'জাদু'কে লুকিয়ে রেখেছিলেন রাকেশ রোশন! কুড়ি বছর পর খুলল রহস্যের জট
Indravadan Purohit, Koi Mil Gaya: তবে ইন্দ্রবদন অভিনীত যত চরিত্র, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল জাদু। অথচ সেই চরিত্রের জন্যই তাঁর নাম জানল না কেউ। পরিচালকের নির্দেশেই এই কাজ করেছিলেন ইন্দ্রবদন।
ভিনগ্রহের বাসিন্দারা কি সত্যিই আছেন? এ নিয়ে আমাদের আগ্রহ বা কৌতূহলের কোনও শেষ নেই। যদিও খালি চোখে কোনও দিন এলিয়ন বা ভিনগ্রহী দেখে ফেলেছেন, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে বিশ্বাসে বা তর্কে যা মেলে না, তা সিনেমায় মিলে যাবেই যাবে। নাভিদের এক অন্য পৃথিবীকে দর্শকদের সামনে এনে হাজির করেছিলেন পরিচালক জেমস ক্যামেরন। সেই নীলবর্ণ সব ভিনগ্রহীরা মন টেনেছিল আপামরের। কিন্তু এর আগে কি এলিয়ন দেখেননি দর্শক? আলবাত দেখেছে। ডিসি-র 'সুপারম্যান' সিরিজে ক্রিপ্টোনিয়ানদের দেখেছে। মার্ভেলে ভয়ঙ্কর চিতৌরি সেনাকে দেখেছে। এই যে 'অ্যাভেঞ্জার্স' সিরিজের সিংহভাগ জুড়ে থাকা থর এবং লোকি, তাঁরাও কি এক অর্থে ভিনগ্রহী নন। যদিও গল্প জুড়ে তাঁদের পরিচয় দেবতা বলে, তাঁরা অ্যাসগার্ডের বাসিন্দা। কিন্তু সে-ও ভিনগ্রহ বই তো নয়। হাজার একটা হলিউডি সিনেমায় ভিনগ্রহীদের সঙ্গে মুলাকাত হয়েছে দর্শকদের। তবে ভারতীয় দর্শকের কাছে তাদের চেয়ে অনেক কাছের এলিয়েন ছিল অন্য কেউ।
আরও পড়ুন: চা খেতে ডেকেছিলেন খোদ দাউদ ইব্রাহিম! ঋষি কাপুরের বয়ানেই স্পষ্ট বলিউডের মাফিয়া যোগ?
২০০৩ সালে বলিউডের প্রথাগত সিনেমার জগতে এক্কেবারে ছকভাঙা এক গল্প নিয়ে হাজির হয়েছিলেন পরিচালক রাকেশ রোশন। আত্মপ্রকাশ করল বলিউডের সাই-ফাই ছবি 'কোই মিল গ্যায়া'। এক নিমেষে দর্শকের মনপ্রাণ জয় করে নিল সেই ছবি। হৃত্বিক-প্রীতি জিন্টার রসায়ন, মিষ্টি মিষ্টি গান সব কিছুকে ছাপিয়ে দর্শকের মনে আসন পেতে বসেছিল আকারে একরত্তি এলিয়নটি। 'জাদু তেরি নজর'-কে ছাপিয়ে অচিরেই দর্শক-শ্রোতা মজল 'জা-দু জা-দু... জা-দু'-র মিষ্টি সুরে। নীল রঙের ছোট্ট দেহ, ড্যাবড্যাবে চোখ, পরনে হুডি কিংবা বস্তা, সব মিলিয়ে এক আদুরে ছবি যেন বসে গেল দর্শকের হৃদয়ে। তার কাছে এসব অবতার, ক্রিপ্টোনিয়ানস সব কোথায় লাগে! ভিনগ্রহীদের এক দেশীয় প্যাকেজ ততদিনে হাতে পেয়ে গিয়েছে হিন্দুস্তান। যে শুধু আশ্চর্য কাজকর্মই করে তাই নয়, আশ্চর্য শক্তিও উপহার দিয়ে যায় রোহিতের মতোই যাঁরা পিছিয়ে পড়া, কিন্তু আদতে ভালোর দিকে, তাঁদের জন্য। যার ছোঁয়ায় মধ্যবিত্ত 'ভ্যাবলা'-ও হয়ে যায় স্ট্রিট স্মার্ট, চকচকে।
