রামরাজ্যই সুখরাজ্য? বঙ্কিম থেকে আম্বেদকর, কী বলছেন ওঁরা?
Hey Ram : এই যে হিন্দুত্ববাদীরা ইদানীং বারবার সনাতনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, হিন্দু ধর্মকে সনাতন হিসাবে উল্লেখ করছেন, তা কিসের ইঙ্গিতবাহী?
“কসাই-র ছেলের যদি প্রতিভা থাকে, তাহলে ইউরোপে সে শেক্সপিয়র হইতে পারিত, কিন্তু এদেশে প্রাচীন প্রথা অনুসারে সে ‘রবীন্দ্রনাথ’ বা ‘কালিদাস’ হইতে পারিত না, হইবার চেষ্টা করিলে ভগবানের অবতার রামচন্দ্র স্বয়ং আসিয়া তাহার মাথা কাটিয়া বর্ণাশ্রমধর্ম রক্ষা করিতেন।”
১৯৪৩-এর গ্রীষ্মে, ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত (বর্ষ ২৬; খণ্ড ২) ‘আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দু ধর্ম’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার এই উক্তি বহুল প্রচারিত না হলেও অনেকেই জানেন। যেটা নজর এড়িয়ে যায়, ওই পত্রিকার ওই একই সংখ্যায় ‘জাতিভেদ ও তাহার বিষময় ফল’ শীর্ষক প্রবন্ধে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ও ওই একই প্রসঙ্গ টানছেন।
তিনি লেখেন, “শাস্ত্রের নাকি অনুশাসন আছে- শূদ্রের কর্ণে বেদমন্ত্র প্রবেশ করিলে প্রায়শ্চিতস্বরূপ তাহার কর্ণে তপ্ত তৈল ঢালিয়া দিতে হইবে! আদর্শচরিত্র প্রজানুরঞ্জক রামচন্দ্র শূদ্র হইয়াও তপস্যা করিবার অপরাধে শম্বুকের প্রাণদণ্ড বিধান করিলেন!”
একথা আরও একজন তুলেছেন। খোদ রামরাজ্যের প্রসঙ্গ তুলেই বলেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, প্রাচীন হিন্দু সমাজের শাসক ছিল মূলত ব্রাহ্মণরাই, ক্ষত্রিয়রা নয়। “এখনও যেমন মিলিটরি অপেক্ষা সিবিল কর্মচারীদিগের প্রাধান্য, তখনও সেইরূপ ছিল; রাজপুরুষদিগের মধ্যে ক্ষত্রিয়েরাই রাজা নাম ধারণ করিতেন, কিন্তু কার্যত তাহাদিগের উপরেও ব্রাহ্মণের প্রাধান্য ছিল।” ব্রাহ্মণ আর শূদ্রদের জন্য আইনই আলাদা ছিল। এ প্রসঙ্গেই তিনি সরাসরি প্রশ্ন করছেন, “বাবু দ্বারকানাথ মিত্র প্রধানতম বিচারালয়ে বসিয়া আধুনিক ভারতবর্ষের মুখোজ্জল করিয়াছেন- ‘রামরাজ্যে’ তিনি কোথা থাকিতেন?” প্রসঙ্গত, বিচারপতি মিত্র কায়স্থ ছিলেন।
হিন্দুত্ববাদীরা অবশ্য অদূর ভবিষ্যতে ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করে দিয়েছেন। ২০২০-তে একটি সাক্ষাৎকারে সংঘ প্রধান মোহন ভাগবত বলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরকার কর্তৃক রাম মন্দির ট্রাস্ট গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই রাম মন্দির আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে কিন্তু মন্দির তো একটি প্রতীক, শুধু প্রতীক নির্মাণ করলেই চলবে না, সেই প্রতীক যে নীতি ও আদর্শকে বহন করে, সেই আদর্শ মতো হয়ে উঠতে হবে। রাম হলেন, ভারতের সেই গৌরবশালী অতীতের প্রতীক, যে অতীত আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
আরও পড়ুন- রাম মন্দির উদ্বোধন নিয়ে মোদির পাশে নেই বহু হিন্দুত্ববাদীই! কেন?
