রুপোলি পর্দায় 'বিদ্যাসাগর' তিনিই, অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি ভুলেছে বাঙালি?

Actor Satya Bandyopadhyay : সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় নামটা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির ছবি। নিতান্তই সাদামাটা মানুষ, সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকত। আর পরনে থাকত চিরকেলে সাদা ধুতি আর বাংলা শার্ট।

সকাল দশটায় রিহার্সাল, অথচ আধ ঘণ্টা আগেই এসে হাজির তিনি। পাছে অভিনয়ের এক মুহুর্ত সময়ও নষ্ট হয়ে যায় সেই জন্য হাতে সময় নিয়েই পৌঁছে যেতেন মঞ্চে। তারপর গোটা দিনটা নিজেকে ঢেলে দিতেন। মঞ্চের এক পাশে নিজেকে সরিয়ে এনেও অনবদ্য অভিনয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া কালজয়ী এই অভিনেতার নাম সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়।

সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, এই নামটা মনে এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির ছবি। নিতান্তই সাদামাটা মানুষ, সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকত। আর পরনে থাকত চিরকেলে সাদা ধুতি আর বাংলা শার্ট। ১৯৩৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিহারের পাটনায় জন্ম হয় অভিনেতার। পিতা ছিলেন অতুলদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা অমিয়া দেবী। স্কুল জীবন শুরু হয় উত্তর প্রদেশের লখনউ-এ। সেখানকার অ্যাংলো-বেঙ্গলি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর কলকাতায় আসেন। কলকাতায় এসে থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর এলাকার 'বসুশ্রী' সিনেমা হলের পাশের গলিতে। কলেজের পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন আশুতোষ কলেজে, তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ পাশ করেন তিনি।

আপাদমস্তক শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং বই পাগল এই মানুষটি ছিলেন কালজয়ী অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। উপরন্তু ছিলেন প্রকৃত অর্থেই সত্যের পূজারী এবং নিপাট ভদ্রলোক। ছোট থেকেই ছিল থিয়েটারের প্রতি ঝোঁক। তার ওপর অমন স্পষ্ট বাংলা এবং ইংরেজি উচ্চারণ এবং ভগবান প্রদত্ত জিভ, স্বাভাবিকভাবেই অভিনয় জীবনের সাফল্যের ক্ষেত্রে খানিকটা এগিয়ে দেয় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিংবদন্তি নাট্যকর্মী উৎপল দত্তের অনুরাগী এবং চরিত্র অভিনেতা রবি ঘোষের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। একসঙ্গে নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন তাঁরা। এমনকী প্রাণের বন্ধু রবি ঘোষকে অভিনয়ের জন্য হাত ধরে তিনিই নিয়ে আসেন গুরু উৎপল দত্তের কাছে।

আরও পড়ুন - গায়ে আঁটত না ‘বড়দের’ জামা! রবি ঘোষ যেভাবে রয়ে গেলেন বাঙালির মনে

থিয়েটার দিয়ে অভিনয় জীবনের সূচনা হলেও বড় পর্দাতেও তাঁর ছিল অনায়াস যাতায়াত। রুপোলি পর্দায় আগমন হয় স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই। ১৯৭৬ সালে ‘জন অরণ্য’ ছবি দিয়ে। এর পর অবশ্য মৃণাল সেন, উমানাথ ভট্টাচার্য্য, তরুণ মজুমদার প্রমুখ পরিচালকের পরিচালনায় একের পর এক অভিনয় করে গিয়েছেন। একটা সময় ছিল, নায়ক নায়িকার বাবার চরিত্রে পরিচালকের পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে থাকতেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘উল্কা’, ‘বালিকা বধূ’, ‘শেষ থেকে শুরু’, ‘কুহেলী’, ‘জন অরণ্য’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘আতঙ্ক’, ‘বৌমা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ইত্যাদি ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করেছেন তিনি। তবে রুপোলি পর্দায় তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ শরৎচন্দ্রের পথের দাবী গল্প অবলম্বনে ‘সব্যসাচী’, ওই ছবিতে তাঁর অভিনয় আজীবন অমর হয়ে থাকবে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।

