থাপ্পড়: দ্য পাওয়ার অব কমনম্যান

Kangna Ranaut: একজন বলিউড অভিনেত্রী তথা সদ্য নির্বাচিত সাংসদের একজন সাধারণ সিআইএসএফ জওয়ানের হাতে থাপ্পড় খাওয়া নিয়ে কেন এমন মশগুল হয়ে উঠল গোটা দেশ? হঠাৎই ভাইরাল হয়ে গেলেন কুলবিন্দর।

বিখ্যাত ওটিটি প্ল্যাটফর্মে 'পঞ্চায়েত' সিজন ৩ দেখছিলাম। উত্তরপ্রদেশের একটা আপাত শান্ত নিরিবিলি গ্রাম ফুলেরার কিছু মানুষের গল্পই এই সিরিজের উপজীব্য৷ যাঁরা ইতিমধ্যেই সিরিজটি দেখেছেন, তাঁরা জানেন। যাঁরা দেখেননি, তাঁদের জন্যই বলা। প্রথম সিজন জুড়ে দিব্যি চলেছে গ্রামের মানুষের সুখ দুঃখের গল্প। দ্বিতীয় সিজনে পৌঁছে সেই গল্পেই ভূষণ নামে একটি চরিত্র এসে পড়ে। যে প্রতিমুহূর্তে গ্রামের মানুষের মধ্যে বিবাদ ঘটাতে থাকেন। তৃতীয় সিজনে ভূষণের কূটবুদ্ধি বেড়ে গেল আরও। ক্ষমতার ইপ্সায় এবং পদের লোভে ভূষণ এই সিজনে আরও ক্রূর, আরো শঠ। সিজনের একেবারে শেষ পর্বে যখন ভূষণের প্রশ্রয়দাতা স্থানীয় বিধায়কের সামনেই তাঁকে ঠাঁটিয়ে একটা থাপ্পড় কষায় পঞ্চায়েতের সচিবজি, তখন একটা অদ্ভুত আনন্দ হয় দর্শক হিসেবে। প্রাথমিকভাবে হয়তো সচিবজির চরিত্রের সঙ্গে থাপ্পড় মারাটা খানিক অপ্রত্যাশিত বলেই দর্শক হিসেবে খানিক বিস্মিত হই। কিন্তু সেই বিস্ময়ের রেশ কাটলে বুঝতে পারি, এই থাপ্পড়টাই তো ভূষণের প্রাপ্য। এই থাপ্পড়টা দেখার জন্যই যেন একটা অপেক্ষা, একটা উত্তেজনা ছিল ভিতরে ভিতরে। যখনই ক্ষমতাধরের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এক চূড়ান্ত ঔদ্ধত্যের প্রকাশ হয়, তখন একটা জোড়ালো থাপ্পড় সেই ঔদ্ধত্যের বাঁধ ভেঙে দেয়। ভেঙে দেওয়া জরুরি। এই একটা থাপ্পড়ের জোর বা অভিঘাত অনেক গভীরে। ওয়েব সিরিজের গল্প কোথাও যে বাস্তবের সাথে মিলেমিশে যাবে, তা বোধহয় ভাবেননি স্বয়ং নির্মাতারাও!