ছবি জুড়ে বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীর ভিড়। রেখা থেকে শুরু করে হৃত্বিক, প্রীতি। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে এক গাদা কচিকাচা, তারাও কম যায় না কেউ। কিন্তু সে সমস্ত কিছু ছাপিয়ে দর্শকের মন পড়ে রইল মহাকাশ থেকে নেমে আসা ওই তুলোর পুঁটুলির মতো ভিনগ্রহীর দিকে। স্পেশাল এফেক্টস, অভিনেতা তুচ্ছ হয়ে গেল সব। থেকে গেল 'জাদু'। একে জাদু বলবেন না তো কী-ই বা বলবেন বলুন! তবে ছবির অন্যান্য চরিত্রদের সঙ্গে দর্শকদের যত ভালো করে আলাপ হল, ততটা লোকে চিনল না জাদুর ভূমিকায় থাকা অভিনেতাকে। অনেকে হয়তো ভেবেই নিলেন, কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার করেই হয়তো চরিত্রটিকে দর্শকদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন ছবিনির্মাতা। আজকের দিনে হলে বোধহয় তা খুব একটা কঠিনও হত না। কিন্তু 'কোই মিল গ্যায়া'-র ক্ষেত্রে 'জাদু'-র ওই পোশাকের পিছনে ছিলেন একজন জলজ্যান্ত অভিনেতা। এবং তিনিও হিন্দি রূপোলি পর্দার যথেষ্ট জনপ্রিয় মুখ। অথচ তাঁর কথা জানা হল না প্রায় কারওরই। তবে এই আড়াল যে এমনি এমনিই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তা কিন্তু নয়। এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে অন্য গল্প। জানা যায়, ছবির পরিচালক রাকেশ রোশনই নাকি চাননি জাদু-র ভূমিকায় থাকা অভিনেতাকে সামনে আনতে। তাতে জাদু চরিত্রটি জুড়ে যে রহস্য ও রোমাঞ্চের আড়াল গড়ে উঠেছিল, তাতে জল পড়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা করেই বোধহয় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সিনিয়র রোশন।
বলিউডে তাঁর পরিচয় ছোটে উস্তাদ নামে। পোশাকি নাম ইন্দ্রবদন পুরোহিত। বলিউডের যথেষ্ট চেনা মুখ তিনি। নয় নয় করে তিনশোর কাছাকাছি ছবি রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। চুটিয়ে অভিনয় করেছেন টিভিতেও। 'বাল বীর', 'ডুবা ডুবা'-র মতো বহু সিরিয়ালেই দেখা গিয়েছে তাঁকে। জনপ্রিয়তম সিরিয়াল 'তারক মেহেতা কা উল্টা চশমা'-তেও ধরা দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালে এই রঙচঙে দুনিয়ায় পা রাখেন ইন্দ্রবদন। আর ফেরা হয়নি। 'নাগিনা', 'ভিরানা', 'বোল রাধা বোল', 'দরার'-এর মতো একাধিক বলিউড ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। এমনকী হলিউডের ফ্যান্টাসি অ্যাডভেঞ্চার সিনেমা লর্ড অব দ্য রিংসেও দেখা গিয়েছে ইন্দ্রবদনকে।
