মড়ক লাগা উদ্বাস্তু শিবিরে কীভাবে তৈরি হয়েছিল দুনিয়া কাঁপানো ওষুধ ওআরএস
Dilip Mahalanbis: তাঁর তৈরি যুগান্তকারী সলিউশনকে 'দ্য ল্যানসেট' "চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার" বলে অভিহিত করেছে।
যদিও ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস) ডিহাইড্রেশনের প্রাথমিক চিকিৎসায় একটি সহজ, কার্যকর প্রতিকার হিসেবে সারা বিশ্বে বর্তমানে পরিচিত, এই বিশেষ তথা সম্ভবত চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ শতকের শেষদিকের যুগান্তকারী আবিষ্কারের পথিকৃৎকে আমরা অনেকেই মনে রাখিনি। এই যুগান্তকারী সলিউশনের আবিষ্কারক ডা. দিলীপ মহলানবিশ ১৬ অক্টোবর কলকাতার একটি হাসপাতালে গত হন। প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (পিটিআই) সূত্রে জানা যায়, ৮৮ বছর বয়সি ডা. মহলানবিশ ফুসফুসের সংক্রমণ এবং অন্যান্য বয়সজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র মতে, ডায়েরিয়াজনিত রোগ, কলেরা, অনেক উন্নয়নশীল দেশেও বহুল আলোচিত ও বিশেষত শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি, যেখানে রোগী ডিহাইড্রেশনে মারা যান। জল, গ্লুকোজ এবং লবণের সংমিশ্রণ, ওআরএস সলিউশন, এটি প্রতিরোধ করার একটি সহজ এবং সাশ্রয়ী পদ্ধতি হতে পারে, এই ভাবনারই প্রাথমিক চিন্তক ডা. দিলীপ মহলানবিশ। তিনি যখন ১৯৭১-এর বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় উপচে পড়া শরণার্থী শিবিরে ডায়েরিয়া, কলেরার মতো তৎকালীন মারণ রোগ প্রতিরোধে কাজ করছিলেন, সেসময়ই তিনি ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট সলিউশনের ভাবনা নিয়ে আসেন। যেই যুগান্তকারী সলিউশনকে 'দ্য ল্যানসেট' "চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার" বলে অভিহিত করেছে।
আরও পড়ুন: ওআরএস-এর জন্মদাতা! ডায়েরিয়া নিরাময়ে ইতিহাস গড়েছিলেন দিলীপ মহলানবিশ
১৯৭৫ থেকে '৭৯ সাল পর্যন্ত, ডা. মহলানবিশ আফগানিস্তান, মিশর এবং ইয়েমেনে কলেরা নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র সঙ্গেই। আটের দশকে, তিনি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। ২০০২ সালে, দিলীপ মহলানাবিশ ডা. নাথানিয়েল এফ. পিয়ার্সের সঙ্গে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত থাকাকালীন পোলিন পুরস্কারে (শিশুরোগ-বিদ্যায় নোবেলের সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত) ভূষিত হন। ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন এখনও শিশুদের ডায়েরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসার প্রধান ভিত্তি। ওআরএস ব্যবহারের আগে, একমাত্র চিকিৎসা ছিল শিরায় তরল আধান প্রয়োগ, যা ছিল যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ও খরচসাপেক্ষ। ডা. মহলানবিশের অবিরাম প্রচেষ্টায়, ওআরএস সলিউশন একটি গৃহস্থালির নিত্যপ্রয়োজনীয় নাম হয়ে গিয়েছে।
১৯৩৪ সালে অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন ডা. মহলানবিশ। প্রথমে কলকাতায় এবং পরে লন্ডনে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পড়াশোনা করেন এবং ছয়ের দশকে কলকাতার জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মেডিকেল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এ যোগ দেন, যেখানে তিনি ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপিতে গবেষণা শুরু করেন।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে লাখ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়, এই শরণার্থী শিবিরগুলিতে বিশুদ্ধ পানীয় জলের সমস্যা ছিল অন্যতম, এবং আকস্মিকভাবেই সেইসব শরণার্থীদের মধ্যে কলেরা এবং ডায়েরিয়ার মতো তৎকালীন মারণরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
