যিশু নেই, সান্তা নেই! ক্রিসমাসে বেথলেহেমের এই চেহারা আগে দেখেনি বিশ্ব
Bethlehem Christmas 2023 : বেথলেহেম যিশুহীন, শান্তিহীন। কেবল যুদ্ধ আর অমানবিকতা। এই ক্রিসমাসে সান্তা নেই কোনও বেথলেহেমে।
বেথলেহেম। সাধারণত ক্রিসমাসে সবচেয়ে ব্যস্ত থাকে যিশুর জন্মস্থান হিসেবে বিখ্যাত এই স্থান। কিন্তু এই বছর যুদ্ধ এসে বদলে দিয়েছে সমস্ত স্বাভাবিক হিসেব। ইজরায়েল-অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের এই ফিলিস্তিনি শহর স্তব্ধ তাই। পর্যটকরা আসেন না, ঈশ্বরবিশ্বাসীরাও নেই আর। হোটেল, রেস্তোঁরা খাঁ-খাঁ। বড়দিন নয় এখানে, এখানে ভয়ের দিন। ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইজরায়েলে হামাসের হামলা এবং প্রতিশোধ নিতে গাজায় ইজরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৩ মাস পেরোতে চলল। গাজার তো গুঁড়িয়ে গিয়েইছে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও বেড়েছে হিংসা। বেথলেহেমের ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, আর কেউই আসছেন না যিশুর এই জন্মভূমিতে, প্রাণ আগে, ধর্ম পরে৷
বেথলেহেমের ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, হোটেলগুলি ফাঁকা। অন্যান্য বছরে এই সময় ভিড় সামলানো যায় না। আলেকজান্ডার হোটেলের মালিক জোয়ি কানাভাতির পরিবার চার প্রজন্ম ধরে বেথলেহেমেই থাকেন, সেখানেই কাজ। এবারের বেথলেহেম তাঁদেরও অচেনা। তাঁদের কাছে সর্বকালের সবচেয়ে খারাপ ক্রিসমাস এই বছরই। ক্রিসমাস ট্রি নেই, আনন্দ নেই, ক্রিসমাসের সামান্য উত্তেজনাও নেই।
জেরুজালেমের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত, বেথলেহেম আয় এবং চাকরির জন্য সারা বিশ্ব থেকে আসা দর্শকদের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। পর্যটকরা এখানে চার্চ অফ দ্য নেটিভিটি দেখতে আসেন। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন যে যিশুর জন্ম হয়েছিল ঠিক এই চার্চের জায়গাতেই।
আরও পড়ুন- কোনওকালেই নাকি ক্রুশবিদ্ধ হননি যিশু! চাঞ্চল্যকর দাবি বাইবেলে
জোয়ি কানাভাতি জানাচ্ছেন,৭ অক্টোবরের আগে তাঁর হোটেলটি ক্রিসমাসের জন্য পুরোপুরি বুক করা হয়ে গিয়েছিল। এমনই অবস্থা ছিল যে যাদের তিনি নিজের হোটেলে রাখতে পারছেন না, তাঁদের জন্য শহরের অন্য কোথাও ঘর খুঁজছিলেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পরের বছরের বুকিং সহ সবটাই বাতিল হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র একের পর এক ইমেল আসতে থাকে হোটেলের রুম বুকিং বাতিলের।
প্রতি রাতে তাঁদের হোটেলে অন্ততপক্ষে ১২০ জন মানুষ ডিনার করতে আসতেন। ভিড়ে ঠাসা থাকত হোটেল। সেই হইহইও নেই, লোকজনও নেই। স্তব্ধ ডাইনিং হল। কোনও ক্রিসমাস ব্রেকফাস্ট নেই, ক্রিসমাস ডিনার নেই, ক্রিসমাস বুফে নেই।
ইজরায়েল এবং প্রতিবেশী আরব দেশগুলির মধ্যে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকেই ইজরায়েল ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক দখল করেছে। ফিলিস্তিনিরা ভবিষ্যতের স্বাধীন রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে চায়। ইজরায়েল পুরো এলাকা জুড়ে ইহুদি বসতি নির্মাণ করেছে, যা বেশিরভাগ দেশই অবৈধ বলে মনে করে। ইজরায়েল এই ভূখণ্ডের সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনা এবং বাইবেলের সম্পর্ককে উল্লেখ করে বারবার বিতর্ক শুরু করেছে। ইজরায়েলের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এখন এই চত্বরেই থাকেন। ৭ অক্টোবর থেকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ফিলিস্তিনিদের উপর ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা বেড়েছে।
আরও পড়ুন- রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়া যিশুর যন্ত্রণাকে এঁকেছিলেন নন্দলাল, যামিনীরা
বেথলেহেমের ম্যাঞ্জার স্কোয়ার হচ্ছে চার্চ অফ দ্য নেটিভিটির সামনে একটি বড় পাকা জায়গা। সাধারণত ক্রিসমাস উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে কাজ করে এই জায়গাটি। এই বড়দিনে সেই জায়গা প্রায় ফাঁকা, বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। রনি তাবাশের পারিবারিক দোকান এই এলাকাতে। দোকানে ক্রুসিফিক্স, ভার্জিন মেরির মূর্তি এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপহার বিক্রি করেন তিনি। জানাচ্ছেন, প্রায় দু'মাস কোনও তীর্থযাত্রী আসেনি, কোনও পর্যটকও না। তবু দোকান খুলে বসেন রোজ। আশা আর অভ্যাসেই মানুষ বাঁচে এখনও। মানুষ ভাবতে চায় সব ঠিক হয়ে যাবে, স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসবে।
স্থানীয় এক রেস্তোরাঁ আফতেমের মালিক আলা'আ সালামেহ জানাচ্ছেন, বিদেশি দর্শনার্থীদের স্বাভাবিক আনাগোনা নেই। তার পরিবর্তে স্থানীয় ফিলিস্তিনি পরিবারগুলির জন্যই খাবার তৈরি করছেন তিনি। রেস্তোঁরা খোলা রেখেছিলেন কারণ সেখানপকার কর্মীদের কাজের প্রয়োজন। এই কর্মীদের পরিবারগুলি বাঁচবে কীভাবে? এই কর্মীদের বাচ্চারা কী খাবে? তাই রেস্তোরাঁ খুলে রাখা। আর শান্তির জন্য প্রার্থনা করে যাওয়া। বেথলেহেম সেই শহর যেখানে শান্তির জন্ম হয়েছিল। শান্তির কথা বলতে গিয়েই কাঁটার মুকুট পরেছিলেন যিশু। সেই বেথলেহেম যিশুহীন, শান্তিহীন। কেবল যুদ্ধ আর অমানবিকতা। এই ক্রিসমাসে সান্তা নেই কোনও বেথলেহেমে।