প্রাচীন কলকাতায় এসেছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক!
Captain Haddock in Kolkata: 'হবসন-জবসন' নামটা এল কোত্থেকে? এ হলো, গোরা সৈন্যদের কানে 'হায় হাসান হায় হোসেন' ধ্বনির বিকৃত রূপ।
ক্যাপ্টেন হ্যাডক এখনও আমার প্রিয় চরিত্র। দুর্দান্ত। কীর্তিকলাপ, মাতলামি, আর ফুর্তিভরা সাহসে অনেক দশক ধরে বাংলার ঘরে ঘরে তাঁর জয়যাত্রা। টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চারে ক্যাপ্টেন হ্যাডক এক অত্যাশ্চর্য পাগলা হাওয়া। অ্যার্জে (স্কুলবয়সে আমরা জানতুম হার্জ) এই ক্যাপ্টেন হ্যাডককে কোথা থেকে পেলেন কে জানে! বেলজিয়ান বিশ্ববিখ্যাত কমিকস স্রষ্টা (১৯০৭-১৯৮৩) ‘অ্যার্জে' এই ছদ্মনামেই বিশ্ববিখ্যাত। প্রকৃত নাম জর্জ রেমি।
ইতিহাসে কত আশ্চর্য সব সমাপতন লুকিয়ে থাকে। এক ক্যাপ্টেন হ্যাডককে পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা শহরের প্রাচীন ইতিবৃত্তে। ১৬৮৮ সালের জনৈক নাবিকের রোজনামচায় স্পষ্ট লেখা আছে,
“আমি এবং ১২০জন সৈন্য ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে ক্যাপ্টেন হ্যাডকের সহিত কলিকাতায় আসিয়া পহুছিলাম।"
মূল ডায়েরিটি ইংরেজিতে লেখা, এখানে আমার অক্ষম তর্জমা। টিনটিন দিল্লিতে এসেছিল, কলকাতায় আসেনি। আমার দেখে বেশ একটু আরাম হলো, কোনও এক ক্যাপ্টেন হ্যাডক প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে তো কলকাতায় এসেছিলেন! এই হ্যাডক সম্পর্কে অবশ্য আগে-পরে তেমন কোনও তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না।
যে বই থেকে এই রোজনামচার ছোট্ট উদ্ধৃতি ব্যবহার করলাম, সে এক অত্যাশ্চর্য জাদুগ্রন্থ! উপনিবেশের ভারতবর্ষ, সেকালের বঙ্গদেশ এবং কলকাতার কতশত চোখ-ধাঁধানো তথ্য, গল্প, টীকাভাষ্য সে বইয়ের পাতায় পাতায়! কোনও অজানা কারণে বইটি নিয়ে কারও কথাবার্তা শুনি না। অথচ বিশ শতকের শেষদিকেও বইটি নিয়ে নানা চর্চা চলত বাঙালি বিদ্বজ্জনদের বৈঠকে। বইয়ের নামটি চমৎকার! 'হবসন-জবসন'। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৬ সালে। শতবর্ষপূর্তিতে রূপা অ্যান্ড কোং একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেন। তেমনই একটি আমার হেফাজতে আছে।
আরও পড়ুন- ‘ঘড়ির সময়’ আর ‘মহাকাল’ আমাদের বিস্ময়ে নির্বাক করে উড়ে যাচ্ছে
অভিধান বলতে আমরা বুঝি, এমন এক কোষগ্রন্থ যেখানে শব্দগুলির অর্থ এবং ব্যবহার দেওয়া থাকে। বড় অভিধানে থাকে শব্দের ব্যাকরণগত টীকা বা ব্যুৎপতির রূপরেখা। এখানে, আছে শব্দের ইতিহাস, ভূগোল, এমনকী সমাজতাত্ত্বিক ভাষ্য। প্রায় বিস্তৃত, সুপণ্ডিত সুবীর রায়চৌধুরী একদা 'চতুরঙ্গ' পত্রিকায় এই বইটি নিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
