কুমিরকে ভোগ দিয়ে লাশ লোপাট! ভারতীয় সিরিয়াল কিলার চিকিৎসকের গল্প হার মানাবে ক্রাইম থ্রিলারকে
Doctor Death Serial Killer: মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হত কাসগঞ্জের হাজরা খালে, যে খাল থেকে কুমির উঠে এসে মাঝে মাঝে গ্রামবাসীদের ঘরবাড়িতে বিশ্রাম নেয়। ট্যাক্সিচালকের মৃতদেহ লোপাট করার কাজটা সহজ করে দিয়েছিল কুমিরের দল।
নাম দেবেন্দ্র শর্মা। বয়স ৬২। পেশা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। ভুল হল, পেশায় আসলে সে একজন খুনি। বলা ভালো, সিরিয়াল কিলার মাস্টারমাইন্ড। ডাক্তার বলতে প্রথমেই চোখের সামনে কী ভেসে ওঠে? সাদা কোট পরা, গলায় স্টেথোস্কোপ নিয়ে প্রতিনিয়ত কয়েক দল মানুষ মৃত্যুপথযাত্রী মানুষদের বাঁচাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নিজের শরীরের চিন্তা নেই, কাজের কোনও বিরাম নেই, সারাক্ষণ শুধু রোগীর চিন্তা। প্রায় সমস্ত চিকিৎসকদের রোজনামচা এটাই। কিন্তু ডাক্তারের পেশার সংজ্ঞাটাই পাল্টে যায় যখন মানুষের জীবন বাঁচানোর পরিবর্তে কোনও ডাক্তার মানুষের জীবন নিয়ে বিকিকিনির খেলায় মেতে ওঠে। সেরকমই এক ডাক্তার হলেন দেবেন্দ্র শর্মা। কীভাবে একজন চিকিৎসক থেকে পেশাদার সিরিয়াল কিলার হয়ে উঠলেন তিনি, সেই কাহিনি তাবড় তাবড় ক্রাইম থ্রিলারকেও হার মানাবে।
দেবেন্দ্র শর্মা সত্যি সত্যিই ডাক্তার। নিরীহ চেহারা, চোখে চশমা, মাঝারি উচ্চতা। তাঁর নামের পাশে রয়েছে আয়ুর্বেদ ও সার্জারির ডিগ্রি। মাঝে মাঝে ক্লিনিকও চালিয়েছেন। কিন্তু ডাক্তার হিসেবে সুনামের বদলে জুটেছে ‘দুর্নাম’। দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থানের মতো রাজ্যে দেবেন্দ্রের নামে যে কত অভিযোগ জমা আছে তার খোঁজ পুলিশও ঠিক জানে না। খুন, অপহরণ, কিডনি পাচার, ভুয়ো এলপিজি এজেন্সি– অজস্র মামলা তাঁর নামে।
চিকিৎসক থেকে কিডনি পাচার
আলিগড়ের পুরেনি গ্রামে দেবেন্দ্রর আদি বাড়ি। সালটা ১৯৮৪। বিহারের সিওয়ান থেকে ডাক্তারি পাশ করেন দেবেন্দ্র, তারপর সোজা চলে যান রাজস্থানের জয়পুরে। সেখানে গিয়ে নিজের ক্লিনিক খুলেছিলেন তিনি। এরপর ১৯৯২ সালে গ্যাসের ডিলারশিপ নেওয়ার জন্য ১১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন কিন্তু তাঁর সেই ব্যবসা চলেনি। চরম আর্থিক সংকট নেমে আসে জীবনে। সেই বিপুল ক্ষতি সামাল দিয়ে আলিগড়েই ভুয়ো এলপিজি সংস্থার কারবার শুরু করেন। পুলিশ জানিয়েছে, অনেক অনেক টাকা উপার্জনের জন্যই অপরাধের পথ বেছে নিয়েছিলেন দেবেন্দ্র। ১৯৯৪ সালে তিনি প্রথম আন্তঃরাজ্য কিডনি পাচারের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। এই চক্রটি মূলত জয়পুর, বল্লভগড় এবং গুরুগ্রাম থেকে পরিচালনা করা হত।
আরও পড়ুন- ‘ভালো লাগে, তাই মারি’, আট বছর বয়সি সেই সিরিয়াল কিলারের গল্প শুনলে শিউরে উঠবেন
আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেবেন্দ্রর প্রথম পক্ষের স্ত্রী তাঁদের বিয়ের ১৬-১৭ বছর পরেই তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিলেন। পুলিশের কথা অনুযায়ী, উত্তরপ্রদেশে নিজের বাড়ি ছেড়ে দিল্লিতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। তারপর এক বিধবা মহিলাকে বিয়ে করে জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার চেষ্টা করছিলেন। আরম্ভ করেছিলেন জমি-বাড়ির কারবার। পুলিশের আরও মত, দেবেন্দ্রর অন্ধকার জগতের খবর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী খুব ভালো করেই জানতেন।
