চুরি যাচ্ছে চিন্তার সময়! মাথা না খাটানোর রোগে কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন আপনিও?
Thinking Time Reducing: গবেষণা ও চিন্তার কাজে কোনওরকম বাধাবিঘ্ন ছাড়াই পড়া বা কাজে মনোনিবেশ করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সময় প্রয়োজন।
ভিডিও কল, হোয়াটস্যাপ, ভয়েস কল, ই-মেইল, ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুক, টেলিগ্রাম, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ... জীবন এই মুহূর্তে এই ডিজিটাল পরিষেবা ছাড়া ভাবতে পারেন এমন মানুষ হাতে গোনা। ঘুম ভাঙা ইস্তক আমাদের ঘিরে থাকে এই অজস্র ডিজিটাল যন্ত্রপাতি। গোটা বিশ্ব মুঠোয়, হাজার বন্ধু, লক্ষ অনুগামী। আছে, অথচ নেই। দিনের পর দিন আমাদের এই ডিজিটাল নির্ভরতা ক্রমেই এক খাদের পাড়ে নিয়ে আসছে আমাদের। নিজের থেকে নিজেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার অমোঘ মায়া! এই মায়ার ফাঁদে পড়েই মনোযোগ হারাচ্ছে, হারাচ্ছে ধৈর্য, হারাচ্ছে চিন্তা করার সময়। অথচ কিছুক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটছে বিজ্ঞানীদের বা গবেষকদের ক্ষেত্রে। গবেষকদের উৎপাদনশীলতা নাকি বাড়ছে এই মায়ার ফাঁদে থেকেও! তবে, গবেষকরাও চিন্তার সময় কমে যাওয়ার জটিল ফাঁদ নিয়ে চিন্তিত। গবেষকদের উপর এই ডিজিটাল নির্ভরতার নেতিবাচক প্রভাবগুলি নিয়ে কাজ করেছেন কম্পিউটার বিজ্ঞানী ক্যাল নিউপোর্ট, তাঁর সাম্প্রতিকতম বই, স্লো প্রোডাক্টিভিটিতে।
স্লো প্রোডাক্টিভিটি বইটি আসলে নিজের নামটিকেই চ্যালেঞ্জ করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই ডিজিটাল বিশ্বে নানা ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা কমে গেলেও, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম ব্যাঘাত ঘটেছে। এখন আগের চেয়ে বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে এবং অনুদানও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু চিন্তার সময় কমে যাওয়া গুরুতর বিপদ ঘটাচ্ছে গবেষকদেরও। ক্যাল নিউপোর্ট ওয়াশিংটন ডিসির জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন। নিউপোর্ট বলেছেন, গবেষক এবং অন্যান্য চিন্তা-জ্ঞান বিষয়ক কর্মীদের তাঁদের কাজের মান বজায় রাখা এবং মান উন্নত করার দিকে মনোনিবেশ করতে হলে একটু ধীরগতিতে কাজ করতে হবে এবং চিন্তাভাবনা করার জন্য আরও বেশি সময় দিতে হবে। নিউপোর্ট অতিরিক্ত চাপে থাকা শ্রমশক্তি বিষয়ক গবেষণা করছেন। তিনি বলছেন, নতুন যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রচুর সুবিধা রয়েছে। এই প্রযুক্তির কারণেই গবেষণার গতি বেড়েছে।কোভিড-১৯ মহামারীর সময় প্রযুক্তির চরম ব্যবহার দেখেছে বিশ্ব। কিন্তু একইসঙ্গে এই প্রযুক্তি নির্ভরতা আমাদের চিন্তার সময় খেয়ে ফেলছে।
আরও পড়ুন- রিলস দেখছেন সারাক্ষণ! ইনস্টাগ্রাম রিলসের ভয়াবহ দিক জেনে আঁতকে উঠছে বিশ্ব