মোদ্দা কথা হলো, এ বই অভিধান নয়। এই গ্রন্থের সংকলক হলেন, হেনরি ইউল এবং আর্থার বারনেল। তাঁরা বইটিকে বলছেন গ্লসারি বা শব্দকোষ। চারশো, সাড়ে চারশো বছরের ইউরোপিয় তথা ইংরেজের সান্নিধ্যে উভয়ের ভাষা পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে। কখনও কখনও ভারত-ব্রিটিশ উভয়ে মিলে শব্দ বিকৃত করেছে। উচ্চারণে পালেট গেছে আদি চেহারা। সেইসব ঠিকুজি-কুলুজি অবাক করা নৈপুণ্যে, প্রায় কুড়ি বছরের যৌথ পরিশ্রমে খুঁজে বের করেছেন দু'জনে। কত নথিপত্র যে তাঁদের ঘাঁটতে হয়েছে এই 'শব্দভেদী' রোমাঞ্চকর অভিযাত্রায়, বইটির যে কোনও একটি পাতা দেখলেই সেটা মালুম হবে। 'হবসন-জবসন' নামটা এল কোত্থেকে? এ শব্দ অক্সফোর্ড অভিধানে নেই কিন্তু ওয়েবস্টারে আছে। এ হলো, গোরা সৈন্যদের কানে 'হায় হাসান হায় হোসেন' ধ্বনির বিকৃত রূপ। এরকম পাল্টে যাওয়া নানা শব্দকে ধরে ধরে তার অনুষঙ্গ, ব্যবহারের ইতিহাস এবং ব্যবহারের বৈশিষ্ট্য পরিবেশিত হয়েছে এই বইটিতে। সাত হাজারেরও বেশি শব্দ এখানে সংকলিত। কয়েকটি শব্দ দেখে উৎস বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
যেমন ধরা যাক, LOONGHEE = লুঙ্গি, BUDZAT = বজ্জাত, GUNTA = ঘণ্টা, KUBBER = খবর, CRANNY = কেরানি, JAD OGUR = জাদুঘর প্রভৃতি। সম্পাদকদ্বয় বইটি সম্পর্কে দীর্ঘ এবং বাছালো বাছালো শব্দ সমন্বিত উপশিরোনাম পাঠকের দরবারে পেশ করেছিলেন। ‘A GLOSSARY OF COLLOQUIAL ANGLO INDIAN WORDS AND PHRASES, AND OF KINDRED TERMS, ETYMOLOGICAL, HISTORICAL, GEOGRAPHY CAR, AND DISCURSIVE।’
শব্দকোষ এবং তার অনুষঙ্গের এমন বিচিত্র এবং বহুচর্চিল উপস্থাপনা, আমি অন্তত খুব বেশি দেখিনি। গম্ভীর এবং সনাতন অভিধানে এই সংকলনের অধিকাংশ শব্দই খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাওয়া সম্ভবও নয়। অন্যদিকে এমন নানা তল থেকে শব্দ নিয়ে অভিযান, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, উদ্ধৃতি- কখনও কোনও অভিধানের আওতায় পড়ে না। তথ্যবহুল এই শব্দকোষের মুখবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, ইংরেজি ভাষায় ভারতীয় ভাষার শব্দ ঢুকতে শুরু করেছে প্রথম এলিজাবেথের রাজত্বকালের শেষদিক থেকেই। তারা প্রধানত বস্ত্র-ব্যবসা সংক্রান্ত। এছাড়া ভারতভ্রমণকারীদের বিবরণের মাধ্যমেও বহু শব্দ ঢুকেছে। তবে, 'হবসন-জবসন' সংকলনে ইঙ্গ-ভারতীয় শব্দই নয়, উর্দু, নেপালি, বর্মী, সিংহলি, তুর্কি, জাপানি, চিনা, মালয়ালি, ওড়িয়া প্রভৃতি নানা শব্দ প্রবিষ্ট হয়েছে। ভারতবর্ষ, পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং প্রতিবেশী দেশের শহর, ধর্মীয় রীতিনীতি, তার ইতিহাস, পরব-পার্বণ সব বিষয়ের টীকা-ভাষ্য পরিচিতি সযত্নে একত্র করা করা আছে।
