পেট ভরে খাইয়ে মানসিক ভারসাম্যহীনকে খুন ছাত্রদের! এটাই কি নতুন বাংলাদেশ?

Dhaka University Murder: ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাওয়ায় ছাত্ররা। পেট ভরে খাইয়ে জানালার সঙ্গে হাত বেঁধে স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে মারা হয় তোফাজ্জলকে।

বলি হবে। অথবা হত্যার উৎসব! একজনকে পিটিয়ে মারার পাশবিক উৎসব! তার আগে তো পেট ভরে খাওয়ানোই দস্তুর! তারপর সেই হত্যার ঘটনার ভিডিও হবে, উল্লাসের সেই দৃশ্য বছরের পর বছর মোবাইলে জমিয়ে রেখে দৈহিক শান্তি হবে। মানুষ খুবই সস্তা, এই নিয়ে আর দ্বিমত রাখা চলে না। বিশেষত সেই মানুষ, যে একা, যে আর পাঁচজনের মতো নয়। তাই একজন মানুষকে পেট পুরে খাইয়ে দিয়ে হত্যা করে অন্য মানুষ। এক মানুষের পরিচয় মানসিক ভারসাম্যহীন, অন্যদের পরিচয় ছাত্র! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাংলাদেশে এই ঘটনা নতুন নয়। তবে 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ'-এর পর গড়ে ওঠা বাংলাদেশে এই ঘটনা স্তম্ভিত করে বৈকি!

এক নয়, একাধিক গণপিটুনি। কাউকে গ্রিলে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা থেকে ধরে নিয়ে একাধিকবার পিটিয়ে আধমরা করে ফেলা হয়েছে, পরে মৃত্যু হয়েছে। একই দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা দল বেঁধে পিটিয়ে মেরেছে অন্য মানুষকে। সেই ঘটনার ভিডিও রেকর্ড করেছে। কিছুদিন আগেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগের প্রাক্তন এক নেতাকেও এভাবেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাড়ে ১৫ বছরের শাসক আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূসকে মাথায় রেখে গঠন হয় অন্তর্বর্তী সরকার। নয়া বাংলাদেশে সেই তখন থেকেই আইনশৃঙ্খলা ভুলে গিয়েছে মানুষ। হামলা, মারামারি, খুনোখুনি, লুঠপাট অবাধে চলছে।

আরও পড়ুন- সেনার হাতে বড় ক্ষমতা দিল ইউনূস সরকার! কী কী করতে পারে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী?

এই মাসের গোড়াতেই গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহীতে প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে পিটিয়ে আধমরা করা হয়, পরে তাঁর মৃত্যু হয়। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এই নির্মমতা! তবে এখানে যে যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের কেউই নন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তোফাজ্জল হোসেন নামে যে যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তিনি ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’। এই কথা তোফাজ্জলের মামাতো বোন ওই 'খুনি' ছাত্রদের বলেওছিলেন। একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের কীভাবে আত্মীয়ের ফোন নম্বর মনে থাকে, এই কথা বিশ্বাস না করে আরও পেটানো হয় তাঁকে।

কেন তোফাজ্জুলকে পেটানো হলো? সন্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে 'সন্দেহজনকভাবে' ঘোরাঘুরি করছিলেন তোফাজ্জল হোসেন। এই হলের কয়েকজন ছাত্রের ফোন চুরি হয়েছিল সেদিন। চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে ধরে নিয়ে গিয়ে এলোপাথাড়ি চড়-থাপ্পড় মারা চলে।

তারপর তাঁকে ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাওয়ায় ছাত্ররা। পেট ভরে খাইয়ে জানালার সঙ্গে হাত বেঁধে স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে মারা হয় তোফাজ্জলকে। তোফাজ্জল অচেতন হয়ে পড়লে তার দুই হাত জড়িয়ে রেখে সেখানে স্ট্যাম্প চাপিয়ে দুই পাশে দুই ছাত্র উঠে চাপ দিতে থাকে। চরম নির্মম এসব ঘটনা কিন্তু রেকর্ড করা হচ্ছিল মোবাইলে! বিষয়টি জানতে পেরে অচেতন তোফাজ্জলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান এক শিক্ষক। তাঁকে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়।

আরও পড়ুন- আবু সাঈদের স্বপ্নের মৃত্যু, একবার, আবার, বারবার

তোফাজ্জলকে দেখেই যেখানে অসংলগ্ন মনে হচ্ছে, সেখানে কীভাবে তাঁকে আগে পুলিশে না ধরিয়ে, সেনার হাতে তুলে না দিয়ে ছাত্ররাই হত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন? এই ভয়াবহ ঘটনা ছাত্রসমাজের থেকে কি প্রত্যাশা করেছিল মানুষ? তোফাজ্জলের জীবনের ঘটনাও পরে প্রকাশ পেয়েছে। তোফাজ্জল শুরু থেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন না। দুই ভাই আর বাবা-মা নিয়ে ছিল তোফাজ্জলের সংসার। তোফাজ্জলদের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছিলেন তোফাজ্জল। আট বছর আগে দুর্ঘটনায় বাবা মারা যান, পাঁচ বছর আগে মারা যান তাঁর মা। এরপরই তোফাজ্জলের আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। তাঁর দেখভাল করতেন বড় দাদা পুলিশের এসআই নাসির হোসেন। তিনিও গত বছর ক্যান্সারে মারা যান। তোফাজ্জলের মামাবাড়ির আত্মীয়তা তোফাজ্জলকে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ঠিকই কিন্তু তিনি পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন।

তোফাজ্জলের মামাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া জানিয়েছেন, সেই রাতে তোফাজ্জলকে আটকে রাখার সময় তাঁর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে তানিয়ার বাবাকে ফোন করে ছাত্ররা। বলা হয়, ‘তোফাজ্জল মোবাইল ফোন চুরি করছে। ছাড়াতে হলে ৩৫ হাজার টাকা দিতে হবে।’ তানিয়া তখন ছাত্রদের আবার ফোন করে তোফাজ্জলের বিষয়টি বিস্তারে বলেন। ছাত্ররা সে কথা বিশ্বাস করেনি। যুক্তি দেয়, একজন মানসিক রোগীর এত ফোন নম্বর মুখস্থ থাকার কথা না। তারপর পেট ভরে একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে খাইয়ে পিটিয়ে হত্যার উৎসব! হত্যা করছেন ছাত্ররা। যে ছাত্রসমাজই কয়েকমাস আগে কোটা সংস্কারের দাবি করছিল, যে ছাত্রসমাজই বাংলাদেশকে 'নতুন স্বাধীনতার সূর্য' উপহার দিয়েছেন। এই ঘটনা মানবিকতার মুখে এক প্রকাণ্ড থাপ্পড় নয় কি?

More Articles