ইতিহাসে মাখামাখি বড়দিন! কলকাতার বুকে যেভাবে বেঁচে রয়েছে একফালি আর্মেনিয়া
Armenian population in Kolkata: ১৯১৫ সাল থেকে গণহত্যা শুরু হয় আর ১৯২১ সালে কলকাতার জনগণনায় দেখা যায় শহরের আর্মেনিয় জনসংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে।
“আমাদের পুরো পরিবারই থাকতো ইরানের নিউ জুলফা শহরে। তখন ১৯১৫ সাল। আর্মেনিয় খ্রিস্টানদের নির্মূল করতে গণহত্যা শুরু করেছে অটোমান তুর্করা। পরিবারের কেউই বাঁচেনি। দিদিমাকে কাঁধে নিয়ে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে পালিয়েছিলেন আমার মা। আফগানিস্তান, কাবুল, খাইবার পাস হয়ে ভারতে এসে শেষ পর্যন্ত ঢাকা শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছিল। সেখানেই পাটকলে কাজ জুটিয়েছিলেন মা। প্রতিদিন চার আনা করে জমিয়ে রাখা হতো। সেই জমানো টাকা থেকেই কলকাতায় আমাদের হোটেল ব্যবসার শুরু।"
২০১৪ সালের এক দুপুরে মধ্য-কলকাতার সাদার স্ট্রিটে ফেয়ারলন হোটেলের লনে বসে এই কথাগুলো বলেছিলেন হোটেলের আর্মেনিয় মালকিন ভায়োলেট স্মিথ। বর্ণময় চরিত্রের এই মহিলাকে স্থানীয়রা বলতেন ‘ডাচেস অব সাদার স্ট্রিট’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার মুখেই এক ব্রিটিশ দম্পতির কাছ থেকে হোটেলটি কিনেছিলেন ভায়োলেট স্মিথের মা। তারপরই তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। দায়িত্ব নেওয়ার পর ৩৫ বছর ধরে তিলে তিলে এই হোটেলকে খ্যাতির মধ্যগগনে নিয়ে যান ভায়োলেট।
কলকাতায় এলে এই হোটেলেই থাকতেন গুন্টার গ্রাস। এই হোটেলেই থাকতেন অভিনেতা জিওফ্রে কেন্ডালের নাটকের পুরো দল। শহরে ঘুরে ঘুরে শেক্সপিয়রের নাটক মঞ্চস্থ করতেন তাঁরা। জিওফ্রে-র মেয়ে জেনিফারের সঙ্গে শশী কাপুরের আলাপ এই হোটেলেই। বম্বের ব্যস্ত সময়ের মধ্যেই লুকিয়ে কলকাতা এসে জেনিফারের সঙ্গে দেখা করতেন শশী। ভায়োলেটের কথায়, “শশী-জেনিফারের হনিমুনের ঘরটা আমিই সাজিয়ে দিয়েছিলাম। সেই ঘরটা এখনও একইরকম ভাবে রাখা আছে। ওরা দু’জন কলকাতা এলে এখানেই উঠত। একবার কোথা থেকে খবর বাইরে চলে গিয়েছিল। আমার হোটেলের গেট ভেঙে দিয়েছিল শশীর ফ্যানেরা।" এ ছাড়া মার্চেন্ট আইভরি প্রোডাকশনসের ‘শেক্সপিয়রওয়ালা’ সিনেমার শুটিং-ও হয়েছিল এই ফেয়ারলন হোটেল থেকেই।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়া যিশুর যন্ত্রণাকে এঁকেছিলেন নন্দলাল, যামিনীরা
উদ্বাস্তু সমাজের অংশ হিসেবে কলকাতায় এলেও এই শহর ছিল ভায়োলেটের নিজের শহর। মেয়ে তাঁকে বহুবার ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু রাজি করাতে পারেননি কখনওই। সেই প্রসঙ্গ উঠতে ভায়োলেট বলেছিলেন, "আমি ভিখারি নই। নিজের টাকা নিজে রোজগার করি। নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করি। কলকাতাকে ভালবাসি। ৯৩ বছর বয়সেও ব্যবসা চালাচ্ছি। জীবন পুরোপুরি উপভোগ করছি। এখানে সবার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করে কেটে যায়। ইংল্যান্ডের জীবন আমার খুবই যান্ত্রিক লাগে। জন্ম এখানে, আমি মারাও যেতে চাই এই কলকাতাতেই।"
সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন ভায়োলেট স্মিথ। কলকাতাতেই সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে।
