উমর খালিদের বক্তব্য কি সত্যিই উসকানিমূলক? মনে করেন না অনেকেই
সাম্প্রদায়িক হিংসায় প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গ্রেফতার হয়েছেন গুজরাতের বিধায়ক জিগনেশ মেভানি (Jignesh Mevani)। আদালতে তাঁর জামিনের আর্জিও খারিজ হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যেই এবার দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (JNU) প্রাক্তন ছাত্র তথা সমাজকর্মী উমর খালিদের (Umar Khalid) মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে দাঁড়াল। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে দিল্লি দাঙ্গায় উসকানিমূলক ভাষণের যে অভিযোগ রয়েছে, তাকে একরকমভাবে গুরুতর বলেই উল্লেখ করল দিল্লি হাই কোর্ট। আদালতের মতে, উমরের ভাষণ অত্যন্ত অপ্রীতিকর। একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই উমর জামিন পাওয়ার যোগ্য কি না, তা কার্যত দিল্লি পুলিশের 'হ্যাঁ' বা 'না' বলার ওপরই ছেড়ে দিল আদালত।
২০২০-র ফেব্রুয়ারি মাসে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলন এবং তাকে ঘিরে হিংসার ঘটনায় উমরের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ভাষণ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২০২০-র ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সেই থেকে জেলবন্দি হয়ে রয়েছেন জনজাতি-জীবন নিয়ে গবেষণারত উমর। ছাত্রজীবনে 'দেশদ্রোহী' তকমাপ্রাপ্ত উমরের বিরুদ্ধে দিল্লি দাঙ্গা মামলায় বে-আইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধী আইন (UAPA) কার্যকর করা হয়েছে, যার আওতায় রাতারাতি কোনও নাগরিককে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বা ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করে দেওয়া যায়। ২৪ মার্চ দিল্লির দায়রা আদালতেও উমরের জামিনের আর্জি খারিজ হয়ে যায়। দায়রা আদালতের সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই হাই কোর্টে গিয়েছিলেন উমর।
দিল্লি দাঙ্গার সময় উমর রাজধানীতে ছিলেনই না বলে আদালতে জানান তাঁর আইনজীবী। বরং, ২০২০-র ফেব্রুয়ারি মাসে মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে মঞ্চে দেওয়া ভাষণের প্রেক্ষিতেই উমরকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানান তিনি। আদালতে উমরের সেই ভাষণের কিছু অংশ পড়তে শুরু করলে মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে দেন বিচারপতি। প্রশ্ন তোলেন, ‘‘ভাষণে যে ধরনের অভিব্যক্তি ধরা পড়ছে, আপনার কি মনে হয় না, তা মানুষকে উত্তেজিত করতে পারে? পূর্বপুরুষ ইংরেজদের দালালি করেছেন বলে যে মন্তব্য করেছেন উমর, তা কি ঘৃণ্য বলে মনে হয় না আপনার? এমন মন্তব্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণতন্ত্রের চার স্তম্ভ এবং বাকস্বাধীনতার দোহাই দিলেও এমন মন্তব্য মানা যায় না। গান্ধীজি, ভগৎ সিং কখনও এমন ভাষার ব্যবহার করেছেন?’’ উমরের আইনজীবী জানান, উমরের মন্তব্য ঘৃণ্য হতে পারে। তিনি শুধু উমরের বিরুদ্ধে আনা সন্ত্রাসী আইনের যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলতে চান।
আরও পড়ুন: রামনবমী ঘিরে দাঙ্গা পরিস্থিতি, ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ফিরে ফিরে এসেছে
