রচিত হলো।
এমন যিশু চর্চার অভিঘাত পড়েছে বাংলার কোনও কোনও শিল্পীর মধ্যে। এদের মধ্যে যামিনী রায়ের নাম নিতে হয় সবার আগে। বড়দিনের উৎসব শুরু হয়ে গেল কলকাতার গির্জায় গির্জায়। তাদের মধ্যে অন্যতম সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল গির্জা। সেখানে এখন দিনভর চলবে যিশুর স্মরণ। সেই যিশু প্রার্থনায় অংশ নেবেন কত শত সাধারণ মানুষ। তাদের চোখ যাবে গির্জার নানা শিল্প সৌকর্যের দিকে। এই সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল গির্জাতেই রয়েছে যামিনী রায়ের আঁকা একটি ছবি, ‘লাস্ট সাপার’। মনে করা হয় একটি বিশেষ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি ছবি এঁকেছিলেন যামিনী রায়।
কলকাতার উপনিবেশে ইংল্যান্ড থেকে লোকজনের আসা যাওয়া লেগে রয়েছে সেকালে। তারা এদেশে নিয়ে আসছেন হরেক প্রকার জিনিসপত্র। লর্ড, ব্যারনদের মূর্তি নিয়ে আসা হচ্ছে কলকাতার চার রাস্তার মাঝে বসাবার জন্য, তারা নিয়ে আসছেন বিভিন্ন পাশ্চাত্য শিল্পীদের তৈলচিত্র, বাগানে বসানোর জন্য তারা জাহাজে করে নিয়ে আসছেন ফোয়ারা নির্মাণের পাথর ভেনাসের মূর্তি ও সঙ্গে আরও নানা কিছু। একদিন মনে করা হলো, কলকাতায় অনেক কিছুর সঙ্গে দরকার গির্জার। সেই মতোই ১৮৩৯ সালে একটি চোখ জুড়নো গির্জা পেল কলকাতা। আর এই চার্চের সঙ্গেই বাঙালির হৃদয় জুড়ে রইলেন শিল্পী যামিনী রায়। সেটা ষাট-সত্তরের দশক। বাংলা তখন নতুন রাজনৈতিক চেতনায় উত্তাল। অন্যদিকে চিনের লড়াইয়ের পর পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াইতে জড়িয়ে পড়তে চলেছে দেশ। এদেশের মানুষ ততদিনে প্রভু যিশুর মধ্যে মনের মানুষের সন্ধান পেয়েছেন। যিশু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন, দরিদ্র মানুষের মধ্যে রুটি বিলি করেন নিজের চেতনা থেকে, মানবিকতা বোধ থেকে। এরকম যখন দেশের সময় তখন বিশপ এইচ লাকদাসা জে ডেল মেল চাইলেন খ্রিস্টিয় উপাসনার ধারায় ভারতীয় ভাবনার যোগ ঘটাতে। আর ঠিক তখনই বাঙালি শিল্পীদের নিযুক্ত করার কথা ভাবা হলো গির্জার অলঙ্করণের ছবির জন্য। সেই ভাবনা থেকেই যামিনী রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে আলাপ আলোচনা করলেন বিশপ।
আরও পড়ুন- ভেলানকান্নি মাতা ও বড়দিনের প্রসাদি
আর সেই সূত্রেই যামিনী রায় এই গির্জার জন্য আঁকলেন 'লাস্ট সাপার'। আপামর বাঙালির কাছে সেদিন রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নানা দিক উন্মোচিত হচ্ছে। হয়তো এই পরিস্থিতিগুলির সঙ্গে 'লাস্ট সাপার' ছবিটিকে মিলিয়ে দেখেছিল এদেশের মানুষ। আসলে বাইবেলের নৈশভোজের গল্পের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে যিশুর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা।
শোনা যায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর প্রেস থেকেও নাকি যিশুর ছবি ছাপা হয়েছে। সেই ছবির অবশ্য হদিশ মেলে না। শিল্পী ললিতমোহন সেন যিশুকে সঙ্গে নিয়ে মেরি ও জোসেফ মিশরের পথে চলেছেন- এই বিষয়ে ছবি এঁকেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যভাবে এই ছবিতে শিল্পী মাদাম মেরির অবয়বের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন উত্তর ভারতের নারীর চরিত্রকে। এও এক অদ্ভুত খোঁজ। তবে সব থেকে মর্মান্তিক চিত্রটি করেছেন নন্দলাল বসু। সেখানে তিনি দেখাচ্ছেন যিশু তাঁর নিজের কাঁধে নিয়ে চলেছেন মৃত্যুদণ্ড ক্রস-কে। লাল কালিতে ভঙ্গুর রেখায় নন্দলাল বসু এঁকেছিলেন যিশুর এমন ছবি। এই হিসেবে দেখতে গেলে ঈশ্বর পুত্রের যন্ত্রণাই ছিল বাংলার শিল্পীদের পছন্দের বিষয়।