যদি বইটি কারও হাতে পড়ে, আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করব 'সতী', 'চা' এবং 'ভাঙ' বিষয়ক এন্ট্রি দেখতে। আমার তো চোখ কপালে উঠে গেছে এসব পড়তে পড়তে। বিপুলা এ পৃথিবীর সত্যিই কতটুক জানি আমরা? ক্যাপ্টেন হ্যাডক তো ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে সৈন্যদের নিয়ে ঢুকলেন কলকাতা শহরে। তারপরে কী করলেন? ‘হবসন-জবসন' সেই হদিশ দিতে পারেনি।
আরও পড়ুন- নগরপথের উজ্জ্বলতম পথিক ভাস্কর চক্রবর্তী
২
কলকাতা শহরের পথে-পথে আজও হেঁটে বেড়াই। শহরের উত্তরদিকে আদত উনিশ শতকের গন্ধমাখা এক অঞ্চলে আমার বসবাস। এই জীবদ্দশায় গত শতক থেকে আজ পর্যন্ত কত ধরনের পরিবর্তন দেখলাম। এখন আমি পঞ্চাশের কোটার শেষদিকে পৌঁছেছি। ছেলেবেলায় যেসব মানুষ, যেসব বাড়ি, যেসব পরিচিত আড্ডাখানা ছিল, কাজকর্ম, পত্রিকা, দোকান, রেস্তোঁরা, বাস-ট্রাম, আওয়াজ, গন্ধ, স্বাদ, ছায়াছবি ছিল তার সত্তরভাগ অন্তর্হিত। কালের স্বাভাবিক নিয়মে আমিও ধীরে ধীরে কারও স্মৃতির উপাদান হয়ে যাব। আমার বাবার অবিস্মরণীয় বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজন, নিজের বন্ধুমহলের উজ্জ্বল কুশীলবরা, আমার মাস্টারমশাইরা, দিদিমণিরা, ছাত্রছাত্রীরা, নানাবয়সের প্রেমিকা এবং দুর্বলতারা, আকস্মিক কত ঘনিষ্ঠতা, আলাপ, গান এবং উল্লাস-বেদনা, কত স্থান-কাল-পাত্র এক একটি টানে দপ করে দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। যেন অপার্থিব কোনও মিছিল। নিজেকেও দেখতে পাই। ঝোড়ো হাওয়া এসে তছনছ করে দেয় বর্তমান। যে বাড়িতে জন্মেছি, কপালজোরে সেখানেই থাকি। এই নগর, এই কলকাতা আমার নাড়িতে-রক্তে-স্নায়ুতে মিশে গেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে থাকি। বহু জন্মান্তর আমারও হয়ে গেল।
এই ধারাবাহিকে কথা ছিল বাস্তব থেকে আশমানে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গে ঢুকে পড়বে। হলো কই? আমার জীবনের মতোই শহরের গলি-রাজপথ, তার ইতিহাস-জনবৃত্তে ঘুরে চললাম আর ডানা খুঁজতে খুঁজতে আরও দুর্ভেদ্য সব ব্যূহে ঢুকে পড়তে লাগলাম। নগরবৃত্তে গোলকধাঁধার মতো বা নাগরদোলার মতো, ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়, শহরের সঙ্গে এই অসম প্রেমই অশ্বশক্তি হয়ে মজ্জায় ঢুকে পড়েছে আমার।
দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ের আত্মজীবনীর কথা মনে গড়ে গেল। কৃষ্ণনগরের আদি বাসিন্দা। পুত্রের নাম স্বনামধন্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ১৮৭৫ সালে তাঁর' আত্মজীবনচরিত' প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণনগরের লোকের চোখে কি কলিকাতা বা কলকাতা একটু অস্বস্তির জায়গা হয়ে দেখা দিত?
