'হামে কাশ তুমসে মোহব্বত...', কেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল মধুবালা-দিলীপকুমারের প্রেম?

গত শতকের ছয়ের দশকে দর্শকদের আলোড়িত করেছিল মুঘল-এ-আজম। হলগুলোতে থিকথিক করছিল লোক। নানা শ্রেণির দর্শক মজেছিলেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের সেই মুহূর্তে। কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন।

চিরদিনই সিনেমাজগৎ মানুষের কাছে স্বপ্নের দুনিয়া। রূপকথার বাস্তব সংস্করণ। তাই তারকাদের মাথায় তুলে রাখে দর্শক। সিনেমায় নায়ক-নায়িকার চরিত্রাভিনেতাদের বাস্তবের মাটিতেও প্রেম তাই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। সে মিলনান্তক হোক বা বিগোয়ান্তক, সেই প্রেমের গল্প ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে, খবরের কাগজের পাতায় পাতায়।

গত শতকের ছয়ের দশকে দর্শকদের আলোড়িত করেছিল মুঘল-এ-আজম। হলগুলোতে থিকথিক করছিল লোক। নানা শ্রেণির দর্শক মজেছিলেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের সেই মুহূর্তে। কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন। চড়া দামে ব্ল্যাক হচ্ছে, অল্প দামেও ব্ল্যাক হচ্ছে। লোক বুঝে বিক্রি। চেনাশোনা থাকলে ঠিক আছে। নইলে ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরতে হচ্ছে অনেককেই। কী ছিল আসিফ সাহেবের এই ছবিতে? খুররম আর আনারকলির মতো ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রেম নিয়ে কেন এত উৎসাহিত মানুষ? মুঘল-এ-আজমের সঙ্গে দর্শকের সেই যোগসূত্রটাই বা কী? জানতে হলে বেশ কয়েকটা বছর পিছিয়ে যেতে হবে।

১৯৪৪-এ ‘জোয়ার ভাটা’ সিনেমায় দর্শক প্রথম দেখল মহম্মদ ইউসুফ খানকে। সাতচল্লিশে এল ‘জুগনু’। দর্শক চিনল তাঁকে দিলীপ কুমার নামে। রাতারাতি খ্যাতির মধ্যগগনে তিনি। সত্যজিৎ পর্যন্ত যাঁকে ‘চরিত্রাভিনেতা’ হিসেবে সম্মান করতেন। ‘জুগনু’-র বছরচারেক পরে ‘তারানা’। দিলীপকুমার পরিচিত হলেন মধুবালা তথা মুমতাজ জাহানের সঙ্গে। তাঁদের প্রথম কাজ। আর এই আলাপ প্রেমে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগল না। “আজ আর স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই, ওকে (মধুবালা) আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। সহ-অভিনেতা হিসেবে তো বটেই, একজন মানুষ হিসেবেও। ওই বয়সে আমি নিজের মনের মানুষটিকে যেমন ভাবে কল্পনা করতাম, তার অনেক গুণই ওর মধ্যে ছিল… যেমনটা বলছিলাম, এত হাসিখুশি, এত প্রাণপ্রাচুর্য, আমার লজ্জা লজ্জা ভাব, চাপা স্বভাব– সব ওর কাছে এলেই বদলে যেত। আমার ভেতরে একটা শূন্যতা ছিল, আমার নাগালের বাইরে, অপূর্ণতাবোধ, যা সারক্ষণ পূর্ণতা চায়, ও আমাকে সম্পূর্ণ করে তুলত। ওর ছটফটে স্বভাবই ছিল আমার যাবতীয় জড়তার ওষুধ।”

আরও পড়ুন: খনি অঞ্চলের ছেলের গল্প হয়ে উঠল ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস, দশ বছরে ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’