এই গল্প শুধু ভায়োলেটের একার নয়। কলকাতা সহ পুরো বাংলায় কয়েক শতাব্দী ধরে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার আর্মেনিয় ক্রিশ্চানদের বেশিরভাগের জীবনের গল্প আসলে একই সুরে বাঁধা। সেই সুরের হদিশ পেতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশো বছর, কয়েক হাজার মাইল দূরে কাস্পিয়ান সাগরের কাছে এক প্রাচীন জনপদে।
আরবের মাটিতে যিশুখ্রিস্টের উত্থানের তিনশো বছরের মধ্যেই খ্রিস্টান ধর্মের অনুগামী হন আর্মেনিয়রা। পৃথিবীর প্রথম খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আর্মেনিয়রা। তৈরি হয় পৃথিবীর সব থেকে পুরনো জাতীয় চার্চ আর্মেনিয়ান অ্যাপস্টিলিক চার্চ। সময়ের সঙ্গে যদিও এই আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের শক্তি কমতে থাকে আর দুর্দশার শুরু তখন থেকেই। আর্মেনিয়ার এক দিকে অবস্থান পারস্যের, অন্যদিকে তুরস্ক। শক্তিশালী এই দুই রাষ্ট্রের চাপে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রাচীন এই দেশ। শুধু পারস্য বা তুরস্ক নয়, বছরের পর বছর এই দেশটিতে নিজেদের ইচ্ছেমতো লুঠতরাজ চালাতে শুরু করে তাতার, মোঙ্গল, কুর্দ, আরব ও রুশেরা। শেষ পর্যন্ত ত্রয়োদশ শতকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয় গোটা দেশটিকে।
দেশ না থাকলেও মানুষ থাকেই। আর ঘর যখন আগুনে পুড়ছে, তখন সেই ঘর ছাড়াই দস্তুর। আর্মেনিয়রাও তার ব্যতিক্রম নয়। সিল্করুটের বিভিন্ন পথ ধরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন তাঁরা। এই পথে তাঁদের আনাগোনার ইতিহাস বেশ পুরনো। আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভান থেকে সিল্করুটের বিভিন্ন পথে যাওয়া যায় খুব সহজেই। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকত আর্মেনিয় বণিকদের। ব্যবসা-বাণিজ্যে দক্ষতার জন্য তাঁদের ডাকা হত ‘মার্চেন্ট প্রিন্সেস অব ইস্ট’ নামে।
এরকমই একটা সময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে ফেলতে সক্ষম হন তাঁরা। দূরদর্শী মোঘল সম্রাট আকবর আর্মেনিয়দের ব্যবসায়িক দক্ষতার বিষয়ে জানতেন। আর আর্মেনিয়দের দেশে তখন চলছে নিত্য হত্যালীলা। তাঁদের ব্যবসায়িক দক্ষতাকে কাজে লাগাতে আর্মেনিয়দের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেন আকবর। আর্মেনিয় কন্যা মরিয়ম জামানি বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। মোঘল রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে মরিয়মের জন্য আলাদা প্রাসাদ তৈরি করে দেন আকবর। পাশাপাশি আগ্রাতে আর্মেনিয় বণিকদের জন্য চার্চ ও আলাদা সমাধিক্ষেত্রও আকবরেরই তৈরি করে দেওয়া। এ ভাবেই ভারতের বুকে এক টুকরো নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়, যেখানে আর গণহত্যার ভয় নেই, নির্বিঘ্নে ধর্মাচরণেও বাধা নেই, আর ব্যবসার জন্য মিলবে খোদ রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা।
আরও পড়ুন: ক্ষমতার লাথি খাওয়া নাস্তিক দর্শনকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলেন আকবর
এশিয়ার বাণিজ্যে বাংলার উত্থানের শুরু এই সময় থেকেই। এই বাংলাকে ‘ভারতের স্বর্গ’ বলছেন মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। সেই সময়ের ফারসি নথিতে বাংলাকে বলা হচ্ছে ‘জন্নত উল বিলাদ’ অর্থাৎ ‘স্বর্গের দেশ’। আর ফরাসি পর্যটক তাভার্নিয়ের বাংলাকে নিয়ে লিখছেন,