উল্লেখ্য, যে ভাষণের প্রেক্ষিতে উমরের বিরুদ্ধে ইউএপিএ কার্যকর করা হয়েছে, তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এক সপ্তাহব্যাপী হিংসা, প্রাণহানির পর দিল্লি যখন স্তব্ধ, সেই সময় উমরের ভাষণের কিছু অংশ নেটমাধ্যমে তুলে ধরেন বিজেপি-র আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য। মীনাক্ষী লেখি, তেজস্বী সূর্য, অমিত শাহ-ও সেটিকে সারসত্য বলে তুলে ধরেন দেশবাসীর সামনে। দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে দেখানো হয় তা। কিন্তু ৪২ সেকেন্ডের ওই ভিডিও উমরের দীর্ঘ ভাষণের মধ্যে থেকে খাপছাড়া করে তুলে নিয়ে বিকৃত আকারে পেশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। আদালতে সেই প্রসঙ্গ উঠলে দিল্লি পুলিশের তরফে টিভি চ্যানেলগুলির কাছে জবাব চাওয়া হয়। কিন্তু তারা জানায়, উমরের সভায় তাদের নিজস্ব কোনও চিত্রসাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন না। বিজেপি নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া ভিডিওটি তারা শুধু সম্প্রচার করেছে।
বিজেপি নেতাদের টুইট করা ভিডিওটিতে উমরকে বলতে শোনা যায়, "ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতে এলে ওঁকে জানাব যে, নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সরকার দেশে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। মহাত্মা গান্ধীর মূল্যবোধ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। শাসক বিভাজন তৈরির চেষ্টা করলেও, ভারতবাসী দেশের ঐক্য ধরে রাখতে প্রস্তুত। এর জন্য রাস্তায় নামতে পারি আমরা। আপনারা আসবেন তো!" উমরের এই মন্তব্যের মধ্যেও দোষের কিছু দেখছেন না সমাজ-সচেতন মানুষেরা। উমরের ঘনিষ্ঠরা এর মধ্যে অন্যায়ের কিছু না দেখলেও, আদালতের মতে, এই ভাষণের জন্য, উমরের বিরুদ্ধে ১৫৩-এ (ধর্ম এবং জাতপাতের ভিত্তিতে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতায় ইন্ধন) ধারাও প্রয়োগ করা উচিত ছিল। তাই উমরের জামিনের প্রশ্নে দিল্লি পুলিশকে তিন দিন সময় দিয়েছে আদালত। জামিনের পক্ষে বা বিপক্ষে, নিজেদের রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। ২৭ এপ্রিল তার শুনানিতেই ঠিক হয়ে যাবে, উমর জামিন পাবেন কি না।
এর আগে, গত সপ্তাহে, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক তথা ছাত্র শার্জিল ইমামের জামিনের আর্জিও খারিজ হয়ে গিয়েছে দিল্লির আদালতে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে ভাষণ দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধেও ইউএপিএ রয়েছে। ২০২০-র জানুয়ারি মাসে শার্জিল নিজেই আত্মসমর্পণ করেন। গুয়াহাটি সেন্ট্রাল জেল থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এই মুহূর্তে তিহার জেলে রয়েছেন তিনি। শার্জিলের বিরুদ্ধে শুধু উসকানিমূলক ভাষণই নয়, দিল্লি দাঙ্গায় বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছে পুলিশ। দিল্লিতে চাক্কা জ্যাম চলাকালীন শার্জিলের উদ্ধৃতি বলে বেশ কিছু অংশ নেটমাধ্যমে তুলে ধরেন বিজেপি-র মুখপাত্র সম্বিত পাত্র। যা হল, ‘‘সময় এসেছে দেশের অমুসলিম নাগরিকদের কিছু কথা বলার। আমাদের প্রতি সহানুভূতি থাকলে তাঁদের আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত। আমাদের দাবি-দাওয়ায় সম্মতি না থাকলে সহানুভূতিরও প্রয়োজন নেই।’’ শার্জিলের মন্তব্য বলে সম্বিত যে উদ্ধৃতি তুলে ধরেন, তাতে আরও বলা হয়, ‘‘অসমে বন্দিশিবিরে নাগরিকপঞ্জি থেকে নাম বাদ যাওয়া মানুষের ওপর নিদারুণ অত্যাচার হচ্ছে। পাকাপাকিভাবে না হলেও, পাঁচ লক্ষ মানুষও যদি একজোট হন, তাহলে অসমকে এক-দু’মাসের জন্য ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা সম্ভব।’’
আরও পড়ুন: পাখির চোখ ২০২৪, কোন ফন্দি আঁটছেন প্রশান্ত কিশোর?