তবে ইন্দ্রবদন অভিনীত যত চরিত্র, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল বোধহয় জাদু। অথচ সেই চরিত্রের জন্যই তাঁর নাম পর্যন্ত জানল না কেউ। পরিচালকের নির্দেশেই এমন আড়াল নিয়ে রইলেন ইন্দ্রবদন। কারণ জানতে চাননি তিনি কখনও। প্রচারের আলোর উল্টোদিকেই নিরুত্তাপ থেকে গিয়েছেন দুর্দান্ত এই অভিনেতা। অথচ চাইলে এমন জনপ্রিয়তম একটা চরিত্র তাঁকে এনে দিতে পারত আরও একটু জনপ্রিয়তা, আরও একটু প্রচার। কিন্তু পরিচালকের অবাধ্য হয়ে তেমন কিছুই করেননি তিনি।
জানা যায়, ইন্দ্রবদনকে নেওয়ার আগে জাদু চরিত্রের জন্য চল্লিশ-পঞ্চাশ জন অভিনেতার অডিশন নিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য প্রাথমিক ভাবে তাঁদেরই একজন ছিলেন ইন্দ্রবদন। তবে খাটনিতে কোথাও এতটুকু ত্রুটি রাখেননি অভিনেতা। চরিত্রটির জন্য প্রায় কয়েক কিলো ওজন ঝরিয়ে ফেলেন তিনি। মেনে চলতেন কড়া ডায়েট। ছবিতে জাদুর পোশাকখানা ডিজাইন করেছিলেন জেমস কালনার ও লারা নামে অস্ট্রেলিয়ার এক দম্পতি। জাদুর ওই মুখোশটি নাকি এত ভারী হত যে, প্রতিবার শুটিং শেষ করেই এমন শ্বাসকষ্টের মধ্যে পড়তেন ইন্দ্রবদন যে প্রতিবারই কৃত্রিম ভাবে অক্সিজেন নিতে হত অভিনেতাকে। একেকটা সিন শুট করতে সময় লেগে যেত প্রায় ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা। এরপর হাত-পা এবং চোখের তালমিলে সময় লেগে যেত আরও কিছুটা। সব মিলিয়ে সহজ ছিল না ব্যাপারটা। রিটেকের পর রিটেক, শরীরের রক্ত-জল সমস্ত কিছু শুষে নিত ওই একটা চরিত্র।
আরও পড়ুন: ঘরপালানো গানক্ষ্য়াপার ভক্ত স্বয়ং হৃত্বিক রোশন! শাকিলের গল্পটা হাজার ছেলেমেয়েকে স্বপ্ন দেখাবে
এই যে এত পরিশ্রম, মাথার ঘাম পায়ে ফেলা! অথচ কেউ তাঁকে চিনলই না ওই চরিত্রের জন্য। দেখতে দেখতে কুড়ি বছর পার করে ফেলল 'কোই মিল গ্যায়া' ছবিটি। ছবির কচিকাঁচারা বড় হয়ে নায়ক-নায়িকা হয়ে গিয়েছেন। ছবির নায়িকা কার্যত বলিউড থেকে অবসর নিয়েছেন। তবে আজও একই রকম ভাবে জনপ্রিয় 'জাদু' চরিত্রটি। তার সংলাপ থেকে হাঁটাচলা, আজও আলোচনায়। জাদুর ভূমিকায় থাকা ওই বিস্মৃতপ্রায় অভিনেতা ২০১৪ সালে পাড়ি দিয়েছেন না-ফেরার দেশে। জীবনে যে স্বীকৃতি মেলেনি, তা সত্যিই যখন এল, ততদিনে ইন্দ্রবদন হয়তো নিজেই ভিনগ্রহী। অন্য কোনও গ্রহে হয়তো সত্যিই 'জাদু' হয়ে ম্যাজিক করে ফিরছেন! বা অন্য কোনও দুর্বল, কোণঠাসা 'রোহিত'-কে যে তিনি লড়াই করার শক্তি জোগাচ্ছেন না, তাই বা কে বলতে পারে!