ত্রাসের নাম ডিজিটাল রেপ! নতুন ভারতে কতটা নিরাপদ নারীরা?

‘ডিজিটাল রেপ’ শোনার পরই সকলের মনে হতে পারে, নিশ্চয়ই সোশ্যাল মিডিয়া-সংক্রান্ত অপরাধ। কিন্তু আসলে তা নয়। এই শব্দটির সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার কোনও সম্পর্কই নেই।

ঘটনাক্রম ১

১৬ ডিসেম্বর, ২০১২। সাউথ দিল্লির সাকেতের একটি সিনেমা হল থেকে ‘লাইফ অফ পাই’ সিনেমা দেখে ফিরছিল এক তরুণ-তরুণী। এরপর অটো করে মুনিরকা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছয় তারা। রাত তখন ৯টা। অনেক রাত না হলেও দিল্লির ঠান্ডার কারণে অন্য কোনও পরিবহণ না পেয়ে একটি বেসরকারি বাসে তারা উঠে পড়ে। তখন বাসে চালকের কেবিনে ৪ জন ও বাসের ভেতরে ২ জনকে বসে থাকতে দেখে। বাস এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আসতেই চালকের কেবিন থেকে ৩ জন বেরিয়ে এসে তরুণ-তরুণীকে গালিগালাজ করতে শুরু করে এবং জিজ্ঞেস করে এত রাতে তরুণীকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে? শুরু হয় কথা-কাটাকাটি আর তরুণকে মারধর। তরুণীটি তার সঙ্গীকে বাঁচাতে এলে তাকে বাসের পিছনে ফেলে শুরু হয় তার ওপর এক নৃশংস অত্যাচার। ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, তরুণীর যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়েও দেওয়া হয়। তারপর তাদের বিবস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যায় ধর্ষকরা। এই ছিল নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ড। যে ধর্ষণের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে।

ঘটনাক্রম ২

সাল ২০২২, জুন মাস। নয়ডার বছর ৮১-র এক বৃদ্ধর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ‘ডিজিটাল ধর্ষণ’-এর। ১৭ বছরের এক নাবালিকাকে জোর করে তার যৌন লালসা মেটাত সে। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, মেয়েটির বাড়ির লোকের সঙ্গে তিনি পূর্বপরিচিত। তাঁরা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, তাঁদের মেয়ের সঙ্গে কী নৃশংস খেলা খেলছেন এই বৃদ্ধ। পেশায় স্কেচ-শিল্পী এই বৃদ্ধ দীর্ঘ ৭ বছর ধরে এই অত্যাচার করছেন মেয়েটির ওপর। পারিবারিক বন্ধু হওয়ার কারণে নিজের মা-বাবার কাছে খোলাখুলিভাবে বলতে পারেনি মেয়েটি, তাই সে একদিন সাহস করে নিজের অত্যাচারের ভিডিও এবং অডিও দুটোই রেকর্ড করে রাখে। পরে সময় বুঝে সে তার মা-বাবাকে তা দেখায় এবং পুলিশেও অভিযোগ জানায়। মেয়েটির অভিযোগের ভিত্তিতে ওই স্কেচ-শিল্পীকে অ্যারেস্ট করে পুলিশ।

এই দুই ঘটনার সঙ্গেই আমরা পরিচিত। তাহলে প্রশ্ন হলো, নারীরা কোথায় নিরাপদ? ঘরে-বাইরে, পরিবারে, লোকালয়ে, সমাজে, কর্মক্ষেত্র কোথায় সুরক্ষিত সে? নারীর নিরাপত্তা এখন বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন। এই নিরাপত্তাহীনতার অবসান কীভাবে ঘটবে, এই প্রশ্নের জবাব কেউ জানে না। জনসংখ্যার অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে এই প্রশ্নের উত্থাপন হবেই। নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সমাজের বিভিন্ন পরিমণ্ডলে বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি সমাজে বহুল-আলোচিত; কিন্তু অন্য দেশের সঙ্গে ভারতের অবস্থান তুলনা করে তর্কে জেতা যাবে হয়তো, সমস্যার সমাধান করা যাবে না।

আরও পড়ুন: যৌনাঙ্গে নৃশংস কোপ, তবু যেভাবে বেঁচে থাকে নারীর কামনা

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে, এক বছরেই ভারতে ধর্ষিত হয়েছে প্রায় কুড়ি হাজার শিশু বা কিশোরী। ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যানে তেমনটাই উঠে এসেছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে দেশজুড়ে প্রায় ৩৪ হাজার ধর্ষণের অভিযোগ শুধুমাত্র থানাতেই দায়ের করা হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র ২৭ শতাংশ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মহিলাদের ওপর হওয়া এই অপরাধমূলক ঘটনাগুলো অনেক সময় সঠিকভাবে তদন্ত করা হয় না।