‘রাম মন্দির সে রামরাজ্য কি অউর’ শীর্ষক সেই সাক্ষাৎকারে ভাগবত বলেন, রামরাজ্যে জনতা নীতিনিষ্ঠ আর রাজা শক্তিশালী ও নীতিনিষ্ঠ। জনতার কাছে রাজা নম্র, আর রাজাজ্ঞা পালনে জনতাও তাই। মানে, জনতার রাজ না রাজার রাজ, এরকম কোনও প্রশ্নই ছিল না। রাজা বলত, মানুষ যা চাইবে তাই হবে, আর জনতা বলত, রাজা সবই জানেন, তিনি যা করবেন তাই হবে। সেখানে জনগণ নিজেদের জানেন-বোঝেন, অনুশাসিত, সংযমী, জাগরুক ও সংগঠিত, আর রাজা ধর্ম পালন ও ধর্ম রক্ষার জন্য নিবেদিত।
ভাগবত বলেন, এরকম শাসনে রোগভোগ, অসময়ে মৃত্যু, ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকবে না, চুরি-ভিক্ষাবৃত্তি থাকবে না, আর যখন শাস্তি দেওয়ার মতোই কেউ থাকবে না, তখন সাজাই বা আর থাকবে কেন? কিন্তু এই পরিস্থিতিতে পৌঁছনোর জন্য সরকার, প্রশাসন ও সামাজিক সংগঠনের প্রবৃত্তি একই হতে হবে।
বর্তমানে কেন্দ্র ও বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে সরকার ও প্রশাসনের প্রবৃত্তি প্রায় সংঘের মতো সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে এক হয়ে এসেছে বলেই অনেকের প্রত্যয় হয়। সুতরাং, পরিস্থিতি রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল, একথা বলাই যায়। ২০২৩-এর নভেম্বরে, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ বলেন, অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়ে যাবে। তিনি বলেন, “রামরাজ্যের অর্থ হলো জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে যে শাসনে কোনও বিভেদ থাকবে না। বিভিন্ন প্রকল্পের উপকার সবার কাছে পৌঁছবে– গরিব, বঞ্চিত, ও আদিবাসী পর্যন্ত। সবাই পাবে নিরাপত্তা, সুবিধা ও সম্পদের ওপর অধিকার। এই হলো রামরাজ্য।”
যদিও আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে বিভেদহীন শাসন চলছে না বৈষম্যের, তা নিয়ে নানা সংবাদমাধ্যম অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন তুলে চলেছে কিন্তু আপাতত সেটা আমাদের প্রসঙ্গ নয়। ঘটনা হলো, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ভারতীয় রাজনীতির আঙিনায় অবতীর্ণ হয়ে মোহনদাস গান্ধিও সুশাসনের সমার্থক হিসাবে রামরাজ্যেরই আকাঙ্খা করলেন। রামরাজ্য বলতে তিনি বুঝতেন ঈশ্বরের শাসন। “আমার কাছে রাম ও রহিম একই ঈশ্বর,” গান্ধি বলেছিলেন। তাঁর কল্পনার রাম বাস্তবে এ জগতে ছিলেন কিনা সেটা তাঁর কাছে বড় ব্যাপার ছিল না কিন্তু তিনি মনে করতেন রামরাজ্যের প্রাচীন আদর্শ “নির্দ্বিধায় এক প্রকৃত গণতন্ত্র, যেখানে নীচতম নাগরিকও দ্রুত ও খরচহীন একটি পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বিচারের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে।”
একে তিনি রাজা ও নাগরিকের সমানাধিকার হিসাবেও বর্ণনা করেছেন, আবার অন্যত্র একে নীতিনির্ভর শাসন (sovereignty of the people based on pure moral authority) হিসাবেও বর্ণনা করেছেন। তা এক এমন আদর্শ পরিস্থিতি, যেখানে ব্রিটিশ সেনার জায়গায় ভারতীয় সেনা আসাটাই যথেষ্ট নয়, কোনও সেনার উপস্থিতি না থাকাটাই আসল। যেন সেনার উপস্থিতির কোনও প্রয়োজন না পড়ে। কারও উপর কোনওরকম বলপ্রয়োগ না করতে হয়। তাঁর মতে, এমনকী দেশিয় সেনার উপস্থিতিও একটি দেশের নীতিগত স্বাধীনতার পরিপন্থী, কারণ তা দুর্বলতমের নৈতিকতার শিখরে ওঠার পথে বাধাদায়ক।