৩
কার্তিকেয়চন্দ্র (১৮২০-১৮৮৫) স্মৃতিচারণে লিখছেন,
"তৎকালে মফস্বলের যে সকল লোক প্রথমে কলকাতায় যাইতেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেরই অজীর্ণ রোগ হইত। এ পীড়াকে 'লোনা-লাগা' কহিত! ...দুই মাসের মধ্যে আমার অরুচি জন্মিল এবং ক্রমশঃ বল গেল। মৃৎপাত্রে অধিক দিন লবণ থাকিলে যেমন তাহা জীর্ণ হইয়া যায় আমার শরীর ঠিক সেইরূপ হইল। অত্যল্প আঘাতেই আমার গায়ের ত্বক উঠিতে লাগিল। শরীরের বর্ণ শ্বেত হইয়া গেল। ঔষধ সেবনে কোনও উপকার না হওয়াতে নৌকাযাত্রা করিলাম। পরদিন হইতেই শরীর সুস্থ হইতে আরম্ভ করিল।"
আমরা, আজীবন কলকাতাবাসীরা এই সমস্যা হয়তো ঠিকমতো আন্দাজ করতেই পারব না। মহানগর থেকে কেউ দূরে এসে ভালো থাকেন, আবার কতশত মানুষের মহানগরেই স্থিতি। আগন্তুক হিসেবে মহানগরে ঢুকেই শান্তি। তখন পূর্বাশ্রমে ফিরে যেতে মন চায় না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রেই অনেকটা তেমন হয়েছিল। ব্যক্তির কথা শুধু বলছি কেন, কত সম্প্রদায়, কত গোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছে। ফিরে যেতে পারেনি নিজের উৎসভূমিতে। বঙ্গদেশের নানা জেলার মানুষ এসেছে একদিকে আবার অন্য রাজ্যের মানুষ এখানে এসেই পেয়েছে স্থিতি। উনিশ শতকের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে বিদেশি মানুষ, অন্য প্রদেশের মানুষ নানা কারণে কলকাতায় এসেছিলেন। পাল্কিচালক হিসেবে উড়িষ্যা প্রদেশের মানুষজন প্রথম আসতেন কলকাতায়। পরবর্তীকালে এঁদের অনেকেই সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে পাচক ঠাকুর হিসেবে যোগ দিতেন। সেই সময়ের এক ইতিহাস শুনিয়েছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৬৯-১৯৪৬) তাঁর 'কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা' পুস্তকে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, মেধাবী, বিশ্বভ্রমণকারী এই বহুবিদ্যা পারদর্শী ব্যক্তিত্ব নরেন্দ্রনাথ দত্ত (বিবেকানন্দ) এবং ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মধ্যম ভ্রাতা। নরেন্দ্রনাথ বলছেন উনিশ শতকের কাহিনি। সবটাই চমৎকার, তাঁর সিদ্ধান্তটিও প্রণিধানযোগ্য।
"একপ্রকার মুরুব্বী দেখা দিয়েছিল যাহাদিগকে ভোজপণ্ডে বলিত অর্থাৎ যাহাদের ভোজন পণ্ড করিবার কাজ ছিল। তাহারা নিমন্ত্রিত হইয়া লোকেদের বাড়ি যাইয়া তাহাদের বংশের কোনো কুৎসা রটনা করিয়া সব পণ্ড করিত। মুরুব্বী না খাইয়া খাইলে অপরেও খাইত না। এইরকম দু-চারটি ব্যাপার হওয়ায় পাচক-ব্রাহ্মণের প্রথা উঠিল। তাহার রন্ধন তেমন করিতে না পারিলেও ভোজপণ্ডেকে গালাগালি দিতে বিশেষ পটু ছিল। ভোজপণ্ডেরা দু-চার জায়গায় অপমানিত হওয়াতে তাহাদের প্রতাপ কমিয়া গেল, পরে লোপ পাইল। কিন্তু দুঃখের বিষয় গিন্নীদের হাতের সোনামুগের ডাল, শাকের ঘন্ট, মোচার ঘণ্ট উঠিয়া গেল। কলিকাতায় গিন্নীদের ভোজ-রন্ধন প্রথা উঠিয়া যাওয়ায় এই একটি কারণ। পূর্ববঙ্গের মেয়ের উৎকৃষ্ট রন্ধন করিতে পারে, সেখানে পাচক-ব্রাহ্মণের প্রতাপ নাই।"
