মোদি ঘনিষ্ঠতার ছাপ স্পষ্ট, প্রধান বিচারপতি কি বিশ্বাসভঙ্গ করলেন?
Chief Justice of India: ভারতের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই দৃশ্য দেখা গেল, একজন কর্মরত প্রধান বিচারপতি, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করেছেন একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।
সময়টা ভুয়ো তথ্যের, সময়টা ছবি আর ভিডিওর। লেখা পড়া বা তা পড়ে অনুধাবনের সময় এটা নয়। ফলত যা হবার তাই হচ্ছে, মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। মিথ্যে ভাবছেন, মিথ্যে ছড়াচ্ছেন এবং মিথ্যে বিশ্বাস করছেন। ভয় হচ্ছে এমন একটা সময় আসতে চলেছে, যেখানে আর কোনও সত্যিকেই বিশ্বাস করতে সমস্যা হবে। আজকের আরজিকরের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। একদিন শোনা গেল, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে নাকি আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরিবারের কোনও একটি যোগসূত্র আছে। একটি সরকারি অনুষ্ঠানের ছবি দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হল, বোঝাপড়া আছে বলেই তিলোত্তমার বিচার নিয়ে এত টালবাহানা হচ্ছে। তারপরে সর্বোচ্চ আদালতের দফতর থেকে যখন জানা গেল যে বিষয়টার সত্যতা নেই, তখন ক্ষান্ত দিলেন মানুষ। যাঁরা ভাবছিলেন, এই যোগসূত্রের কারণেই আরজিকর কাণ্ডের বিচার পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁদের জন্য আরও চমক অপেক্ষা করেছিল। দেখা গেল, সেই সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি নিজের বাড়ির গণেশ পুজোর অনুষ্ঠানে অভ্যর্থনা করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এবং তিনি এসে বিচারপতির পাশে দাঁড়িয়ে আরতি করছেন। সমস্ত সেটিং, সমস্ত বোঝাপড়া সব কিছু গেল গুলিয়ে ।
অনেকে বলতেই পারেন এই বিষয়টি একটি ব্যক্তিগত বিষয় এবং এর সঙ্গে রাজনীতির যোগসূত্র খোঁজা অনুচিত, কিন্তু তা-ও কিছু প্রশ্ন উঠে আসে, যা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। একজন প্রধান বিচারপতি বা আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন নির্বাচিত হয়ে শপথ নেন, সেদিন তাঁরা
বলেন যে তাঁরা সত্য এবং ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে ভারতের সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করবেন। তাঁরা বলেন, যে কোনও ভয় বা আনুকুল্যের জন্য তাঁদের দায়িত্ব পালন থেকে নিজেদের বিরত করবেন না। যে ছবি প্রধানমন্ত্রী নিজে তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে দিয়েছেন, তা দেখে পরিষ্কার
বোঝা যায়— তিনি অতিথি হিসেবেই এসেছিলেন। সেখান থেকেই প্রথম প্রশ্ন উঠে আসে, আমাদের প্রধান বিচারপতি কি ভারতের সংবিধানের প্রতি সততা দেখালেন? ১৯৯৪ সালে এস আর বোম্মাই বনাম ইউনিয়ন সরকারের একটি মামলায়, দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল, ভারতের সংবিধানের অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ এবং “The state by itself, shall not espouse or establish or practice any religion”। অর্থাৎ, ভারত রাষ্ট্রের কোনও নিজস্ব ধর্ম নেই। ওই একই রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছিল, “every individual person will have, in that order, an equal right to freedom of conscience and religion”, অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিকের সম্পূর্ণ অধিকার আছে, ব্যক্তিগত ধর্মাচারণের। সুতরাং সেই বিষয় নিয়ে কেউ বলতেই পারেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি তো ব্যক্তিগত ধর্মাচারণই করেছেন, তাহলে অসুবিধা কোথায়? আসলে অসুবিধাটা হলো, এই যে সর্বসমক্ষে একটি বিশেষ ধর্মাচারণের ছবি এবং ভিডিও দেখা গেল, তা কি কোথাও তাঁদের প্রথম শপথকে উল্লঙ্ঘন করল না?
আরও পড়ুন: ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের গণেশপুজোয় মোদি! ভারতের প্রধান বিচারপতি আদৌ নিরপেক্ষ?