অবশ্যই এরকম কোনও রামরাজ্যের ভাবনা সংঘ পরিবার বলে না। তাঁদের চিন্তাভাবনায় যে বলপ্রয়োগের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে, তা দেখাই যায়। গান্ধি যদিও অনেকটা রূপকার্থে রামরাজ্যের ব্যবহার করেছিলেন, মহারাষ্ট্রের সমাজ সংস্কারক-শিক্ষাবিদ জ্যোতিবা ফুলে সুশাসনের ভিন্ন নাম দিয়েছিলেন – বলীরাজ্য। রাজা বলীর নামে। কোন বলী? পুরাণের মহাবলী, যাঁর কাছে ভগবান বিষ্ণু তাঁর বামন অবতারে অবতীর্ণ হয়ে ব্রাহ্মণ হিসাবে দক্ষিণা স্বরূপ চেয়েছিলেন মাত্র তিন পা জমি। বলী রাজি হতেই সেই ব্রাহ্মণ বিশাল রূপ ধারণ করে এক পায়ে ঢেকে দিলেন মাটি ও আরেক পায়ে আকাশ। তৃতীয় পা রাখার জন্য বলী তখন নিজের মাথা পেতে দেন। পায়ের চাপে বলি ভূমির গভীরে ঢুকে যান।
যদিও হিন্দু পুরাণে বলীকে অসুর বা দানব হিসাবে দেখানো হয়েছে, ফুলে এই ব্যাখ্যা মানেননি। মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক গেইল ওমভেডত দেখিয়েছেন, ফুলে তাঁর বিখ্যাত গুলামগিরি বইতে বলীকে দৃঢ় ও বীর রাজা হিসাবে বর্ণনা করেন, যিনি ছিলেন গরিবের বন্ধু। আর বামনকে বর্ণনা করেন “নীচ, ধূর্ত, বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ” হিসাবে। ফুলে চেয়েছিলেন বলীরাজের শাসনের আদর্শে অনুপ্রাণিত এক ভারতকে দেখতে, যে বলীরাজের মূল বাণী ছিল, অন্যের কাছে যা আশা করো, অন্যের জন্য আগে সেটাই করো।
ফুলে ব্রিটিশ শক্তির একটি দলিত-প্রধান বাহিনীর হাতে ভীমা কোরেগাঁও-এর যুদ্ধে পেশোয়াদের মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনকে উদযাপন করার মতো ঘটনা মনে করেছিলেন এবং সেটা বঙ্কিমেরও আগে।
হিন্দুত্ববাদীদের বিপুল গৌরবের বিষয় শিবাজি প্রতিষ্ঠিত মারাঠা সাম্রাজ্য, যা এক সময় মুঘলদের প্রবল কোণঠাসা করেছিল। সংঘ পরিবারের মতে, শিবাজি প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দুপাতপাদশাহী’ ছিল প্রকৃত স্বাধীনতা ও রামরাজ্যের প্রতিমূর্তি। ২০১৪-তে সংঘের মুখপত্র অর্গানাইজারে একটি নিবন্ধে বিজেপির রাজ্যসভা সদস্য অনিল দাভে লেখেন, আধুনিক সময়ে রামরাজ্যের মতো শাসনের নিকটতম উদাহরণ হলো শিবাজির মারাঠা সাম্রাজ্য।
কিন্তু ফুলে দম্পতি সেই মারাঠা সাম্রাজ্যকে দেখেছিলেন অন্য চোখে। সেই ১৮৫৫ সালে, মুক্তা সাল্ভে নামে জ্যোতিবা-সাবিত্রীবাই ফুলেদের স্কুলের এক ১৪ বছর বয়সি ছাত্রী ফুলেদের একটি প্রকাশনায় লিখেছিলেন, “পেশোয়া বাজিরাওয়ের সময় কি ওরা (ব্রাহ্মণরা) আমাদের গাধার চেয়েও নিম্নতর ভাবত না? বাজিরাওয়ের শাসনে, কোনও ব্যায়ামখানার পাশ দিয়ে যদি কোনও মাং বা মাহার যেত, তার মাথা কাটা পড়ত। কোনও মাং বা মাহার কোনওভাবে একটু লিখতে পড়তে শিখে নিলে, আর সেই কথা বাজিরাওয়ের কানে গেলে, সে বলত মাং বা মাহারের শিক্ষার অর্থ হলো ব্রাহ্মণদের কাজ কেড়ে নেওয়া।”