গবেষণা ও চিন্তার কাজে কোনওরকম বাধাবিঘ্ন ছাড়াই পড়া বা কাজে মনোনিবেশ করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সময় প্রয়োজন। কোনও গবেষণার জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া, পরিকল্পনা করা, তথ্য জোগাড় করা, ফলাফলের মূল্যায়ন করা, সাহিত্য পর্যালোচনা করা এবং অবশ্যই তা লেখা সবটুকুর জন্য নির্বিঘ্ন সময় দরকার। অথচ কোনও কিছু নিয়ে চিন্তা করার বা ভাবার জন্য আলাদা করে সময় দেওয়া বিষয়টাই আমাদের কর্মসংস্কৃতিতে নেই।
নিউপোর্ট চিন্তার সময় বের করাকে তাই অন্ত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন। কী কী করণীয়, সেই তালিকায় কাজের সংখ্যা সীমিত করতেই হবে। গবেষকদের ক্ষেত্রে যে কাজগুলি প্রজেক্ট টিমের সমস্ত সদস্যের নিয়ে করতে হবে, সেই কাজগুলির জন্য সম্পূর্ণ আলাদা সময় রাখতেই হবে। তাহলে আর সেই টিমের সদস্যরা পরে একই বিষয়ে আলাদা আলাদা ইমেল করে যোগাযোগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন না। সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে কাজের স্বচ্ছ বন্টনের সুপারিশ করেছেন নিউপোর্ট। অনেক গবেষণাগারে গবেষকরা খুব সামান্য পরিকাঠামোয় কাজ করেন। সেখানে তারা একজনকেই রিপোর্ট করেন। কারণ আকাডেমিক গবেষণায় তহবিল অত্যন্ত কম। ফলে যথাযোগ্য কর্মীকে। পর্যাপ্ত সংখ্যায় কর্মীকে নিয়োগই করা যায় না।
তবে, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের বিজ্ঞান-যোগাযোগ গবেষক ফেলিসিটি মেলর বলছেন, চিন্তা করার কন্য অনন্ত সময় দেওয়াটাও সম্ভব হয় না। যদি একজন বিজ্ঞানী হিসেব কষে দেখান তিনি আট ঘণ্টা কেবল চিন্তাভাবনাই করেছেন তাহলে বিষয়টা উৎপাদনশীলতার জন্য ক্ষতিকারক। গবেষণা সংস্কৃতি তৈরির জন্য আরও অনেক মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি।
আরও পড়ুন- সোশ্যাল মিডিয়ায় নিম্নমানের কাজকেই এখন দারুণ কাজ বলে মনে করা হয়: ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়
নিউপোর্ট যদিও খুব মূলগত জায়গায় প্রশ্ন তুলেছেন। শুধু বিজ্ঞানের পরিকাঠামো এবং প্রক্রিয়ার উপর নয়, গবেষণার বিষয়বস্তু এবং মানের উপরও কি চিন্তার সময় কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে না? এআই বা অন্যান্য প্রযুক্তিকে কতখানি ব্যবহার করা যাবে তা গবেষকদেরই ঠিক করতে হবে। এই ধরনের প্রযুক্তি কিন্তু গবেষকদের জন্য আরও চিন্তার সময় বাড়াতেও পারে যদি সঠিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। নাহলে এদের বিপরীত প্রভাবও পড়তে পারে।
যোগাযোগ প্রযুক্তি আগামীতে আরও উন্নত হবে। আর মানুষের নির্ভরতাও বাড়বে পাল্লা দিয়ে। গবেষকদের নিজেদের কাজ থেকে বিভ্রান্ত করার হাজারও পথ খুলে যাবে সামনে। তাই বিজ্ঞানের উপর এই প্রযুক্তিগুলির প্রভাব নিয়ে আরও বেশি করে কাজ করা, গবেষণা করা প্রয়োজন। তাত্ক্ষণিক যোগাযোগের বিশ্বে চিন্তার সময়কে কীভাবে সুরক্ষিত করা যায় সেই বিষয়েও গবেষণা দরকার। সকল কাজের পাশাপাশি শুধু চিন্তা করার জন্য দিনের একতা সময় বরাদ্দ করার অভ্যাস শুধু গবেষকদের জন্য নয়, সাধারণ যে কোনও মানুষের আশু কর্তব্য এই ডিজিটাল বিশ্বে। নাহলে শুকনো মস্তিষ্কে কেবলই ডিজিটাল আদানপ্রদান হবে, মানুষ ক্রমেই হারাবে নিজেকে, নিজের থেকেই।