ডা. মহলানবিশ এবং তাঁর দল সেসময় বনগাঁয় একটি স্বাস্থ্য শিবিরে কাজ করছিলেন, যেখানে পুরনো পদ্ধতিতে এই মারণ রোগগুলির প্রতিরোধে তাঁকে ও তাঁর দলকে বিষম বেগ পেতে হয়, এবং যথেষ্ট পরিমাণে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরও অভাব ছিল তাঁদের শিবিরে।
তাঁর দীর্ঘ গবেষণা থেকে, ডা. মহলানবিশ চিনি এবং লবণের একটি এমন দ্রবণ তৈরির কথা ভাবেন, যা শরীরে জল-শোষণকে বাড়িয়ে তুলে, বহুসংখ্যক জীবন বাঁচাতে পারে। এরপর তিনি এবং তাঁর দল জল, লবণ এবং গ্লুকোজের দ্রবণ প্রস্তুত করেন এবং সেগুলির যথার্থ সংরক্ষণ করতে শুরু করেন।
এই নতুন চিকিৎসা কার্যকর হবে, এই ভরসা দিতে , তাদের বলা হয়েছিল এটি একটি মৌখিক স্যালাইন। ডা. মহলানবিশ পরবর্তীতে, ১৯৭১ সালেই, সেই সময়কাল সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র সাউথ-ইস্ট এশিয়া জার্নাল অফ পাবলিক হেলথ-এ লিখেছিলেন, "আমরা যে মৌখিক দ্রবণটি ব্যবহার করার জন্য নির্বাচন করেছি তাতে প্রতি লিটার জলে ২২গ্রাম গ্লুকোজ (বাণিজ্যিক মনোহাইড্রেট হিসেবে), ৩.৫ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড (টেবিল লবণ হিসেবে) এবং ২.৫ গ্রাম সোডিয়াম বাইকার্বোনেট (বেকিং সোডা হিসেবে) ছিল। এটি ছিল সবচেয়ে সহজ ফরমুলা, যার মধ্যে ন্যূনতম সংখ্যক উপাদান ছিল, যা আগে কলেরায় গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছিল।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন' দ্বারা পরিচালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র বুলেটিনে অন্য একটি নিবন্ধে, ডা. মহলানবিশ বলেছেন, “দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, এটি (ওআরএস পদ্ধতি) কাজ করছে। কীভাবে লবণ এবং গ্লুকোজ মেশানো হয়, তার বর্ণনা দিয়ে প্যামফ্লেট তৈরি করে অ-প্রশিক্ষিত লোকদের হাতে বিতরণ করেছি। তথ্যটি একটি বাংলাদেশি রেডিও স্টেশনেও সেসময়ে সম্প্রচার করা হয়েছিল।”
শীঘ্রই ডা. মহলানবিশের শিবিরে মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ থেকে মাত্র ৩ শতাংশে নেমে আসে। ডা. ধীমান বড়ুয়া, তৎকালীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র ব্যাকটেরিয়া রোগ ইউনিটের প্রধান, ডা. মহলানবিশ-পরিচালিত ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং কলেরা, ডায়েরিয়ার মতো রোগের চিকিৎসায় ওআরএস পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করতে শুরু করেন।
অবশেষে ওই বছরেরই ২৯ জুলাই, কলেরা এবং অন্যান্য ডায়েরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য ওআরএস-কে আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আজ, ওআরএস সূত্র হিসেবে সোডিয়াম ক্লোরাইড, অ্যানহাইড্রাস গ্লুকোজ, পটাশিয়াম ক্লোরাইড এবং ট্রাইসোডিয়াম সাইট্রেট ডাইহাইড্রেটের সংমিশ্রণ সুপারিশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেসময় থেকেই ভারতে ২৯ জুলাই দিনটিকে ওআরএস দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
গৃহস্থালির নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধগুলির মধ্যে আজ এক সরল, স্বাভাবিক নাম ওআরএস। এই যুগান্তকারী সলিউশন প্রাণ বাঁচায় দেশভাগের দগদগে ক্ষত-সহ বহু শরণার্থীর। এই সলিউশনের কান্ডারির পরলোকগমন আবশ্যিকভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগসমাপ্তি।