জম্মুতে ফের জঙ্গিহামলা, সেনার মৃত্যু! কেন আবার আগের মতোই অশান্ত উপত্যকা?

Doda Kashmir Tigers Attack: ৯ জুন থেকে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জম্মুতেই কেবল পাঁচটি সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে, যাতে আটজন নিরাপত্তা কর্মী এবং ১০ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে।

একটি হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই অন্য! দীর্ঘদিন পর 'অশান্ত কাশ্মীর' শব্দবন্ধটি যেন ফিরে আসছে আবার, জায়গা করে নিচ্ছে দেশের তাবড় সংবাদপত্রের শিরোনামে। কাশ্মীরকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে চেয়ে। জম্মু কাশ্মীরকে দেশের অন্য অংশের মতো ভয়মুক্ত করতে ৩৭০ ধারা বাতিল করেছিল কেন্দ্র, পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, নির্বাচন স্বাভাবিক করা হয়েছিল। অথচ কাশ্মীর আছে কাশ্মীরেই। মঙ্গলবার ভোরে জম্মু ও কাশ্মীরের ডোডা জেলায় সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছেন পাঁচ সেনা। তিন সেনা জওয়ান এবং একজন সেনা আধিকারিকের মৃত্যু হয়েছে। কিছুদিন আগেই কাঠুয়া জেলায় জঙ্গি হামলায় শহিদ হন ৫ ভারতীয় জওয়ান, আহত হন আরও ৫। কাঠুয়া জেলার মাছেদি এলাকায় ভারতীয় সেনার কনভয়ে হামলা চালানো হয়েছিল।

একের পর এক হামলা চলছে ভূস্বর্গে। ডোডা জেলার এই হামলাতেও পাকসমর্থিত সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী জয়শ-ই-মহম্মদের (জেএম) অংশ 'কাশ্মীর টাইগার্স' এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। এই 'কাশ্মীর টাইগার্স' সেই একই জঙ্গিগোষ্ঠী যারা আগে ৯ জুলাই কাঠুয়ায় সেনা কনভয়ে হামলার দায় স্বীকার করেছিল।

সোমবার সন্ধ্যায় ডোডা শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরে দেশা বনাঞ্চলের ধারি গোটে উরারবাগিতে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের রাষ্ট্রীয় রাইফেলস এবং স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের সৈন্যরা যৌথ তল্লাশি অভিযান শুরু করলে এই সংঘর্ষটি ঘটে। কিছুক্ষণ চলে গুলি বিনিময়। সন্ত্রাসবাদীরা পালানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু এক সেনা অফিসারের নেতৃত্বে সৈন্যরা তাদের তাড়া করে। প্রতিকূল ভূখণ্ড এবং ঘন গাছের জঙ্গল সত্ত্বেও, রাত্রি ৯ টা নাগাদ আবারও গুলির লড়াই শুরু হয়। এই এনকাউন্টারে পাঁচজন সেনা গুরুতর আহত হন। সেনা আধিকারিক সহ তাদের মধ্যে তিনজন পরে আহত হয়ে মারা যান।

আরও পড়ুন- কাশ্মীর থেকে ছত্তীসগঢ়: সংবিধানের দিকে তাকিয়ে রণক্লান্ত ভারতীয়রা

জঙ্গিগোষ্ঠী 'কাশ্মীর টাইগার্স' পরে একটি বিবৃতিতে বলেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী 'মুজাহিদিনদের' জন্য তল্লাশি অভিযান শুরু করার সময়ই এই সংঘর্ষ ও বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সন্ধ্যা ৭.৪৫ মিনিট নাগাদ দেশা বনাঞ্চলে অনুসন্ধান অভিযান শুরু করার পরই বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় ২০ মিনিটের গুলির লড়াইয়ে সেনারা আহত হন। সেনাবাহিনীর খবর, দুই থেকে তিনজন সন্ত্রাসবাদী ওই এলাকায় লুকিয়ে আছে বলে খবর পাওয়াতেই অভিযান চলছিল।

সেনাবাহিনীর ১৬ কর্পস, যা হোয়াইট নাইট কর্পস নামেও পরিচিত, রাত ৯ টার দিকে জঙ্গিদের সঙ্গে আবারও বন্দুকযুদ্ধে নামে। হোয়াইট নাইট কর্পস বলছে, অতিরিক্ত আরও সেনা ওই এলাকায় পাঠানো হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই জম্মু অঞ্চলের বেশ কয়েকটি জায়গায় সন্ত্রাসবাদী হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর হাই অ্যালার্ট জারি রয়েছে। গত ১৪ জুলাই ভারতীয় সেনাবাহিনী কুপওয়ারা জেলায় নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর জঙ্গি অনুপ্রবেশের একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে এবং তিন জঙ্গিকে গুলি করে হত্যা করে।

