অচলাবস্থা কাটাতে নবান্নে অভিনেতা-পরিচালক, কোন পথে ছন্দে ফিরবে টলিপাড়া?
Rahool-Federation Conflict: টলিপাড়ার অচলাবস্থা কাটাতে মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হন পরিচালক-অভিনেতাদের একাংশ।
জট কাটল না মঙ্গলেও। টলিপাড়ায় জারি একই রকম অচলাবস্থা। শুধু বাংলা সিনেমা নয়, বাংলা ওটিটি এবং সিরিয়ালের অবস্থাও সঙ্কটে। আলাপ-আলোচনা-বৈঠকেও মিলল না সমাধানসূত্র। কোন পথে ঘুচবে সংঘাত? কোন পথে ফের ছন্দে ফিরবে টলিপাড়া? সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সোমবারও দিনভর অচলই ছিল টলিপাড়া। আর তার রেশ যে মঙ্গলবারেও পৌঁছবে, তা বুঝতে অসুবিধা হল না। এদিন সমস্যা মেটাতে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হলেন অভিনেতা-পরিচালকদের একাংশ? সরকারি হস্তক্ষেপেই শেষ পর্যন্ত মিটতে চলেছে অশান্তি? উঠেছে প্রশ্ন।
পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়মবিরুদ্ধ কাজের অভিযোগ ওঠে। সেই থেকেই শুরু বিতর্ক। গত শুক্রবার খবর মেলে তাঁর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ডিরেক্টরস গিল্ড। কিন্তু ডিরেক্টরস গিল্ড অব্যাহতি দিলেও রাহুলকে ছাড়পত্র দেয়নি ফেডারেশন। যার জেরে কাজে ভেটো দিয়েছে কলাকুশলী-টেকনিশিয়ানরাও। সেই নিয়েই অশান্তি এবং টলিপাড়ায় অচলাবস্থার শুরুয়াৎ। এরপর ফেডারেশনের সিদ্ধান্তে নড়েচড়ে বসে টলিউডের পরিচালকদের একাংশ। সোমবারই একঝাঁক পরিচালক অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে যান। সেখানে কাজ শুরু থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে, সেই বিষয়ে আলোচনাও হয়। এবং প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রাজ চক্রবর্তী, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ সকলেই জানিয়েছেন আলোচনার মাধ্যমে কাজে ফিরতে চান সকলেই। এই দিন বিকেলেই টালিগঞ্জের টেকনিশিয়ানস্ স্টুডিয়োয় সাংবাদিক বৈঠক করেছিল ফেডারেশন। তার পর সন্ধ্যায় সেখানেই পাল্টা বৈঠকে বসে ডিরেক্টর্স গিল্ড। পরিচালকদের তরফে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অরিন্দম শীল, রাজ চক্রবর্তী-সহ অনেকেই। আর সেই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: ফেডারেশনের দাদাগিরি আর মানবেন না পরিচালকেরা, কী ভবিষ্যৎ বাংলা সিনেমার?
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্য়ায় জানান, “আমরা এবং টেকনিশয়ানরা যে আলাদা, সেটা আজ প্রথম জানলাম! এখানে আমরা-ওরা এই তত্ত্ব নিয়ে নয়, সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে একজোট হয়েছি। সেখানে স্লোগান থাকবে না!” অঞ্জনের কথায়, “রাহুলকে (পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়) কেন্দ্র করে যে সমস্যার সূত্রপাত ঘটেছিল, সেটা আজকে ৪০০ জন পরিচালকের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিচালকদের অভিযোগ ফেডারেশন তাদের নিজেদের ইচ্ছে মতো একতরফা আইন তৈরি করে। ফলে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে কাজের পরিসর ক্রমশ কমছে। ফিরে যাচ্ছেন বলিউডের বহু নির্মাতা।” প্রসেনজিতের কণ্ঠেও শোনা গিয়েছিল বিবাদ মেটানোর পক্ষেই সুর, তিনি জানান, ''গোটা ইন্ড্রাস্ট্রি একটি পরিবার। এটাকে আমি মান-সম্মানের লড়াই বলব। সাধারণ পরিবারে যেমন অভাব-অভিযোগ থাকে, এখানেও আছে। কিন্তু এইভাবে একটা পরিবার ভেঙে যাক, কেউই আমরা চাই না।'' ফেডারেশনের তরফে অভিযোগ ছিল, পরিচালকদের একাংশ ‘ষড়যন্ত্র’ করে সোমবার শুটিং বন্ধ করেছেন। এই প্রসঙ্গে অনির্বাণ ভট্টাচার্য বলেন, “পরিচালকেরা কাজে আসেননি। কিন্তু আমরা অন্য কোনও বিভাগকে কাজে না আসার জন্য অনুরোধ করিনি।” অবিলম্বে সমস্যার সমাধান চাইছেন পরিচালকেরা। এ দিকে