ভারতের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই দৃশ্য দেখা গেল যে একজন কর্মরত প্রধান বিচারপতি, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করেছেন একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এবং তার জন্য চিত্রগ্রাহক থেকে শুরু করে ভিডিওগ্রাফার সবাই উপস্থিত। এই ছবি তোলা এবং
তা সংবাদ বা সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া হবে, তা জেনে বুঝেই এই আয়োজন যে করা হয়েছিল, এবং কোনও ভাবেই তা মানুষের অগোচরে রাখার চেষ্টা হয়নি, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাঁদের দুজনেই চেয়েছিলেন এই ছবি যেন মানুষ দেখে। তাঁরা যেন চাইছিলেন,
তাঁদের এই সখ্যতার দৃশ্য সারা দেশ প্রত্যক্ষ করে। অর্থাৎ খোলাখুলি তাঁরা যে সংবিধানের অবমাননা করছেন, তা-ও কি তাঁরা দেখাতে চেয়েছিলেন, সেই প্রশ্নও উঠেছে। কিছুদিন আগেও কিন্তুএই প্রধান বিচারপতিকে আমরা দেখেছি গুজরাটের দ্বারকা মন্দিরে যেতে। তখনও বেশ কিছু ছবি আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, সেই সময়ে জেলার আইনজীবীদের তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, এমনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে ‘বিচারের ধ্বজা’ উড্ডীন থাকে। খেয়াল রাখতে হবে, এই ‘ধ্বজা’ শব্দটি কিন্তু হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে প্রধান বিচারপতি সংবিধানের শপথ নিয়েছেন, সেই বিচারপতি কি পদে পদে সংবিধানের অন্যতম চালিকা শক্তিরই অবমাননা করছেন না? দু’জন মানুষের গণেশ পুজোর আরতি করা, একটি ব্যক্তিগত ধর্মাচারণ। কিন্তু সেই দুই ব্যক্তি যদি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হন, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় কি সরাসরি ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেই গেছে? তাহলে সেই ১৯৯৪ সালের মামলার রায়ে যে বলা হয়েছিল, "The Constitution does not recognise, it does not permit, mixing religion and state power. Both must be kept apart”, অর্থাৎ ধর্ম এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা কখনওই মিলেমিশে থাকতে পারে না। তবে সেই রায় কি মাঠে মারা গেল?
যদি ধরেও নেওয়া যায়, এই গণেশপুজো সাংবিধানিক ভাবে স্বীকৃত একটি বিষয়। তাহলেও প্রশ্ন ওঠে, নিমন্ত্রিতদের তালিকায় কেন রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা অন্যান্য বিচারপতি, এমনকী বিরোধী দলনেতা নেই? সুপ্রীম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এই প্রশ্নটিই তুলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতির বাবা একসময়ে প্রধান বিচারপতি ছিলেন,
তিনিও তো কোনওদিন তাঁর নিজের বাসগৃহে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানি। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের কাছে কী বার্তা গেল? তাঁরা কি আর দেশের প্রধান বিচারপতি বা বিচারব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখতে পারবেন? এমনিতেই গত দশ বছরে তাঁরা সঙ্কুচিত, কুন্ঠিত হয়ে বসবাস করেন, আতঙ্কে থাকেন। কখনও যদি তাঁরা কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, তাহলে
তাঁদের ঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হতে পারে রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা, এরপরেও কি আমরা তাঁদের প্রবোধ দিতে পারবো, দেশে এখনও সংবিধান অবশিষ্ট আছে, ভরসা রাখতে হবে তার উপরে। তাঁরা শুনবেন তো আমার বা আমাদের কথা?
আরও পড়ুন: আরজি কর: কেন এগিয়ে এলেন চিফ জাস্টিস চন্দ্রচূড়? কখন হস্তক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্ট?
গত নির্বাচনে অনেকেই হয়তো আন্দাজ করতে পারেননি, ‘সংবিধান বাঁচাও’ বিরোধীদের অন্যতম রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠবে। বিরোধী জোট কিন্তু বারেবারেই বলে এসেছিল, ওই লোকসভা নির্বাচন ভারতের সংবিধান বাঁচানোর নির্বাচন। শাসকদলের বহু নেতাকর্মী বলেছিলেন, একবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তাঁরা সংবিধান বদলে দেবেন। সেই ভয় থেকেই হয়তো অনেকে শাসক বিজেপিকে
হারানোর কথা ভেবেছেন। আজকের সময়ে ছবি কথা বলে। যেদিন আরএসএসের দফতরে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী উপস্থিত হন, সেই ছবি যেমন একটা বার্তা দেয়, তেমনি বাবরি মসজিদ মামলার রায় দেওয়ার পরে সমস্ত বিচারপতিদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো ছবিও একরকম বার্তা দিয়েছিল। ফলে স্বাভাবিক প্রধান বিচারপতির বাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিত হওয়া এবং গণেশ পুজোয় আরতি করার ছবিও যে কথা বলবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! প্রতিটি সংখ্যালঘু মানুষ,প্রতিটি সংবিধান মেনে চলা মানুষও ভাবতে বসবেন তাহলে আম্বেদকরের সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা কি আদৌ আছে? প্রধান বিচারপতিকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তিনি তাঁর বিবেকের কাছে পরিষ্কার তো? তিনি তাঁর নেওয়া শপথের প্রতি দায়িত্বশীল তো? তিনি উত্তর দিতে পারবেন তো?
একদিকে আরজিকরের নৃশংস ঘটনা নিয়ে জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলন চলছে, অন্যদিকে মহিলাদের ‘রাত দখল’ কর্মসূচী আরও জোরালো হচ্ছে, নাগরিকেরা রাতের রাস্তা দখল করছেন, আর অন্যদিকে হাজির হচ্ছে সেটিং অর্থাৎ বোঝাপড়া তত্ত্ব। কার সঙ্গে যে কার সেটিং, কেন্দ্রও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে শুধু এই বোঝাপড়া আছে, না আরও বড় কোনও বোঝাপড়ার সূত্র সেখানে লুকিয়ে, তা বোঝা না গেলেও, একটা কথা ভালোই বোঝা যাচ্ছে যে মানুষ এই চলমান ব্যবস্থা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ। আজকের এই জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন কি পারবে, মানুষের এই আস্থা ফিরিয়ে দিতে?