"বাংলার ঐশ্বর্য আসলেই প্রবাদপ্রতিম। এখানে ঢুকবার শয়ে শয়ে পথ রয়েছে। কিন্তু বেরিয়ে আসার কোনও রাস্তা নেই।"
বাংলার সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে এখানে তখন কুঠি তৈরি করছেন ইউরোপিয় বণিকরাও। ১৬৪৫ সালে ডাচ বণিকদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে হুগলি নদীর পাশের শহর চুঁচুড়াতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন আর্মেনিয়দের মারগার পরিবার। কয়েক বছরের মধ্যেই ১৬৬৫ সালে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের কাছে সৈদাবাদে আর্মেনিয় বণিকদের চার্চ, সমাধিক্ষেত্র ও কলোনি তৈরির ফরমান দেন খোদ মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। এর পর ঢাকা, কলকাতা, চন্দননগর, মুঙ্গের, একের পর এক জায়গায় নিজেদের কুঠি তৈরি করে ফেলেন আর্মেনিয়রা। আর্মেনিয় বণিকদের দক্ষতার খবর ছিল খোদ লন্ডনেও। বাংলায় পাঠানো একটি চিঠিতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টররা লিখছেন, "এই আর্মেনিয়রা সারা ভারতের প্রতিটি গ্রাম চেনে, কোথায়-কখন-কীভাবে পণ্য উৎপাদন হয়, সেই সম্বন্ধে এঁদের জ্ঞান সুপ্রাচীন লিনেন কাপড়ের মতোই সুক্ষ।"
একদিকে মোঘল দরবার, অন্যদিকে মুর্শিদাবাদে নবাবের মসনদ─এই দুই জায়গাতেই স্বচ্ছন্দ চলাফেরা ছিল আর্মেনিয় বণিকদের। তাঁদের এই যোগাযোগকে কাজে লাগাতে দেরি করেননি ব্রিটিশ বণিকরা। বাংলার রেশম, মসলিন আর সস্তা কটনের তখন বিপুল চাহিদা। ইওরোপের যুদ্ধে বোমার মশলা হিসেবে সল্টপিটারও যেতো এই বাংলা থেকেই। বাংলার বাণিজ্যে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে তখন মরিয়া ডাচ, ব্রিটিশ আর ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দল।
সপ্তদশ শতকের শেষেই আর্মেনিয় বণিক খাজা ফানুস কালান্দারের সঙ্গে লন্ডনে বৈঠকে বসেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিরা। ব্রিটিশ বণিকদের সঙ্গে আর্মেনিয় বণিকদের এই চুক্তি শেষ পর্যন্ত বাংলায় ব্রিটিশ আধিপত্যের পিছনে অন্যতম অনুঘটক হয়ে দাঁড়ায়। দুর্বল মোঘল সম্রাট ফারুকশিয়রের কাছে বাণিজ্যে ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য যে প্রতিনিধিদল পাঠান ব্রিটিশ বণিকেরা, তার অন্যতম নেতৃত্ব ছিল কালান্দারের ভাইপো খাজা সরহদের হাতেই। সেই দৌত্যের ফলেই শেষ পর্যন্ত বাংলার মাটিতে বাণিজ্যের ছাড়পত্র পান ব্রিটিশ বণিকেরা, যা ইতিহাসে বিখ্যাত ‘গ্র্যান্ড ফরমান’ নামে।
আরও পড়ুন: ভেলানকান্নি মাতা ও বড়দিনের প্রসাদি
কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলা হয়ে ওঠে ভারত-ইউরোপ বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র। দেখা যাচ্ছে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি যে পরিমাণ কাপড় ইউরোপে যেত, তার ৭০-৮০ শতাংশই বাংলায় উৎপন্ন হত।