ফেডারেশনও আলোচনার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। কিন্তু সমস্যা না মিটলে কর্মবিরতি চলবে বলেই জানিয়েছেন তাঁরা। পরিচালক রাজ চক্রবর্তী বলেন, “এক দিন, দু’দিন থেকে সাত দিন হতে পারে। কিন্তু সমস্যা না মিটলে এই কর্মবিরতি চলবে।” ফলে সোমবারই বোঝা গিয়েছিল, মঙ্গলবারও বন্ধ থাকতে চলেছে টলিপাড়া। সমস্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কোনও সমাধানের পথ দেখা যাচ্ছে না। তাই পরিচালকেরা চাইছেন ‘নিরপেক্ষ’ তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ। কিন্তু কে হতে পারেন এই তৃতীয় পক্ষ? পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর কথায়, “সিনেমার সঙ্গে যুক্ত অথচ আইন বোঝেন এমন কাউকেই আমরা চাইছি।”
কিন্তু কারা হতে চলেছেন সেই তৃতীয় পক্ষ? ইতিমধ্যেই পরিচালক-ফেডারেশন সংঘাতে হস্তক্ষেপের কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই অচলাবস্থা পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে আর্টিস্ট ফোরাম। শিল্পী মহলের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, ‘আপনারা জ্ঞাত আছেন যে আজ সকাল থেকে বাংলা ফিল্ম, টেলিভিশন ও ওটিটি ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত শ্যুটিং বন্ধ রয়েছে। এটা একটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতি। আমরা আগেও জানিয়েছি, কোনও অবস্থায় শ্যুটিং ব্যহত হোক, আমরা চাইনা। সমস্ত সমস্যার সমাধান, মুখোমুখি আলোচনার টেবিলে হোক। আজ শ্যুটিং বন্ধ থাকার ফলে আমাদের সদস্যরা সম্পূর্ণ রোজগারহীন রইলেন। মনে রাখা দরকার, আমাদের সদস্যরা দিন আনি, দিন খাই, ভিত্তিতে জীবনযাপন করেন। আজকের পৃথিবীতে শ্যুটিং বন্ধ থাকা একটা বিরাট অনিশ্চয়তার পরিস্থিতি তৈরি করেছে আমাদের কর্মজীবনে। আমরা সদস্যরা এই সমস্যার সমব্যথী এবং তাঁদের স্বার্থে অবিলম্বে শ্যুটিং চালু করার দাবি জানাচ্ছি।’ বিবৃতিতে আরও লেখা হয়, ‘আমরা মনে করি, প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশক, শিল্পী বা এই জগতের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের মধ্যে যাই সমস্যা থাক না কেন, এই মুহূর্তে শ্যুটিং বন্ধ করা কোনও সমাধান হতে পারে না। সকলের কাছে পুনরায় আবেদন, আপনারা আলোচনায় বসুন, সমস্যার সমাধান করুন। প্রয়োজনে আমরা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে এখনই প্রস্তুত। কিন্তু বিলম্ব না করে, একে অপরের সঙ্গে বিবাদে না জড়িয়ে আসুন সকলে মিবে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হই।’
আর্টিস্ট ফোরামের তরফে এই বিবৃতিতে সই করেছেন সভাপতি রঞ্জিত মল্লিক, কার্যকরী সভাপতি জিৎ এবং সাধারণ সম্পাদক শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়। বিবৃতির শেষে জানানো হয়েছে, ‘আমরা সংবাদ মাধ্যমের থেকে জানতে পেরেছি, বিভিন্ন সংগঠন শ্যুটিং -এর নীতি পরিবর্তন সংক্রান্ত কিছু দাবি তুলেছেন। আমাদের সদস্যদের অর্থাৎ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সুস্থ কর্মসংস্কৃতির দাবিতে আমরাও কিছু পরিবর্তিত নীতি সামনে আনতে চাই। সে বিষয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। সমস্ত পক্ষের যথাযথ প্রতিনিধিত্বে একটা উচ্চ-পর্যায়ের আলোচনার আয়োজন হোক। আর্টিস্ট ফোরামের প্রতিনিধিদল আমাদের পরামর্শ ও দাবিগুলো সামনে রাখবে। তবে এই আলোচনা চালানোর জন্য কোনওভাবে শ্যুটিং যাতে ব্যহত না হয়, সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। অবিলম্বে কাজ শুরু হোক, এই আশা রাখি।’