রামরাজ্য, যেখানে ব্রাহ্মণদের সর্বোচ্চ স্থান ও উচ্চ বর্ণীয়দের দাপট, তা নিন্মবর্ণীয়, বা অধিকাংশ জনতার জন্য সুখের সময় বলা চলে না মনে করেছিলেন বলেই ভীমরাও আম্বেদকরও তার বিরোধী ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত, লিখিত কিন্ত না-বলা ভাষণ ‘অ্যানিহিলেশন অব কাস্ট’-এ তিনি লেখেন, “রামরাজ ছিল চতুর্বর্ণ-ভিত্তিক রাজত্ব। রাজা হিসাবে চতুর্বর্ণ টিকিয়ে রাখা ছিল রামের দায়িত্ব। সুতরাং, নিজের জাতিগত অবস্থানকে ছাপিয়ে ব্রাহ্মণ হতে চাওয়া শম্বুককে হত্যা করা ছিল তাঁর দায়িত্ব।” অর্থাৎ, জাতি নিপীড়ন ছিল রামরাজ্যের অঙ্গাঙ্গি অংশ।
শুধু রামায়ণ কেন, মহাভারতেও তো গুরু দ্রোণাচার্যের পরিকল্পনায় একলব্যকে গুরুদক্ষিণা হিসাবে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ছেদন করতে হয়৷ কেন? কারণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের উচ্চ স্থান ধরে রাখতে হবে। সেটাই নিয়ম। সেটাই ব্যবস্থা। শাসক শ্রেণির সবাই সেই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতেই প্রতিজ্ঞ। যা চলছে, চলে আসবে।
এই যে হিন্দুত্ববাদীরা ইদানীং বারবার সনাতনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, হিন্দু ধর্মকে সনাতন হিসাবে উল্লেখ করছেন, তা কিসের ইঙ্গিতবাহী? তাঁদের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, তাঁদের কাছে রামরাজ্য, হিন্দু রাষ্ট্র, সনাতন ধর্ম – এসবই সমার্থক। যদিও সংঘের এক প্রচারক আমার কাছে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, “হিন্দু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শিখর ও আদর্শ রূপ হলো রামরাজ্য, যেখানে সনাতন ধর্ম তার পূর্ণ গৌরবে প্রতিষ্ঠিত।”
আদর্শ হিন্দু সন্তান কেমন হবে, তা জানতে হলে আপনাকে জানতে হবে সংঘের বিদ্যা ভারতী পরিচালিত স্কুলে কী শেখানো হয়, আর আদর্শ হিন্দু পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে গেলে কী করতে হবে তা তো সংঘের মহিলা শাখা রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির অধীনস্থ সম্বর্ধীনি ট্রাস্ট জানিয়ে দেবে। নারী অবশ্যই হবে পতিব্রতা, সংস্কারি, সংসারমনস্ক।
অতীতকে অহেতুক গৌরবোজ্জ্বল দেখানোর প্রচেষ্টার সমালোচনা করেছিলেন ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও। তিনি হিন্দুত্ববাদী ছিলেন কিন্তু তার উপরে ছিলেন একজন ইতিহাসবিদ। ১৯৫১ সালে ভারতীয় বিদ্যাভবন প্রকাশিত ইতিহাস সিরিজের বৈদিক যুগ সংক্রান্ত বইয়ের মুখবন্ধতে তিনি লেখেন, প্রাচীন যুগকে অহেতুক গৌরবোজ্জ্বল দেখানোর অর্থ হলো সেই সময়ের যা কিছু খারাপ তাকেও আধুনিক সমাজে মর্যাদা সহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তাছাড়া, হিন্দু ধর্ম আর সনাতন কি এক? হিন্দু মানেই কি বৈদিক? হিন্দু ধর্মে বেদও আছে, আবার উপনিষদে ও কপিলের সাংখ্য দর্শনে বেদ বিরোধিতাও আছে। বর্ণভেদ আছে, ভেদ বিরোধিতাও আছে। আজকের হিন্দুধর্ম বৈদিক ও অনার্য, নানান বিশ্বাস ও পদ্ধতির সংমিশ্রণ। বৈদিক দেবদেবী ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, বায়ু – এঁরা আজ হিন্দুদের ধর্মীয় জীবনে কোথায়?