এইসব কথা লিখতে লিখতেই মনে পড়ল আমার বন্ধু ভিকির কথা। বিডন স্ট্রিটের মোড়ে, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কোণ ঘেঁষে 'পঞ্জাবি হিন্দু হোটেল'। বংশানুক্রমে এই ভোজনালয় শিখ-পঞ্জাবি পরিবার চালিয়ে যাচ্ছেন। ভিকির দাবি হলো, এই রেস্তোরাঁটি কলকাতার প্রথম শিখ-পঞ্জাবি পরিচালিত ভোজনালয়, শুরু হয়েছিল ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। শুধু শিখ বা পঞ্জাবিরাই নন, আরও নানা প্রদেশের মানুষ বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়ে স্থায়ীভাবে এ শহরের বাসিন্দা। এঁদের মধ্যে সম্ভবত সবথেকে বেশি সংখ্যায় আছেন মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মানুষ। ১৯৮৫ সালের জনগণনার প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ওই সময়ে কলকাতায় রাজস্থানী জনবৃত্ত ছিল প্রায় ৪০ হাজার। মারাঠি ৮২৭ জন। গুজরাতি ৩ হাজার। তামিল ২৩০০ জন।
আরও পড়ুন- আলিপুর চিড়িয়াখানায় দুপুর কাটাতেন জীবনানন্দ
নানা ধরনের অজস্র মানুষের তরঙ্গ এসে কলকাতা মহানগরের আশ্চর্য বাস্তবকে নকশাদার করে তুলেছে। শহরের একপ্রান্তে আবার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়। তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বর্তমান। এছাড়াও কলকাতায় আছে উর্দুভাষী অবাঙালি মুসলমান সমাজ, আছেন ইরানি, পার্সি, তিব্বতি, নেপালি, সিংহলি মানুষ। কিছু কিছু চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের চোখের সামনে। কালীঘাট ট্রামডিপোর পাশে গ্রিক চার্চ এবং ফুলবাগান মেট্রো স্টেশনের পাশে গ্রিক সিমেট্রি কত অজানা ইতিহাস বুকে নিয়ে কাল অতিবাহিত করে চলেছে। ব্রেবোর্ন রোডে এবং এজরা স্ট্রিটে ইহুদিদের উপাসনাগৃহ বা সিনাগগ। চার্চ বা গির্জা এবং মসজিদ তো কলকাতার নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। মনে আছে, বেলেঘাটা অঞ্চলে একদিন আই.ডি হাসপাতালের কাছে হঠাৎ দেখেছিলাম জরাথ্রুষ্ট অনুগামীদের জন্য নির্ধারিত পার্সিদের 'টাওয়ার অব সাইলেন্স'। কাকে বলে 'টাওয়ার অব সাইলেন্স', যার অন্য নাম 'দাখ্সা’? বেলেঘাটার এই টাওয়ার অব সাইলেন্স' বা নীরবতার গম্বুজ তৈরি হয়েছিল ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি। এই নীরবতার গম্বুজের শীর্ষে পার্সি জনগোষ্ঠীর অগ্নিউপাসক রীতি অনুযায়ী মৃতদেহ রাখা হয়, যাতে চিল, শকুন বা অন্য কোনও প্রাণী সেই দেহ ভোজন করে নিজেদের তৃপ্ত করে। এক অর্থে জরাথ্রুষ্টীয় ধর্ম বিশ্বাসীরা এভাবেই মৃত্যুর পরও মরদেহ দিয়ে পশুপাখিকে সেবা করে থাকেন।
৪
আমি একসময় কলকাতার নানা অঞ্চলে, এই ধরনের আনাচকানাচে লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক মুহূর্ত খুঁজতে বেরোতাম। সেই সূত্রেই জেনেছিলাম, কলেজ স্কোয়ারের পিছনে মহাবোধি সোসাইটি এবং শ্রীধর্মরাজিকা বিহার-এর অতীত কথা। সিংহলি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর উপাসনালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অনাগরিক ধর্মপাল (১৮৬৪-১৯৩০)। এই গভীর চিন্তক বিবেকানন্দের সঙ্গে শিকাগো ধর্ম মহাসভায় বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে গিয়েছিলেন। দু'জনের প্রগাঢ় বন্ধুতা ছিল। কলকাতা মহাবোধি সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। তক্ষশিলায় খননকার্য চালিয়ে ভগবান বুদ্ধের পবিত্র অস্থি পাওয়া গিয়েছিল। সেই অস্থি একটি পাত্রে ভরে নগ্নপদে শোভাযাত্রা করে মহাবোধি সোসাইটিকে অর্পণ করেন স্বয়ং আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন অ্যানি বেসান্ত। বুদ্ধদেবের পূতাস্থিও সোসাইটিতে কালো মার্বেল পাথরে তৈরি পাত্রে রাখা আছে।