এইসব পরিসংখ্যান ও এই ঘটনাক্রম দেওয়ার কারণ হলো ‘ডিজিটাল রেপ’। অনেকেই হয়তো আজকে এই টার্মটার সঙ্গে পরিচিত নন। কিন্তু ‘ডিজিটাল রেপ’ এর শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে নির্ভয়া হত্যাকাণ্ডর সময় থেকেই, আমরা অনেকেই তা জানি না। দেশজুড়ে নারীদের ওপর শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে দেশের কোথাও না কোথাও একজন নারী, নাবালিকা বা শিশুকন্যা পুরুষের যৌন লালসার শিকার হয়ে চলেছে। যার মধ্যে বেশিরভাগ ঘটনাই থেকে যায় আড়ালে। শুধুই কি ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন, যৌন পল্লিতে বিক্রি করে দেওয়ার মতো ঘটনাও এখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন তো মহিলাদের ওপর হওয়া নির্যাতনের সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হচ্ছে। সম্প্রতি আদালতে মামলা দায়ের হয়েছে এই বিষয়ে যে, বৈবাহিক ধর্ষণ কি অপরাধ? অপরাধের সংজ্ঞাও পাল্টাচ্ছে। এইসব অপরাধের মধ্যে অন্যতম পালের গোদা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ডিজিটাল রেপ’। তাহলে ‘ডিজিটাল রেপ’ কী?

কী এই ডিজিটাল রেপ?
‘ডিজিটাল রেপ’ শোনার পরই সকলের মনে হতে পারে, নিশ্চয়ই সোশ্যাল মিডিয়া-সংক্রান্ত অপরাধ। কিন্তু আসলে তা নয়। এই শব্দটির সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার কোনও সম্পর্কই নেই। অনেকে মনে করেন, ‘ডিজিটাল রেপ’ কথাটির অর্থ হল ডিজিটাল মাধ্যমের দ্বারা কোনও মানুষের পরিচয় নষ্ট করা। সেই ধারণাও ভুল।

ডিজিটাল রেপ হলো কোনও ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া যদি অন্য কোনও ব্যক্তি জোর করে তার গোপনাঙ্গে হাতের আঙুল বা পায়ের আঙুল প্রবেশ করানো। ইংরেজি অভিধানে হাতের আঙুল এবং পায়ের আঙুলকে ‘ডিজিট’ বলে সম্বোধন করা হয়। তাই এই কাজটিকে ‘ডিজিটাল রেপ’ বলে অভিহিত করা হয়।

তবে উপরোক্ত দু'টি ঘটনাক্রমই যে ডিজিটাল রেপ, তা কিন্তু নয়। এর আগেও অনেক ঘটনা ঘটেছে যা এই ধর্ষণের আওতায় পড়ে।

ঘটনাক্রম ৩
২ বছরের একটি কন্যা শিশুকে হাসপাতালে রক্তাক্ত অবস্থায় ভর্তি করা হয়। ডাক্তারি পরীক্ষার পর জানা যায়, তার যোনিপথ ভেঙে গেছে। যদিও সেখানে কোনওরকম সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট বা ধর্ষণের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরে জানা যায় যে, ২ বছরের মেয়েটির বাবা তার যৌনাঙ্গে তার আঙুলের অনধিকার প্রবেশ ঘটাচ্ছেন। পুলিশ মেয়েটির বাবাকে অ্যারেস্ট করলেও ধর্ষণ আইন ৩৭৬ ধারায় তাকে শাস্তি দেওয়া যায়নি।

ঘটনাক্রম ৪
দিল্লিতে এক ৬০ বছরের বৃদ্ধাকে এক অটো ড্রাইভার তার যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। মহিলাটি তার এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিলেন। এই ক্ষেত্রেও অটো ড্রাইভারটিকে শাস্তি দেওয়া যায়নি ৩৭৬ ধারার ত্রুটির কারণে।