এই সময়ই বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে প্রথম বারের জন্য দেখা যায় আর্মেনিয় বণিকদের। মুনাফার কারণেই ব্রিটিশ বণিকদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় আর্মেনিয় বণিকদের, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে আর্মেনিয় বণিক খাজা ওয়াজিদের। মুর্শিদাবাদের দরবারে তাঁর দাপট এতটাই ছিল, যে আলিবর্দির উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজের বশ্যতা স্বীকার করাতে তিনি বাধ্য করেন ব্রিটিশ বণিকদের। পাশাপাশি ব্রিটিশ বণিকদের সঙ্গে বিহারের ছাপড়ার ফৌজদার দীপচাঁদের একটি মোকদ্দমায় তিনি ব্রিটিশ বণিকদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও আদায় করেন। আক্ষরিক অর্থেই তখন বাংলার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ আর খাজা ওয়াজিদের দখলে। ব্রিটিশদের মোকাবিলায় সিরাজকে ফরাসিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার পরামর্শও খাজা ওয়াজিদের ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। তাঁর একের পর এক পরিকল্পনা অবশ্য ভেস্তে যায়। নবাবের কাছেও প্রত্যাখ্যাত হন ওয়াজিদ। খানিক বাধ্য হয়েই একেবারে শেষ পর্যায়ে সিরাজ-বিদ্রোহী যড়যন্ত্রে উমিচাঁদ আর জগৎ শেঠদের সঙ্গে হাত মেলান তিনি।
পলাশির যুদ্ধে পতন হয় মুর্শিদাবাদ, সিরাজ, ওয়াজিদ, উমিচাঁদ আর জগৎ শেঠদের। আর বাংলার দখল যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ওয়াজিদকে নিয়ে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ লিখছেন, "আমি খুব ভাল করেই জানি, আমাদের কলকাতায় সমস্ত সমস্যার মূলে আছেন এই ওয়াজিদ। এখনও ও আমাদের বিরুদ্ধে ডাচদের লড়িয়ে দেওয়া পরিকল্পনা করছে। কিন্তু এই ভাবে মির জাফর, মিরন ও আমার সম্পর্কে ভাঙন ধরানো যাবে না।" ক্লাইভের রোষ থেকে বাঁচতে শেষ পর্যন্ত বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন খাজা ওয়াজিদ।
মুর্শিদাবাদের পতনের সঙ্গেই শুরু হয় কলকাতার উত্থান। বাংলার মাটিতে আর্মেনিয়দের দ্বিতীয় পর্বও শুরু হয় এই সময় থেকেই। ইরান, তুরস্কে তখনও চলছে বেছে বেছে আর্মেনিয়দের হত্যা করার একের পর এক অভিযান। আর্মেনিয় বণিকরা ততদিনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেৱ আমস্টারডাম থেকে শুরু করে ম্যানিলা পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রেই। ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতাতেও তাঁরা সক্রিয় ভাবে ব্যবসায় অংশগ্রহণ শুরু করেন। কয়লা খনি, রেলপথ, হোটেল, সল্টপিটার, লাক্ষা, রিয়েল এস্টেট সর্বত্রই দেখা যায় আর্মেনিয় বণিকদের উপস্থিতি। তাঁদের বলা হত ‘রিয়েল এস্টেট ব্যারনস অফ কলকাতা’। জে সি গলস্টন নামের এক আর্মেনিয় প্রপার্টি ডিলার এক সময় কলকাতার প্রায় ৩৫০টি বড় বাড়ির মালিক ছিলেন। রওডন স্ট্রিট আর প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের অধিকাংশ বাড়িই ছিল আর্মেনিয় বিল্ডারদের। এখনও এই এলাকার অনেকই বাড়িই আর্মেনিয় মালিকাধীন। পার্ক ম্যানসন, নিজাম প্যালেস, কুইনস ম্যানসন, হ্যারিংটন ম্যানসন, গ্রান্ড হোটেল, স্টিফেন হাউস, স্টিফেন কোর্ট সহ অনেক বাড়িই ছিল আর্মেনিয় মালিকাধীন। যে কার্লটন হোটেল ভেঙে পিয়ারলেস হোটেল তৈরি হয়, তাও ছিল কলকাতার আর্মেনিয় নাগরিকদেরই।
আরও পড়ুন: কলকাতার তো বটেই, যিশু গোটা বাংলার, খ্রিস্ট-কৃষ্ণকে সত্যিই মিলিয়েছে বাঙালি