ফেডারেশনের এই দাদাগিরি নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন অভিনেতা দেবও। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক রঙ না লাগানোর। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকার টলিপাড়ার স্টুডিওর উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে, আর সেটা কাজ বন্ধ করে ফেলে রাখার জন্য করা হয়নি। প্রসেনজিৎ-এর ছবির শ্যুটিং টেকনিশিয়ানদের অসহযোগিতায় বন্ধ হওয়ায় ক্ষুব্ধ দেব। বলেন, 'আমরা সবাই তাঁকে সম্মান করি, বুম্বাদা সবসময় টেকনিশিয়ানদের পাশে দাঁড়িয়েছে, অথচ আজ তাঁরই শ্যুটিং বন্ধ করে দেওয়া হল। মুখ্যমন্ত্রী যাকে সম্মান দিচ্ছেন, ফেডারেশন তাঁরই শ্যুটিং বন্ধ করে দিচ্ছে। এটা খুবই অসম্মানজনক’।'
এদিকে, সোমবার বিকেলে ফেডারেশনের বৈঠকের পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে ফেডারেশন কর্তারা জানান, রাহুল মুখোপাধ্যায়কে পরিচালক হিসেবে মানছেন না তারা। একই সঙ্গে গুপি শুটিংয়ের বিরুদ্ধেও গর্জে ওঠেন তাঁরা। স্টুডিও চত্বরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন টেকনিশিয়ানরা। ওঠে ‘মানছি না, মানব না’ স্লোগান। ফেডারেশন মনে করছে, ইচ্ছে করে সোমবার ইন্ডাস্ট্রি স্তব্ধ করে দিয়েছেন পরিচালকেরা। পুরোটাই ‘পূর্বপরিকল্পিত’ বলে দাবি উঠেছে। ফেডারেশন সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস বলেন, “পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র! তবে আমরা আলাপ আলোচনায় বসতে রাজি।” একই সঙ্গে তিনি বলেন, “সিনেমা পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু আজ সিরিয়ালের শুটিং বন্ধ করে যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হল, সেটা প্রযোজকেরা জানান।” একই সঙ্গে পরিচালকদের এই পদক্ষেপ মুখ্যমন্ত্রীর অবমাননা বলেও তোপ দেগেছেন তিনি। কারণ মুখ্যমন্ত্রী শুটিং বন্ধ রাখার বিপক্ষে।
আরও পড়ুন: বাংলা সিনেমার উচ্চতা থেকে পতন নিয়ে দু’চার কথা
যদিও ফেডারেশনের দাদাগিরির বিরুদ্ধে পরিচালকদের পাশে দাঁড়িয়েছে সিনে ভিডিও অ্যান্ড স্টেজ সাপ্লায়ারস ওয়েলফেয়ার অ্য়াসোসিয়েশন। তাদের তরফে বিবৃতি প্রকাশ করে ফেডারেশনের বিরুদ্ধে কার্যত ‘হুমকি’ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। সংগঠনের সম্পাদক, সৈকত দাসের নামে প্রকাশিত বিবৃতিতে লেখা হয়েছে, “আমরা ভেন্ডররা বিভিন্ন সময়ে ফেডারেশনের কিছু সদস্যের দ্বারা হুমকিপ্রাপ্ত হই, তাঁদের কথা মতো মাল সরবরাহ না করলে, তাঁকে নিষিদ্ধ করা হবে। মাননীয় মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের নিষেধ সত্ত্বেও দিনের পর দিন এ সব চলে আসছে।” সৈকতের দাবি, ‘গুপি’ শুটিংয়ে মাল সরবরাহ করতে নিষেধ করেছে ফেডারেশন। কিন্তু কোনটা ‘গুপি’ শুটিং সেটা তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। বরং এতে তাঁদের ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে বিস্তর। এই প্রসঙ্গে পরিচালক ও প্রযোজকদের আন্দোলনকে সমর্থনের কথাও বলেছেন তারা।
এদিকে টলিপাড়ার অচলাবস্থা কাটাতে মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হন পরিচালক-অভিনেতাদের একাংশ। এদিন অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, পরিচালক গৌতম ঘোষরা নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও। নবান্ন সূত্রে খবর, টলিপাড়ার জট কাটাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন ফোন করেন অভিনেতা দেবকে। তারপরই দেব প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিয়ে আসেন। আপাতত যাতে শ্যুটিং শুরু করা যায় সেই বার্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিতে পারেন বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও কর্মবিরতির ডাকে সাড়া না দিয়েই সোমবার টলিপাড়ায় শুটিং সেরেছেন পরিচালক সুজিত সরকার। দু-একটি মেগারও শুটিং হয়েছে বলে খবর।