১৯৯৪ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ১২৫ জনেরও বেশি মানুষের কিডনি অস্ত্রোপচার করে পাচার করেছেন। আর প্রতিটি কাজের জন্য পারিশ্রমিক পেতেন ৫-৭ লাখ টাকা। ২০০১ সালে উত্তরপ্রদেশেরই আমরোহাতে আরও একটি ভুয়ো গ্যাস এজেন্সি খোলেন তিনি। পরে সেই অভিযোগে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। সেই এজেন্সি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফের জয়পুরে গিয়ে ক্লিনিক শুরু করেন। সালটা ২০০৩। পুলিশ সূত্রে খবর, ক্লিনিক চালানোর পাশাপাশি কিডনি পাচারের কাজ করে আর্থিক দিক থেকে বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন দেবেন্দ্র। কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হননি। আরও অর্থ উপার্জনের লোভে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ এবং খুন করার কাজে নেমে পড়েন। ইতিমধ্যেই তাঁকে এ কাজে সাহায্য করার জন্য বেশ কয়েকজন সঙ্গী জুটিয়ে ফেলেছিলেন দেবেন্দ্র।
কিডনি পাচার থেকে সিরিয়াল কিলার মাস্টারমাইন্ড
এরপরের ঘটনাক্রম ভয়াবহ। দিল্লির ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন এই চিকিৎসক। আতঙ্কের অপর নাম ছিল দেবেন্দ্র শর্মা। কিন্তু তাঁর শিকার কোনও নারী বা অল্পবয়স্ক মহিলা নন। তিনি শিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নিরীহ ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং ট্রাক চালকদের। কারণ এখনও সুস্পষ্ট নয়।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঠিক কতজনকে খুন করেছেন গুণতে গিয়ে বারবার গুলিয়ে ফেলছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক দেবেন্দ্র শর্মা। বারবার ৫০-এ গিয়েই থেমে যাচ্ছিলেন তিনি। অনেকবার মনে করার চেষ্টা করেও শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে পুলিশকে জানান, এরপরে আর কতগুলো খুন করেছেন, সেই সংখ্যাটাই নাকি মনে করতে পারছেন না! যুক্তি দিয়েছিলেন, মার্ডারের সংখ্যা ৫০ পেরোনোর পরই গোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন হল, কীভাবে এই সমস্ত খুন তিনি করতেন? যার প্রমাণ জোগাড় করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে পুলিশকে।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক দেবেন্দ্র শর্মা এবং তাঁর দলের কীর্তিকলাপের কাহিনি বর্ণনা করেছেন দিল্লি পুলিশের ডিসি রাকেশ পাওয়েরিয়া। তাঁর মতে, দেবেন্দ্র নিজের হাতে হয়তো খুন করতেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন দলের পাণ্ডা বা মাস্টারমাইন্ড। উত্তরপ্রদেশের কাসগঞ্জে ডাক্তারের দলের লোকেরা যাত্রী সেজে ট্যাক্সিতে বসত। তারপর নিরিবিলি কোনও জায়গায় ট্যাক্সি থামানোর জন্য অনুরোধ করতেন। এরপরে চালককে খুন করে ট্যাক্সিটা নিয়ে পালিয়ে যেতেন। মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হত কাসগঞ্জের হাজরা খালে, যে খাল থেকে কুমির উঠে এসে মাঝে মাঝে গ্রামবাসীদের ঘরবাড়িতে বিশ্রাম নেয়। ট্যাক্সিচালকের মৃতদেহ লোপাট করার কাজটা সহজ করে দিয়েছিল কুমিরের দল। আর ট্যাক্সিগুলোকে কাসগঞ্জের কোনও গ্রাহকের কাছে বেচে দেওয়া হত ২০-২৫ হাজার টাকায়। এলপিজি সিলিন্ডার বোঝাই আস্ত ট্রাকও লুট হত একই ভাবে। চালককে মেরে ফেলা হত, তারপর ডাক্তারের ভুয়ো গ্যাস এজেন্সিতে নামানো হত সিলিন্ডার। এরপর ট্রাকগুলোকে মেরঠে নিয়ে গিয়ে ভেঙে ফেলা হত।