‘দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য শ‍্যাডো’ নামক আত্মজীবনীতে দিলীপকুমার নিজে এই কথা লিখে গিয়েছেন। ‘তারানা’-র আঁতুড়ে যে প্রেমের জন্ম, তা চলবে আরও সাত বছর প্রায়। এর মাঝে নির্বিঘ্নে দু'টি ছবি হয়ে গিয়েছে। এমনকী, মধুবালার বোন মাধুরও একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, “তারানা-র সেটেই ভাইজানের (দিলীপকুমার) সঙ্গে পরিচয়। পরে ‘সঙ্গদিল’, ‘অমর’ আর ‘মুঘল-এ-আজম’-এও কাজ করেছিলেন একসঙ্গে। প্রায় ন'বছরের সম্পর্ক ওঁদের। পাকা কথাও হয়ে গিয়েছিল। ভাইজানের আপা এসেছিলেন চুন্নি নিয়ে। ভাইজানের পরিবারও পাঠানদের পরিবার। দিদি আর ভাইজানকে দেখে মনে হতো, যেন পরস্পরের জন্যেই তৈরি। মাঝেমাঝেই আসতেন। দু'জনে হয় গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরোতেন, নইলে ঘরে বসে গল্প করতেন।”

তাহলে হঠাৎ হলো কী? কেন চিড় ধরল এই সম্পর্কে?

শোনা যায় মধুবালার বাবা, আতাউল্লাহ খান দিলীপকুমারকে খুব একটা পছন্দ করতেন না, সেই কারণেই সম্পর্কে ফাটল ধরে। যদিও এই বিষয়ে দিলীপকুমার এবং মাধুরের বক্তব্য ভিন্ন। মাধুরের বক্তব্য, তাঁর আব্বার দোষ ছিল না। সমস্যা হয়েছিল একটা কোর্ট কেসকে ঘিরে। “দিলীপকুমারের সঙ্গে আপার সম্পর্কটা ভেঙে যায় পাঁচের দশকের মাঝামাঝি। ‘নয়া দৌড়’-এর শুটিং সংক্রান্ত একটা কোর্ট কেসে। গোয়ালিয়রের কোনও একটা জায়গায় শুট হওয়ার কথা ছিল। সেইরকমই সব ঠিক হয়েছিল। হঠাৎ খবর এল, যেখানে শুটিং হওয়ার কথা, সেখানে ‘জাবীন জালীল’ ছবির শুটিং-এর সময় উন্মত্ত জনতা মহিলাদের আক্রমণ করেছে, কাপড়টাপড় ছিঁড়ে দিয়েছে। ব্যস। বাবা তো শুনেই বেঁকে বসলেন। শুটিং লোকেশন না পাল্টালে আপাকে যেতে দেবেন না। ভাইজান কোর্টে চোপড়াদের (বি আর চোপড়া) পক্ষ নিয়ে আব্বাকে স্বৈরাচেরী বলে দিলেন। সম্পর্কে ফাটল ধরল। সত্যি বলতে কী, আমরা ভাইজানকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি, কিন্তু আমার একটাই প্রশ্ন, 'আপনার প্রেম, আপনার ভালোবাসা পড়ে রইল, আপনি এটা কী করলেন?” মাধুরের মতে দিলীপকুমারের ইগোর জন্যেই সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। “ভাইজান লোকেশনটা পাল্টাতেও তো বলতে পারতেন! বা কিছুই বলতেন না, কোনও পক্ষই নিতেন না কোর্ট কেসে। আপা তখন কী কাঁদত দিনরাত! বহুবার ফোনে কথা হয়েছে, সম্পর্কে ফিরে যেতে চেয়েছেন দু'জনেই। কিন্তু উনি বলতেন, “আব্বার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসো, আমি তোমাকে বিয়ে করব।” আর আপা বলত, “তুমি ঘরে এসো, ওঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে একবার ওঁকে জড়িয়ে ধরো, আমি তোমাকে বিয়ে করব।" দু'জনেরই জেদ ছিল, সম্পর্কটা জেদেই ভাঙল। আব্বা কিন্তু কখনও এনগেজমেন্ট ভেঙে দিতে বলেননি, ভাইজানকে কখনও ক্ষমাও চাইতে বলেননি।”

