গিলে খেয়েছিল দেবদাসের চরিত্র, কেন মনোবিদের কাছে ছুটতে হয়েছিল দিলীপ কুমারকে?
Dilip Kumar: দেবদাসের মানসিক অসম্পূর্ণতার লালন ক্ষেত্র থেকে পা রাখলেন গর্বোদ্ধত যুবরাজ সেলিমে।
বস্তুত, দেশকালহীন উপমহাদেশীয় অপরিপূর্ণতায় অন্তর্মুখী এক যুবা পুরুষের আর্কিটাইপাল বিরোধী 'ট্রাজিক' নায়ক হয়ে ওঠার যে অশ্রুলিপি তা দিয়েই ইউসুফ খান রূপান্তরিত হলেন দিলীপ কুমারে। আসমুদ্র হিমাচল, অবিভক্ত ভারতবর্ষ তো বটেই , এমনকী পরবর্তীকালে উপমহাদেশের বিভাজন রেখা তৈরি হলেও মেলোড্রামার অমন চড়া সুরকেও তাঁর অভিনয়ের নিস্তব্ধতায় নামিয়ে আনলেন পাহাড় থেকে সমতলে কিংবা মরুভূমির চূড়ান্ত সীমাহীনতায়। ভারতবর্ষ তথা সমগ্র উপমহাদেশের আবেগের সঙ্গে মনের গভীর সঙ্গীহীন আকাঙ্খার মতোই হিজাব পরিহিতা নায়িকারও ভালোবাসার অন্বিত চিত্রকল্পে এই ললিতকান্তি দিলীপ কুমার হয়ে উঠলেন হৃদয়ের 'দেবদাস'।
জীবনীকার লর্ড মেঘনাদ দেশাই দিলীপ কুমারকে তুলনা করেছিলেন মার্লোন ব্রান্ডো, তোশিবা মিফুনে কিংবা মার্সেলো মাস্ত্রোয়ানির সঙ্গে, যদিও তিনি ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্রে কোনওদিন অভিনয় করেননি। আসলে এ থেকে বোঝা যায় যে অভিনেতারা দেশকালহীন। একটা স্বতন্ত্র 'স্পেস'। অখণ্ড অস্ত্বিত্ব। যা শুধুমাত্র উপলব্ধি ও অনুভবের স্তরেই আলোকিত। ১৯৪৪ সালের 'জোয়ার ভাটা' থেকে যাঁর শুরু আর ১৯৯৮ সালের 'কিলা'-তে যাঁর শেষ। কখনও গ্রাম্য যুবক কখনও বা ঝকঝকে শহুরে তরুণ কখনও বা 'ট্রাজিক হিরো' আবার কখনও বা তিনি মধুবালার স্বপ্ন শয্যায়, ইতিহাসের পাতায় । দেবদাস থেকে সাগিনা মাহাতোয় তাঁর এই সরণ তাই শুধুমাত্র সহজাত নয় বরং ইতিহাস বিধৃত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকেও চিহ্নিত করে।
১৯২২ সালে পেশোয়ারের এক ধর্মপ্রাণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া পরিবারে জন্ম। যেখানে পরিবারের ব্যবসায় নেমে পড়াই ছিল তাঁর স্বাভাবিক যোগ সেখান থেকে তিনি হয়ে উঠলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা। আসলে যুদ্ধের বাতাবরণে পাঠান পরিবারটি চলে আসে বম্বে শহরে। হয়তো নিয়তি এটাই চাইছিল। উইলসন কলেজে পড়ার সময় যে ছেলেটির বাইরের বিনোদন বলতে ছিল শুধুমাত্র ফুটবল ও ক্রিকেট, কলেজের বান্ধবী তরুণীদের প্রতি স্পষ্ট আড়ষ্টতা; সে কী করেই বা হয়ে উঠবে উপমহাদেশীয় রমণী হৃদয়ের বিরহের বার্তা; পারিবারিক মেলোড্রামার অন্তর্দ্বন্দ্বে ব্যক্তি যন্ত্রণার অসহায় কণ্ঠস্বর! এ কণ্ঠস্বর শুধুমাত্র ছায়াছবির চিত্রকল্পে সীমায়িত ছিল না। বাস্তব জগতের দু'টি দেশের (ভারত ও পাকিস্তান) পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও স্তব্ধতা ভেঙে উচ্চকিত হয়েছিল। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের মেরুকরণে অটলবিহারী বাজপেয়ীর পাশে বসে দিলীপকুমার কথা বলেছিলেন নওয়াজ শরিফের সঙ্গে, যা আজ ইতিহাসের পাতায় সপরিজ্ঞাত। একইভাবে এই মানুষই একসময় আর এক উপমহাদেশীয় যুদ্ধের (পাকিস্তান-বাংলাদেশ) বাতাবরণে মুম্বইয়ের রাজপথে অর্থসংগ্রহের ব্যস্ততায় নিজেকে নিমজ্জিত করেছিলেন যাতে ওই অর্থ অতি শীঘ্রই পৌঁছে যায় বাংলাদেশের প্রান্তিক যোদ্ধাদের হাতে। মহারাষ্ট্র থেকে পেশোয়ার আর পেশোয়ার থেকে চট্টগ্রাম ঢাকার নদীমাতৃক সভ্যতায় তাই তিনি কখনও পদ্মভূষণে, কখনও 'নিসান-এ-ইমতিরাজ' আবার কখনও বা বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্বে লীন হয়ে থাকলেন আপামর উপমহাদেশের হৃদয়ে।
আরও পড়ুন- ‘হামে কাশ তুমসে মোহব্বত…’, কেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল মধুবালা-দিলীপকুমারের প্রেম?
আসলে পঞ্চাশ ষাট দশকের যুদ্ধ বিধস্ত উপমহাদেশীয় নব্য বাস্তবতার যে দ্বিধান্বিত নাগরিকত্ব যেখানে আপাত মার্জিত ভীরুতা, দ্বিধাগ্রস্ততা, অনুচ্চকিত প্রতিবাদের পরিধি, সেখানেই পাশের বাড়ির ভালোলাগার ছেলেটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছিল দিলীপ কুমারের নরম পৌরুষত্ব ও অন্তঃপ্রবাহিত ভাবনা প্রতীতির অভিব্যক্তি। যা দিল এক অনুভবগত অখণ্ডতা, ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র উপমহাদেশের শিরায় শিরায়। 'এ ভাই' ডায়লগে প্রত্যক্ষ করা গেল মশাল ছবির সেই অসহায় যুবককে যার স্ত্রী রাস্তায় মৃত্যুতে ঢলে পড়েছে। এ দৃশ্য সততই দিলীপ কুমারের নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার আদিম আকুতি; অসহায়তায় বাঙ্ময় প্রকাশ।
স্বাধীনতা-উত্তর অবিশ্বাস ও দোলাচলে এবং মূল্যবোধের অভাব নিউ সিটিজেনশিপ কিংবা নব নাগরিকত্বের বুনিয়াদটিকে নড়বড়ে করে তোলে। ফলে জীবনচেতনার বহিঃপ্রকাশ অতিরিক্ততার বা 'Excess' মেলোড্রামার হাত ধরে পর্দায় চড়া সুরে বাজতে থাকে। মেলোড্রামা হয়ে ওঠে আঙ্গিক। অথচ এই মেলোড্রামাকেই সঙ্গী করে বিরহ চেতনায় বিষাদগ্রস্ত হয়ে ওঠেন এই শিল্পী। মেলোড্রামার অতিরিক্ততা পৌঁছে দেন বাস্তবধর্মী রূপকল্পে। নিজেই হয়ে উঠলেন দেবদাস। পরিণামে মনঃসমীক্ষার জন্য শরণাপন্ন হলেন বিখ্যাত ডাক্তার রমনলাল প্যাটেলের। বিদেশে চিকিৎসা করালেন ডব্লিউ. ডি. নিকল নামের বিখ্যাত মনোবিদের কাছে। দু'জনেই বললেন এই বিষাদগ্রস্ততা ছাড়ুন। আপনি দেবদাসের নায়কের বদলে তাঁর অংশ হয়ে উঠছেন। ফিরলেন দিলীপ কুমার। ছাড়লেন পিয়াসা ছবির অফার। যোগ দিলেন মুঘল-ই-আজম এ। বাকিটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন- সর্বজয়া নয়, আসলে ইন্দির ঠাকরুনেরই সন্তান দুর্গা…