আরও পড়ুন-বাবা কসাই, জন্ম যৌনপল্লী! কবি নামদেও ধসাল এক বেপরোয়া বিস্ফোরণ
কলকাতার পথে-পথে এমন অনেক ইতিহাস লুকিয়ে আছে। বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মবিশ্বাস আর রীতি-আচারের পরস্পরসংলগ্ন অবস্থান শহরটাকেই একটা রংদার বহুমাত্রিক ক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রসঙ্গত আমার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার মা, প্রয়াত প্রতিমা মজুমদার ২০১০ সালে তাঁর বাহাত্তর বছর বয়সে উর্দু শিখতে শুরু করেন কলকাতার উর্দু আকাদেমিতে। সপ্তাহে তিনদিন সন্ধেবেলা ক্লাস করতেন লাঠি হাতে। ওঁদের উর্দু শিক্ষিকা ছিলেন তবসসুম মির্জা। বছর পঁয়ত্রিশের দায়বদ্ধ শিক্ষিকা। মা অচিরেই তাঁর সহপাঠী এবং শিক্ষিকার সঙ্গে মেতে উঠলেন। সহপাঠীরা কেউ কেউ এবং সেই শিক্ষিকাও অবসরে আমাদের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে আড্ডা দিতে মাঝেমধ্যেই আসতেন। আমি অনেকবার মা-কে আনতে যেতাম। মায়ের অসম বয়সি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতাম। দু'বছর ক্লাস করার পর অল ইন্ডিয়া পরীক্ষায় ডিস্টিংশন সহ মা উর্দুভাষায় ডিপ্লোমা অর্জন করেন। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৬ অক্টোবর মা চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। মায়ের খাতা, বই, নোটস, সার্টিফিকেট সবই পড়ে আছে। বাংলা-উর্দু, ইংরেজি-উর্দু অভিধানও।
সেই সময় আমি উর্দুভাষী মুসলমান সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, জীবনাচরণের খুঁটিনাটি, বেশ কিছু সামাজিক বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মচিন্তার ঐক্য এবং পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত হই। উল্টোদিকে করিম বক্স লেনে বেশ কয়েকবার সেই সম্পর্কে জানতে গেছি। মা একবার পড়ে শুনিয়েছিলেন গান্ধিজির লেখা একটি চিঠি। গান্ধিজি খুব ভালো উর্দু জানতেন। তিনি কবি ইকবালকে মুগ্ধতা জানিয়েছিলেন চিঠিতে। মায়ের মুখে শোনা সেই তর্জমা আজও কান পাতলে শুনতে পাই। আমার বাড়ি থেকে তিন মিনিট হাঁটলে, বেথুন স্কুলের পিছন দিকে একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে ১৮২৬ সালে দিল্লি থেকে এসে বাস করতেন কবি গালিব। 'সফর-এ-কলকাতাহ' সেই বসবাসের অনুপুঙ্খ নিয়ে লিখিত। শ্রীমতী সংহিতা চক্রবর্তী এবং শ্রী দেবদত্ত গুপ্ত এই তথ্য আমাকে কিছুদিন আগে জুগিয়েছেন। ওই বাড়ির থেকে দশ-বারো কদম উত্তরে একটি একতলা বাড়ির গায়ের ফলকে লেখা আছে- 'এই বাড়িতে সন্ধ্যা পত্রিকার সম্পাদক, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় দীর্ঘদিন থাকতেন'। গালিব, ব্রহ্মবান্ধব আর ভিকি- মহানগরের মায়াবী সহাবস্থান!