এর পরই আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মানুষের জানা সব থেকে বড় গণহত্যা সংগঠিত হয় তুরস্কে। প্রায় ১৫ লক্ষ আর্মেনিয় ক্রিশ্চানকে সিরিয়ার মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। ১৯১৫ সাল থেকে গণহত্যা শুরু হয় আর ১৯২১ সালে কলকাতার জনগণনায় দেখা যায় শহরের আর্মেনিয় জনসংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। যাঁরা গণহত্যা থেকে বাঁচতে পেরেছিলেন, তাঁদের অনেকেরই ঠাঁই মিলেছিল এই শহর কলকাতায়, যেমনটা ভায়োলেট স্মিথের পরিবারের ক্ষেত্রে হয়েছিল।
ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, কলকাতা, ভেনিস। আর্মেনিয় বণিকদের এই কেন্দ্রগুলি তখন হয়ে দাঁড়ায় দেশছাড়া মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার জায়গা। দেশ নেই, অথচ দেশের বাইরের এই কেন্দ্রগুলিই ছিল তখন আর্মেনিয় সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখায় একমাত্র জায়গা। আর্মেনিয় জনজাতির ইতিহাসে এই কেন্দ্রগুলির ভূমিকা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতাও আর্মেনিয়দের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় এই সময়েই। আর্মেনিয় সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় এই কলকাতাতেই। প্রেসের মাধ্যমে আর্মেনিয় জনজাতির দুর্দশার কথা তাঁরা জানাতে শুরু করেন সারা পৃথিবীকে। আজাদারার, মিরর, আরা, একের পর এক পত্রিকা বেরোতে শুরু করে কলকাতা থেকে। আর সেই কাজে সারা পৃথিবীর আর্মেনিয় বণিকেরা অকাতরে অর্থসাহায্যও করেন। আর্মেনিয় ভাষার ক্ষেত্রেও কলকাতার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। মডার্ন আর্মেনিয়ান নাকি ক্লাসিকাল আর্মেনিয়ান, আধুনিক পড়াশোনার মাধ্যম হিসেবে কোন ভাষাটিকে বেছে নেওয়া হবে, সেই বিতর্কেও কলকাতার ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরে একের পর আর্মেনিয় স্কুল তৈরিও শুরু করেন তাঁরা। সেখানে আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি চলতো আর্মেনিয় ভাষা শিক্ষাও। ১৭৯৮ সালে আর্মেনিয়দের প্রথম স্কুল তৈরি হয় কলকাতায়। ১৮২১ সালে ওল্ড চায়নাবাজার স্ট্রিটে তৈরি হয় আর্মেনিয়ান ফিলানথ্রপিক অ্যাকাডেমি। এই স্কুলটিই পরে নিয়ে যাওয়া হয় ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে, যাকে আমরা জানি আর্মেনিয়ান কলেজ হিসেবে। এই স্কুলটি চালু আছে এখনও। ইরানে থেকে যাওয়া আর্মেনিয়দের অনেকেই এখনও এই স্কুলে বাচ্চাদের পড়তে পাঠিয়ে দেন। এর বাইরে তৈরি হয়েছিল আর্মেনিয়ান ইনফ্যান্ট সেমেটরি, ডাভিডিয়ান গার্লস স্কুল, ময়ের হল স্কুল। চার্চকে কেন্দ্রে রেখে স্কুলের মাধ্যমে এই ভাবেই ঘরছাড়া আর্মেনিয়দের কাছে কলকাতা হয়ে উঠেছিল দেশের বাইরের দেশ।
বাকিরা দেশের বাইরের দেশ হিসেবে কলকাতায় অভ্যস্ত হয়ে গেলেও সবাই এক রকম ভাবেননি। এরকমই এক যুবক যোসেফ আমিন। ১৭২২ সালে পারস্যের হামাদান শহরে জন্ম নেন এমিন। এই শহরেই আর্মেনিয় চার্চের ভিতরে এক রাতে হত্যা করা হয়েছিল ৮০০ আর্মেনিয়কে। তার মধ্যে ছিল তাঁর প্রায় পুরো পরিবারই। এর পরই নাদির শাহের নেতৃত্বে চলে ফের হত্যালীলা। এই সময় মারা যান এমিনের মা, ভাই আর দাদু। বাঁচার তাগিদে বাগদাদ, হামাদান, বসরা, কাজভিন, কাসান, কুম, ইস্ফাহান, জুলফা, একের পর এক শহরে পালিয়ে বেড়ান তিনি। শেষ পর্যন্ত বসরা থেকে একটি জাহাজে করে সুরাট হয়ে পৌঁছন কলকাতায়। ১৭৪৪ সালে এমিন যখন কলকাতায় পৌঁছন, তখন তাঁর ৬৫ জনের পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য তিনিই।
কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে সাত বছরের মধ্যে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন এমিন। সেখানে রয়্যাল ইংল্যান্ড অ্যাকাদেমিতে সেনা প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এর পর তাঁকে ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধে পাঠানো হয়। কিন্তু এমিনের পরিকল্পনা ব্রিটিশের হয়ে যুদ্ধ করা ছিল না। তাই সেখান থেকে পালিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের আর্মেনিয় অঞ্চলগুলি দিয়ে গোপনে তিনি হাজির হন এতজমিয়াজদিন শহরে। এই শহরেই আছে সারা পৃথিবীর আর্মেনিয়দের কেন্দ্রীয় চার্চ ‘আর্মেনিয় অ্যাপস্টিলিক চার্চ’। পারস্য আর তুরস্কের হামলা থেকে দেশবাসীকে উদ্ধার করতে এখান থেকেই অভিযান শুরু করেন এমিন। পার্বত্য কারাবাগের আর্মেনিয় উপজাতি, জর্জিয়া আর আর্মেনিয় চার্চের যাজকদের সাহায্য নিয়ে সেই অভিযান শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যান যাজকরাই। কোনও জোরালো সমর্থন না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েই ১৭৬১ সালে লন্ডনে ফিরে যান এমিন।
আরও পড়ুন: আজ যিশু কলকাতার, আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা গির্জার সুলুকসন্ধান…
এই বছরই ফের লন্ডন থেকে পালিয়ে রাশিয়া দিয়ে তিবিলিসিতে গিয়ে পৌঁছন এবং জর্জিয়ার শাসকের কাছে সরাসরি সমর্থন দাবি করেন। এর মধ্যে পুরনো যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে উত্তর ককেশাসে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু জর্জিয়ার রাজা তাঁকে ফের খালি হাতে ফেরান। পরের পাঁচ বছর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে লিবারেশন আর্মি তৈরি করার কাজ চালিয়ে যান তিনি। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে স্থানীয় সমর্থন না পাওয়ায় ১৭৭০ সালে ফের কলকাতায় ফিরে আসেন এমিন। এর পর তিনি আরও বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিলেও কলকাতার আর্মেনিয় সমাজ থেকে বিশেষ কোনও সাহায্য তিনি পাননি। শেষ পর্যন্ত ১৮০৯ সালে কলকাতাতেই মারা যান এমিন। কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চ অব হোলি ন্যাজারেথে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। যে স্বাধীনতার জন্য এমিন লড়াই চালিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নপূরণ হয় ১৯৯১ সালে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পূর্বতন গ্রেটার আর্মেনিয়ার একটি ছোট্ট অংশ আর্মেনিয় দেশ হিসেবে স্বাধীন পরিচিতি পায়। শেষ হয় প্রায় ৮০০ বছরের স্বাধীনতার লড়াই।
আর্মেনিয়া স্বাধীন হলেও শহরে থেকে যাওয়া ছোট্ট আর্মেনিয় জনগোষ্ঠীর কেউই আর সেই দেশে ফিরে যাননি। কয়েক প্রজন্মের কলকাতার জলহাওয়ায় তাঁরা এখন হয়ে উঠেছেন স্থানীয়ই। ময়দানের আর্মেনিয়ান ক্লাবে গেলেই দেখা মেলে তাঁদের। বড়বাজারের কাছে আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অব ন্যাজারেথ, চুঁচুড়ার আর্মেনিয় চার্চ, পার্ক স্ট্রিট বা চায়না টাউনের আর্মেনিয় চার্চে এখনও বছরের নির্দিষ্ট দিনে প্রার্থনা সারেন তাঁরা। সারা দেশে এক সময় তাঁরা থাকলেও টিকে আছে শুধু কলকাতার জনগোষ্ঠীই।