ভগ্নহৃদয়ের দেবদাস থেকে যুবরাজ সেলিম অথচ একই স্টুডিওয় (আন্ধেরির মোহন স্টুডিও) পাশাপাশি দু'টি সেট। শুধু বিমল রায় থেকে করিম সাহেবের ঘরানায় পৌঁছে যাওয়া। মাত্র কয়েক পা হাঁটা। আর এই হাঁটাটুকুই তাঁকে পৌঁছে দিল জীবনের তুঙ্গ অবস্থানে। দেবদাসের মানসিক অসম্পূর্ণতার লালন ক্ষেত্র থেকে পা রাখলেন গর্বোদ্ধত যুবরাজ সেলিমে। আশ্চর্যজনকভাবেই মেলোড্রামার একই আঙ্গিকে নিজেকে নিঃশব্দে, নিরাসক্ততার ক্যারিশ্ম্যাটিক অভিনয়ে পর্দার চড়া সুরটিকে বেঁধে ফেললেন পুরুষত্বের কমনীয়তায়। পুরুষালি দেহভঙ্গিমার শিথিলতায় গুঁজে দিলেন গার্হস্থ্য রোমান্টিকতার বিশ্বাস্য দেহ সুষমা। হয়ে উঠলেন ইন্দ্রিয়-চেতনা সিদ্ধ জীবন-রূপের কারবারি। সেলিম ও আনারকলির দ্রাক্ষাকুঞ্জ তখন উতল ভালোবাসা, হার না মানা প্রেমের হদিশ ধরার কৌতূহল; ময়ূরকণ্ঠ পাখির পালক স্পর্শে দিশাহারা। আর সেলিম হয়ে উঠলেন নারী হৃদয়ের 'রাজপুত্র'। প্রেমের চিত্রকল্প নেমে এল জীবনের রাজপথেও। পথচলতি অজ্ঞাত বালিকার কণ্ঠেও ভেসে এল, 'প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া'।
এ সময়টিতে দিলীপ কুমারের বাস্তব জীবনেও বহু গোলাপ সুন্দরীর আনাগোনা। স্বয়ং মধুবালা থেকে বাইশ বছরের ছোট সায়রা বানুও এহেন রাজপুত্রকে দেখেছে একই চোখে। এ তো হওয়ারই ছিল। সে আখ্যানের নিরাসক্ততায় হোক কিংবা ট্রাজেডির বিষাদগ্রস্ততায়- তিনি যে সত্যিই রাজপুত্র। ভারতীয় হিন্দি সিনেমার রুপোলি আলোয় তাঁর 'স্টারডম' প্রতিষ্ঠিত। আসেপাশে রাজ কাপুর কিংবা রাজেন্দ্র কুমার থাকলেও দিলীপ কুমারের অভিনয়ের অনিঃশেষ স্থিতধী তাঁকে নক্ষত্রের চূড়ান্ত পর্যায়ে স্থাপন করে। ওইখানেই মানুষের ভালোবাসা, বিষাদগ্রস্ততা এবং ট্রাজেডির স্বতঃসিদ্ধ প্রকাশ। সেখানেই শিল্পী হয়ে ওঠেন জীবন প্রত্যয়ে প্রাপ্ত অফুরান প্রাণের জাদুকর। তাই তো তিনি অবাক হননি যখন হৃদয়ের তপ্ততায় দু'টি লাইন তাঁর সামনে আসে- "আগর আপ মুঝে চাহতে হ্যায় তো ইয়ে গুলাব কবুল ফরমাইয়ে, ভরনা ইয়ে ওয়াপস কর দিজিয়ে"!
মধুবালার এহেন দু'টি লাইনের উত্তর কী ছিল জানা যায় না কিন্তু জীবন সত্যে এমন লাইন যে সেলিমেরই প্রাপ্য তা নিয়ে কারও দ্বিধা থাকার কথা নয়। যেমন দ্বিধা থাকার কথা নয় দেবদাসের সেই অন্তর্লীন যন্ত্রণায় বিষাদের রাজপুত্র যখন সুরাপাত্র হাতে বলে ওঠেন, "কৌন কমবখত্ বরদাস্ত করনে কে লিয়ে পিতা হ্যায়"।