এইভাবেই ধীরে ধীরে নিজের ত্রাস বাড়াচ্ছিলেন দেবেন্দ্র শর্মা। ২০০২ থেকে ২০০৪ এই দুই বছরে ৫০টির বেশি খুন, তাও আবার একই কায়দায়। এই দুই বছর একজন খুনির খোঁজে ভারতীয় দিল্লি পুলিশের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। খুনি বা খুনের পরিকল্পনাকারী যে একজনই, পুলিশের কাছে তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কখনও খুনির শিকার ট্রাকচালক, কখনও বা ট্যাক্সি ড্রাইভার, কখনও আবার অন্য কেউ। দিল্লির নির্জন রাস্তা হয়ে ওঠে আতঙ্কের এক নাম। ততদিনে ওই মাস্টারমাইন্ডের অপরাধের সীমানা ছড়িয়েছে দিল্লি ও শহরতলি ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতেও। শেষ পর্যন্ত খুনের ধরনই ধরিয়ে দিয়েছিল সেই খুনিকে। কিন্তু পুলিশ আরও আশ্চর্য হয় যখন জানতে পারে ‘খুনি’ পেশায় একজন আয়ুর্বেদ চিকিত্সক।
আরও পড়ুন- ৬৫০ খুন করেছিলেন! পৃথিবীর প্রথম সিরিয়াল কিলারের গল্প হাড় হিম করে দেবে
পুলিশের আরও দাবি, কোনও কাকপক্ষীতেও টের পায়নি যে জয়পুরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার চেম্বার খুলে বসা ডাক্তার আলিগড়ে ট্যাক্সি ছিনতাইয়ের গ্যাং চালাচ্ছে। তার কলকাঠিতেই খুন হচ্ছে একের পর এক নিরীহ মানুষ। ২০০৪ সালে ফের তাঁকে কিডনি পাচার চক্রের মামলায় গ্রেফতার করা হয়। আর তখনই অতীতের সমস্ত অপরাধ সম্পর্কে অবগত হয় পুলিশ।
২০০৪ সালে গ্রেফতারের পরে আদালত তাঁকে ১৬ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে ২০ দিনের প্যারোলে ছাড়া হয়। পরে দেখা যায়, ২০ দিন অতিক্রম হয়ে গেলেও দেবেন্দ্রর কোনও পাত্তা নেই। নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। গোপন সূত্রে পুলিশ দেবেন্দ্রর আত্মগোপনের ঠিকানা পায় এবং তাঁকে সেখান থেকে আবার গ্রেফতার করে পুলিশ।
আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত অনেক খুনের মামলায় দেবেন্দ্র অভিযুক্ত হলেও মোটে ৬-৭ টা কেসে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ২০২০ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে একদম ঠান্ডা মাথায় নিজের অপরাধের কাহিনি তুলে ধরেছিলেন ‘আয়ুর্বেদিক ডাক্তার দেবেন্দ্র শর্মা’। আর তখনই বলেছিলেন, “৫০ ছাড়ানোর পর খুনের হিসাব রাখা ছেড়ে দিয়েছি।”
১০০-র বেশি খুন, কুমিরকে ভোগ দিয়ে দেহ লোপাটের চেষ্টা, ঠান্ডা মাথায় খুন– এই ছিল কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার দেবেন্দ্র শর্মা। সবশেষে বলা যায়, একজন ডাক্তারের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি। যে ডাক্তারের কাছে মানুষ ভরসা করে, বিশ্বাস নিয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে যায় সেই ডাক্তারই একসময় রক্ষকের বদলে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।