গত ৮ জুলাই, কাঠুয়া জেলার এক দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় সন্ত্রাসবাদীরা একটি সেনা কনভয়ে অতর্কিত হামলা চালালে একজন জুনিয়র কমিশনড অফিসার সহ পাঁচজন সেনা কর্মী মারা যান এবং আরও অনেকে আহত হন।

গত ৬ জুলাই, কুলগাম জেলায় দু'টি বন্দুকযুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ছয় জঙ্গি নিহত হয়। পৃথক একটি এনকাউন্টারে দুই জওয়ান প্রাণ হারিয়েছেন।

এই ডোডাতেই গত ২৬ জুন নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তিনজন জঙ্গি নিহত হয়। সেনাবাহিনী চার সন্ত্রাসবাদীকে নিয়ে একটি আস্তানা ঘেরাও করার পর বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে।

৯ জুন থেকে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জম্মুতেই কেবল পাঁচটি সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে, যাতে আটজন নিরাপত্তা কর্মী এবং ১০ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। গত তিন বছর ধরে জম্মু অঞ্চলে জঙ্গিদের কার্যাকলাপ ক্রমেই বেড়েছে। ডোডা, কিশতওয়ার, রামবন, কাঠুয়া, উধমপুর এবং রিয়াসি জেলা নিয়ে গঠিত চেনাব উপত্যকায় এবং রাজৌরি ও পুঞ্চ জেলা নিয়ে গঠিত পীর পঞ্জলের দক্ষিণে ক্রমেই জঙ্গিহামলা বাড়ছে। কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদী হামলা সাধারণ ঘটনা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু জম্মুতে জঙ্গি কার্যকলাপের পুনরুত্থান চিন্তার। গত দুই দশকে এই ধরনের ঘটনা থেকে মুক্ত ছিল জম্মু। এই অঞ্চলটি ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ২০০০-এর দশকের শুরুতে জঙ্গি কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থল ছিল। কিন্তু গত ২০ বছরে কাশ্মীরের থেকে শান্ত ছিল এই এলাকা।

আরও পড়ুন- কাঠুয়ায় সেনার উপর হামলা, ৫০০০ রাউন্ড গুলি! কাশ্মীর নয়, কেন জঙ্গিদের নিশানায় জম্মু?

২০২১ সাল থেকে, জম্মু অঞ্চলে ৩১টি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে যাতে ৪৭ জন সেনা এবং ১৯ জন সাধারণ মানুষ মারা গেছেন। ৪৮ জন সন্ত্রাসবাদী বিভিন্ন এনকাউন্টারে নিহত হয়। অন্যদিকে, এই সময়কালে কাশ্মীর উপত্যকায় ২৬৩টি সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ঘটেছে যাতে ৬৮ জন সেনা এবং ৭৫ জন সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে। ২০২১ সাল থেকে এই উপত্যকায় ৪১৭ জন সন্ত্রাসবাদীকেও হত্যা করা হয়েছে৷ পরিসংখ্যান বলছে, জম্মুতে হামলার ঘটনা কাশ্মীর উপত্যকার তুলনায় অনেক কম। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, তা বাড়ছে। কেন?

পূর্ব লাদাখে ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষে ২০ জন সেনা নিহত হন। সেনাবাহিনীর একটি বড় দল জম্মু থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে চিন সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছিল। এর ফলে জম্মুর নিরাপত্তার বেষ্টনী পাতলা হয়ে যায়। সেনা বলছে, যেহেতু কাশ্মীর উপত্যকায় সবসময়ই হাই অ্যালার্ট থাকে তাই জম্মুতে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালানো সুবিধাজনক কারণ নিরাপত্তা তুলনামূলকভাবে কম।

২০১৯ সালের অগাস্টে জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করার পরে বিজেপি সরকার দাবি করেছিল, পাথর ছোড়ার ঘটনা বন্ধ হয়ে গেছে, কোনও ধর্মঘট হচ্ছে না এবং পর্যটনের বিকাশ ঘটেছে ঢের বেশি। কেন্দ্র সরকার সামগ্রিক নিরাপত্তার পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীর উপত্যকায় বিশাল সাফল্য দাবি করে। অথচ জম্মুতে সন্ত্রাসবাদের চাগাড় দেওয়ার ঘটনা সরকারের সেই দাবিকেই ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। বিভিন্ন অনুমান অনুসারে, প্রায় ২০-২৫ জন জঙ্গি পাকিস্তান থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। সীমান্ত থেকে প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরে জঙ্গিদের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। সম্ভবত দু'টি দল রয়েছে, তাদের মধ্যে একটি পশ্চিমে পুঞ্চ-রাজৌরিতে এবং অন্যটি পূর্বে কাঠুয়া-ডোডা-বসন্তগড় অঞ্চলে সক্রিয়। কাঠুয়ায় ৩০-৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কাজ করছে জঙ্গিরা। এই এলাকার বন্ধু ভূখণ্ড, বনভূমি, খারাপ রাস্তা এবং খারাপ মোবাইল সংযোগের কারণে জঙ্গিদের চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

More Articles