কী এই ৩৭৬ ধারা ত্রুটি?
এই উপরোক্ত ঘটনাগুলি ৩৭৬ ধারার ত্রুটি নির্দেশ করে যা প্রধানত ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন বলে পরিচিত। ডিজিটাল রেপের অধীনে ঘটিত অপরাধ মূলত আঙুল, অন্য কোনও বস্তু, বা শরীরের যে কোনও অংশ ব্যবহার করে নারীর সম্মানহানির ঘটনা এই ধারায় অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্ট এই ৩৭৬ ধারায় বদল আনে, যখন তারা এটা জানতে পারে যে, শুধুমাত্র শারীরিকভাবেই নয় অন্য উপায়েও পুরুষেরা নারীর বা শিশুর ক্ষতি করতে পারে। ২০১৩ সালে সমস্ত ঘটনাকে সামনে রেখে তারা ধর্ষণের সংজ্ঞা ও আইনে বদল আনে।

নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী নারীর যৌনাঙ্গ, মুখ, মলদ্বার বা অন্য কোনও অংশে পুরুষাঙ্গ বা বিদেশি বস্তুর অনধিকার বা জোর করে প্রবেশ করানো ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।

যদিও ২০১৩ সালের আগে ভারতীয় আইনে ডিজিটাল রেপ নিয়ে এমন কোনও আইন ছিল না, যা ধর্ষকদের শাস্তি প্রদান করবে। কারণ ২০১৩-র আগে ডিজিটাল ধর্ষণের মতো কোনও শব্দও ছিল না। যুগের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের পদ্ধতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। বেশ কিছু ধর্ষণের রিপোর্টে এটা বেশ স্পষ্টভাবেই তুলে ধরা হয়েছে যে, ধর্ষিত হওয়া নারীদের যারা ধর্ষণ করেছে, ৭০% ক্ষেত্রে তারা নিজের লোক হয়, যেমন, বাবা, দাদা, কাজিন, কাকা ইত্যাদি। ২৯% ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে পরিচিত কোনও মানুষ, যেমন ডেটে গিয়ে দেখা হওয়া, কাজের সূত্রে চেনা-জানা ইত্যাদি। আর ১% ক্ষেত্রে ধর্ষক একজন অচেনা ব্যক্তি হয়।

ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের পর ডিজিটাল ধর্ষণকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করেছে আইন কর্তৃপক্ষ।

 ১. গুরুগ্রামে এক শিশুকে ‘Digital Rape’-এর অপরাধে ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং নগদ ৫০ হাজার টাকার জরিমানা হল পশ্চিমবঙ্গের এক যুবকের। স্কুলবাসের ভেতরেই ডিজিটাল রেপ করা হয় বছরচারেকের এক শিশুকে। তার পরেই ২০১৬-র আগস্ট মাসে গ্রেপ্তার করা হয় ২১ বছরের শম্ভুকে। বিচারক রজনী যাদব তাঁর রায়ে শম্ভুকে POCSO আইনের অধীনে দোষী সাব্যস্ত করে ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজারের জরিমানা ঘোষণা করেন।

 ২. এক মদ্যপ বান্ধবীকে ডিজিটালি ধর্ষণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে তিন বছর, সাত মাস এবং তিন সপ্তাহের জেল এবং এক বছরের নন-প্যারোল মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

৩. স্ট্যানফোর্ড-এর এক ছাত্রকে ৬ মাসের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়। মেয়েটির বিবৃতিতে বলা হয় যে, ডিজিটাল রেপ কতটা জঘন্য ও কতটা ভয়াবহ হতে পারে। এটা এমন পর্যায়ে চলে আসে যে, ধর্ষণ না করেও নারীর মর্যাদা লঙ্ঘন করা যায়। এবং ডিজিটাল ধর্ষণ কীভাবে ধর্ষণের মতো একই প্রভাব ফেলে।

শেষে এটাই বলার যে, উপরোক্ত ঘটনাগুলি ছাড়াও এখনও হাজার হাজার এমন ঘটনা ছড়িয়ে আছে, যার ব্যাপারে আমরা আজও হয়তো জানি না। কিন্তু ভালো খবর এটা যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখন ধর্ষিতাদের সঙ্গে ন্যায়বিচার করা হয়। আর অপরাধীকে ন্যূনতম ৫ বছর জেল খাটতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে, অপরাধীকে ১০ বছরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়, যা পরবর্তীতেও বাড়ানো যেতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে, ‘ডিজিটাল রেপ’ শব্দটি এখন ধর্ষণের সংজ্ঞায় যোগ দিয়েছে এবং আজ এমন অপরাধীদের জন্য কঠোর আইন রয়েছে, যারা মনে করে যে ডিজিটাল ধর্ষণ মোটেও ধর্ষণ নয়।

 

More Articles