উত্তেজনার বশে শার্জিল অসমকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কথা যদি বলেও থাকেন, তার জন্য তাঁকে 'দেশদ্রোহী' বা 'সন্ত্রাসবাদী'-র গোত্রে ফেলা যায় না বলে মনে করেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অপূর্বানন্দ। তাঁর মতে, লাগাতার সরকারের কাছ থেকে অ-সংবেদনশীল আচরণ পেয়ে, হতাশা এবং রাগের বশে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে ফেলেন শার্জিল। চাক্কাজ্যাম যুগ যুগ ধরে প্রতিবাদ, আন্দোলনের অংশ হয়ে রয়েছে। তাই চাক্কাজ্যামে শার্জিলের অংশ নেওয়া, সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দেওয়া দেশদ্রোহের আওতায় কেন পড়বে, প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। অসমের যে পরিস্থিতির কথা শার্জিলের বক্তব্য বলে তুলে ধরা হয়েছে, তা অতিরঞ্জিত হলেও, মানুষ যে ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছেন, সেকথা অস্বীকারের উপায় নেই বলে মনে করেন অপূর্বানন্দ। তবে শার্জিল আজও জেলবন্দি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পরিবারকে চোখের দেখাও দেখতে পাব না, জেলে পচে মরব, এসবের ভয় নেই আমার। ভয় শুধু একটাই যে, মৃত্যুর আগে সন্ত্রাসবাদী নই বলে নিজেকে প্রমাণ করতে পারব না।’’
এই তালিকায় নবতম সংযোজন জিগনেশ। ছাত্র রাজনীতি থেকে দলিত সম্প্রদায়ের নেতা হওয়া পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি সম্প্রতি কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। কানহাইয়া কুমার কংগ্রেসে যোগ দেন যে মঞ্চে, সেখানেও উপস্থিত ছিলেন জিগনেশ। তার পরই শুক্রবার মধ্যরাতে অসম পুলিশ গুজরাতের একটি সার্কিট হাউস থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে। প্রথমে এফআইআর-এর কাগজ পর্যন্ত পুলিশ দেখাতে চায়নি বলে অভিযোগ। পরে কংগ্রেস কর্মীদের বিক্ষোভে যে কাগজ তারা দেখায়, তা থেকে জানা যায় যে, নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে টুইট করায় অসমের এক বিজেপি কর্মী তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। তাতেই গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁকে। আপাতত তিন দিনের পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন জিগনেশ। উৎসবের মরশুমে একের পর এক রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটলেও, নরেন্দ্র মোদির নীরবতা নিয়ে টুইটারে প্রশ্ন তুলেছিলেন জিগনেশ। জানা গিয়েছে, মোদিকে ‘গডসে ভক্ত’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন জিগনেশ। তাতেই গুজরাত থেকে অসমে তুলে আনা হয় তাঁকে।
জিগনেশের গ্রেফতারিতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকেই বিঁধেছেন কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী। মোদি যতই চেষ্টা করুন না কেন, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিরুদ্ধ স্বরকে দমানো যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু সত্যিই কি বিরুদ্ধস্বরকে দমানো অসম্ভব! বিগত কয়েক বছর ধরে চলে আসা ঘটনাবলি কিন্তু অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে। উমর, শার্জিল, জিগনেশ শুধু নন, স্ট্যান স্বামীর মতো প্রবীণ সমাজকর্মীকে জীবন দিয়ে মুখ খোলার মাশুল দিতে হয়েছে। সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখার আগুপিছু অনেক প্রভাবশালী মুখ থাকলেও, রেহাই পাননি কেউ। গর্ভবতী অবস্থায় জেলে কাটাতে হয়েছে সফুরা জারগরকে। শুধুমাত্র হাথরস ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে খবর করতে গিয়েছেন বলে আজও বন্দি কেরলের একটি সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সিদ্দিক কাপ্পান। এমনকী, অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও, তাঁকে শিকল পরিয়ে রাখা হয় বলে জানা যায়।
গণতন্ত্রে বিরুদ্ধ স্বরের গুরুত্ব নিয়ে বছরখানেক আগে মুখ খুলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। বিরোধিতার সুর চাপা দিতে সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘অসন্তোষের স্বরকে চাপা দিতে অথবা নাগরিকদের হয়রান করতে যেন সন্ত্রাস-বিরোধী আইন-সহ অপরাধ আইনের অপব্যবহার না হয়।’’ একদিনের জন্য হলেও কাউকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রাখা গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের জন্য যথেষ্ট বলেও মন্তব্য করেন তিনি। প্রতিবাদের অধিকার এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মধ্যেকার ফারাক বোঝা প্রয়োজন বলে বছরখানেক আগে দিল্লি হিংসা মামলার শুনানিতেই মন্তব্য করে সেখানকার হাই কোর্ট। কিন্তু সরকারবিরোধী অবস্থান নিলেই যেভাবে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে, বছরের পর বছর শুনানি চলছে, উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও বারবার খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে জামিনের আর্জি, তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে নাগরিকের অধিকার নিত্যদিন পদপিষ্ট হয়ে চলেছে বলে মনে করছেন সমাজ-সচেতন মানুষজন।