আরও পড়ুন- আদবানিই গড়েছেন তাঁকে, অথচ কেন গুরুকেই বাতিল করে দিলেন একলব্য মোদি?
ভারতের সনাতন ধর্ম বলতে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন উপনিষদের ঋষিদের চিরন্তন ভেদহীনতার সেই বাণীকে, যা বলে সত্যকে তিনিই জানেন যিনি আপনাকেই জানেন সকলের মধ্যে। কিন্তু সনাতন ব্যবস্থার প্রতি তাঁর কোনও মোহ ছিল না। ধর্মের অধিকার প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “স্থূলতম তামসিকতাই বলে যাহা যেমন আছে তাহা তেমনিই থাক, যাহা বিনাশের যোগ্য তাহাকেও এই তামসিকতাই সনাতন বলিয়া আঁকড়িয়া থাকিতে চায়।” বলছেন, “বস্তুত, অবিচলিত সনাতন প্রথার বড়াই যদি কেহ করিতে পারে তবে সে পশুপক্ষী কীটপতঙ্গ, মানুষ নহে।” লিখছেন, “ভারতের বাণী বহন করে যে-সকল একের দূত (যথা কবীর, নানক, দাদু) এ দেশে জন্মেছেন তারা যে প্রথম হতেই এখানে আদর পেয়েছেন তা নয়।.. আদর না পাওয়াই স্বাভাবিক,কেননা তারা ভেদপ্রবর্তক সনাতনবিধির বাহিরের লোক।”
এ প্রসঙ্গে ১৮৯০-এ প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের মানসী কাব্যগ্রন্থে ‘ধর্ম প্রচার’ কবিতার ব্যাঙ্গ মনে পড়ে যায়–
কোথায় রহিল কর্ম,
কোথা সনাতন ধর্ম!
সম্প্রতি তবু কিছু শোনা যায়
বেদ-পুরাণের মর্ম!ওঠো, ওঠো ভাই, জাগো,
মনে মনে খুব রাগো!
আর্যশাস্ত্র উদ্ধার করি,
কোমর বাঁধিয়া লাগো!কাছাকোঁচা লও আঁটি,
হাতে তুলে লও লাঠি।
হিন্দুধর্ম করিব রক্ষা,
খৃস্টানি হবে মাটি।
দীর্ঘ এই কবিতার শেষাংশ উদ্ধৃত না করে পারছি না। যিশু-প্রচারকের মাথায় লাঠির বাড়ি মারার পর-
স্বামী যবে এল যুদ্ধ সারিয়া
ঘরে নেই লুচি ভাজা!
আর্যনারীর এ কেমন প্রথা,
সমুচিত দিব সাজা।
যাজ্ঞবল্ক্য অত্রি হারীত
জলে গুলে খেলে সবে—
মারধোর ক’রে হিন্দুধর্ম
রক্ষা করিতে হবে।
কোথা পুরাতন পাতিব্রত্য,
সনাতন লুচি ছোকা—
বৎসরে শুধু সংসারে আসে
একখানি করে খোকা।