Mughal E-Azam

আতাউল্লা খান যে সময় মুম্বইয়েই ‘নয়া দৌড়’-এর শুটিং হোক চাইছেন, সেসময় মধুবালা ছবিতে সই করার ৩০০০০ টাকা নিয়ে নিয়েছেন। এমতাবস্থায় ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটে ছবি প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলে প্রোডিউসার মধুবালার জায়গায় বৈজয়ন্তীমালাকে নেবেন ঠিক করেন। পোস্টারে মধুবালার নাম কেটে বৈজয়ন্তীমালার নাম লেখা হয়। এতে মধুবালা অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন। মধুবালাও নিজের পরবর্তী ছবির পোস্টারে ‘নয়া দৌড়’-এর নাম কেটে নতুন ছবির নাম ব্যবহার করেন। ঝামেলা বাড়ে বই কমে না। শেষে আতাউল্লাই প্রথম মামলা করেন প্রযোজকের নামে। বি আর চোপড়া তখন পালটা মামলা করতে বাধ্য হন। সেই কেসে দিলীপকুমার সাক্ষ্য দেন প্রযোজকের হয়েই। পরের দিন সকালে খবরের কাগজে বড় বড় হেডলাইন বেরোয়। কোর্টে সবার সামনে জানিয়েছিলেন দিলীপ, মধুবালাকে তিনি ভালবাসেন। এবং এও বলেছিলেন, মধুবালার বাবা তাঁদের সম্পর্কের ব্যাপারটা পছন্দ করেন না, তাই ছবিতে বাধা দিয়েছেন। এই স্পষ্ট কথায় খুশি হননি মধুবালা। বরং তাঁর মনে হয়েছিল দিলীপ তাঁর বাবাকে অপমান করছেন।

এই রকম একটা উত্তাল সময়ে ‘মুঘল-এ-আজম’-এর শুটিং হচ্ছে। দিলীপ নিজেই বলেছেন, তাঁদের সেই অভিনয় নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ ছিল না। অথচ এই সময় বাস্তবে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে কথাও বলতেন না। 'মুঘল-এ-আজম'-এর জনপ্রিয়তার নেপথ্যে এই রসায়ন অনেকখানি কাজ করেছিল। একরকম অভিমান করেই কিশোরকুমারকে বিয়ে করেন মধুবালা। বিয়ের কিছুদিনের মাথায় আলাদা থাকতে শুরু করেছিলেন কিশোর। হয়তো ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।

এরপরেই লন্ডনে চলে যান কিশোর-মধুবালা জুটি, মধুবালার হৃদরোগ ধরা পড়েছে তখন, তার চিকিৎসার জন্যই চলে যাওয়া একরকম। ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালেও মৃতপ্রায় মধুকে দেখতে এসেছিলেন দিলীপ। এই তাঁদের শেষ দেখা। তারপরে দিলীপকুমার বিয়ে করবেন সায়রা বানোকে, মধুবালাও না-ফেরার দেশে পাড়ি দেবেন। তবে সম্পর্ক ভাঙার পর দীর্ঘ সাত বছর কোনও সম্পর্কে জড়াননি দিলীপ। সম্পর্ক হয়তো ভেঙে দিয়েছিলেন মধুবালা, কিন্তু দিলীপের ভালবাসা তিনি এড়াতে পারেননি। আমৃত্যু সেই আফসোস তাঁর ছিল। শোনা যায়, দিলীপের বিয়ের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন একেবারেই। কিন্তু তখন আর কিছুই করার নেই। অভিমানের আগুন সমস্ত সম্পূর্ণতার উপায় পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে, শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণ অসুখ। মুমতাজের মৃত্যুতে ইউসুফেরও কি চোখের কোণা ভিজে ওঠেনি?

 

More Articles