রুপোলি পর্দায় পরিচিতি বেশি হলেও তাঁর অভিনয় জীবনের স্বার্থকতা কিন্তু মঞ্চেই। তাই থিয়েটারকে আঁকড়ে থেকেছেন সবসময়। ১৯৫২ সাল অর্থাৎ অভিনেতার বয়স যখন সবে ১৯ বছর তখন থেকেই উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার গ্রূপ এবং পিপলস্ লিটল থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন তিনি। উৎপল দত্তের সান্নিধ্যে নিজেকে গড়ে পিটে নেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। উৎপল দত্তের নির্দেশনায় ‘ব্যারিকেড’, ‘তিতুমীর’, ‘নীল সাদা লাল’, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘দৈনিক বাজার পত্রিকা’, ‘অগ্নিশয্যা’, ‘একলা চলো রে’, ‘লেনিন কোথায়?’, ‘লাল দূর্গ’, ‘জনতার আফিম’, ‘একেই কী বলে সভ্যতা?’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’, ‘কল্লোল’, এবং ‘ফুলবাবু'; থিয়েটারে একের পর এক অনবদ্য অভিনয় দিয়ে রীতিমতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। এরপর উৎপল দত্ত মারা যাওয়ার পর পি.এল.টি নাট্য দলেই সমীর মজুমদার এবং আরও দু-একজন নির্দেশকের নির্দেশনায় অভিনয় করেছিলেন ‘ক্ষমা করবো না’, ‘দিল্লী চলো’, ‘বণিকের মানদণ্ড’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটি প্রযোজনায়। এখানেই শেষ নয়, ‘ব্যারিকেড’ নাটকে অটোবিরখোলৎস চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও ১৯৭৬ সালে পেয়েছিলেন বি.এফ.জে.এ পুরস্কার এবং ১৯৯৬ সালে মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার’।

আরও পড়ুন - অভিনয়ে বাজিমাত করল চিল, উৎপল দত্ত বললেন, ‘অবিশ্বাস্য’

তাঁর অভিনয় জীবনের আরও একটি দিক হল বেতারে অভিনয় দক্ষতা। কণ্ঠস্বর ছিল এতোটাই তুখোড় যে সেখানেও তাক লাগাতে বেশি সময় লাগেনি। বেতারে সমরেশ ঘোষ নির্দেশিত একাধিক চরিত্রে সত‍্য বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অনবদ্য। বনফুলের ‘বিদ‍্যাসাগর’-এ বিদ‍্যাসাগর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শ‍্যামসাহেব’ উপন্যাসের নাট‍্যরূপে শ‍্যামসাহেব, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ কৃষ্ণকান্ত, ‘কমলাকান্তের জবানবন্দি’-তে কমলাকান্ত -এর মতো অসংখ্য চরিত্রে নিজের অভিনয় দক্ষতার বৈচিত্র্যময় দিকটি ফুটিয়ে তোলেন অনায়াসেই।

আজীবন একজন পজিটিভ মানুষ ছিলেন ঠিকই তবে অভিনয়ের খাতিরে নেগেটিভ চরিত্রও করেছেন বেশ কিছু। অভিনয় যে তাঁর মর্মে মর্মে প্রোথিত ছিল তার প্রমাণ মেলে সেখানেই। রবীন্দ্রনাথের ‘ত‍্যাগ’ গল্পের নাট‍্যরূপে প্রতিহিংসাপরায়ণ বাবার চরিত্র অথবা মহাশ্বেতা দেবীর ‘বেহুলা’ গল্পের নাট‍্যরূপে এক অসৎ মহাজনের চরিত্র, সবেতেই তিনি ছিলেন অনবদ্য।
অভিনেতা হিসেবে প্রযোজকের নির্দেশনাকে অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখতেন এবং স্ক্রিপ্টের সংলাপের লাইনে লাইনে নোট করতেন। শুধু অভিনয় নয়, কলমেও সাংঘাতিক ধার ছিল তাঁর। হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ওপর তাঁর লেখা নাটক ‘সূযার্স্ত’ সমরেশ ঘোষের নির্দেশনায় প্রচারিত হয় ১৯৯২ সালে। এখানেই শেষ নয়, জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত সমরেশ ঘোষের আরও কয়েকটি নাটকের ইংরেজিতে অনুবাদও করে দিয়েছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৬ সালের ৩০ জানুয়ারি ৭৩ বছর বয়সে মারা যান কিংবদন্তি এই অভিনেতা।

More Articles