কুলবিন্দর কৌর। পাঞ্জাবের সুলতানপুর লোধীর বাসিন্দা। দুই সন্তানের মা কুলবিন্দর বর্তমানে চন্ডীগড় বিমানবন্দরে কর্মরত সিআইএসএফ জওয়ান হিসেবে। বৃহস্পতিবার সন্ধের আগে পর্যন্ত অবশ্য আমরা কেউ-ই জানতাম না কুলবিন্দরের নাম। কিন্তু সেই কুলবিন্দরই হঠাৎ করে চলে এলেন শিরোনামে। এনডিএ-তে নীতীশ কুমার না চন্দ্রবাবু— কার দল দরদাম করে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দফতর বাগাতে পারল, সেসব আলোচনাকে মুহূর্তে দূরে ঠেলে দিলেন কুলবিন্দর। সৌজন্যে একটি 'থাপ্পড়'। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে হিমাচল প্রদেশের মান্ডি থেকে বিজেপির টিকিটে জিতে আসা বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতকে সজোরে একটি থাপ্পড় মেরেছেন তিনি। আইনত তিনি যা করেছেন, তা অন্যায়। কঙ্গনার অভিযোগ, কর্তব্যরত সিআইএসএফ জওয়ান হঠাৎই তাঁকে থাপ্পড় মারেন। আরেকটি মত হলো, কঙ্গনাকে তল্লাশি করার সময় ট্রে-তে তাঁর মোবাইল রাখতে বলায়, সদ্য নির্বাচিতা সাংসদ নাকি তর্ক জুড়ে দেন৷ আর তখনই কুলবিন্দর তাঁকে থাপ্পড় মারেন। কিন্তু, একটি ভিডিওতে কুলবিন্দরকে যা বলতে শোনা যাচ্ছে, তা মারাত্মক! কুলবিন্দর বলছেন, কঙ্গনা কৃষক আন্দোলনকে অপমান করেছিলেন। বলেছিলেন, ১০০-২০০ টাকার লোভে মহিলারা কৃষক আন্দোলনে ভিড় করেছিলেন। কুলবিন্দরের মা স্বয়ং এই কৃষক আন্দোলনের শরিক ছিলেন। তাঁর ভাই শের সিং 'কৃষক মজদুর সংঘর্ষ কমিটি' নামের একটি সংগঠনের নেতা। ফলে কৃষক আন্দোলনকে অপমানের 'শোধ' নিয়েছেন কুলবিন্দর। 'শোধ'৷ শব্দটার অভিঘাত মারাত্মক। কুলবিন্দর আপাতত সাসপেন্ডেড। রাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে হয়তো অনেক ধারায় মামলা রুজু করবে। সেই মামলার ফাঁস গলে বেড়িয়ে আসার প্রক্রিয়াটাও জটিল। সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কুলবিন্দর কৌরকে যেতে হবে এটা নিশ্চিত।

আরও পড়ুন: কঙ্গনাকে যোগ্য জবাব! যে যে প্রশ্ন তুলে দিল কুলবিন্দরের সপাট চড়

কিন্তু হঠাৎ একটা থাপ্পড় কী করে গোটা দেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলো? একজন বলিউড অভিনেত্রী তথা সদ্য নির্বাচিত সাংসদের একজন সাধারণ সিআইএসএফ জওয়ানের হাতে থাপ্পড় খাওয়া নিয়ে কেন এমন মশগুল হয়ে উঠল গোটা দেশ? হঠাৎই ভাইরাল হয়ে গেলেন কুলবিন্দর। কেউ কেউ কঙ্গনার পাশে দাঁড়িয়ে কুলবিন্দরের সমালোচনা করলেন। কিন্তু বেশিরভাগই যেন উল্লসিত! সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা রকম মিম, ট্রোলিং। যেন বারবার ক্ষমতার শীর্ষস্থরের কাছে মার খাওয়া নাচার মানুষগুলো ঠিক এইভাবেই একটা 'থাপ্পড়' মারতে চেয়েছিলেন ক্ষমতাবানদের গালে। নিরস্ত্র মানুষের একটাই হাতিয়ার 'থাপ্পড়'। কুলবিন্দর আসলে সেই সমস্ত হেরে যাওয়া, প্রবল ক্ষমতাধরের সামনে ভয়ে গুটিয়ে থাকা লোকগুলোর প্রতিনিধি। যারা একটু একটু করে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করেছে। ভেবেছে, এইবার সে শেষ দেখে ছাড়বে। কিন্তু প্রতিবারই পিছিয়ে এসেছে শেষমেশ। কখনো অফিসের বস, কখনো পাড়ার ক্লাব বা হাউজিং সোসাইটির সেক্রেটারি, কখনও লোকাল কাউন্সিলর, প্রোমোটার নেতাদের ভয়ে সে সিঁটিয়ে থেকেছে। এক অদৃশ্য ভয় তাঁকে পিছিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতাধরের গালে ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় দিতে গেলে অনেকটা সাহস জড়ো করতে হয়। অকুতোভয় কুলবিন্দর সেই সাহসটা দেখিয়েছেন। নাকি দুঃসাহস?

তিনি পাঞ্জাবের এক কৃষক পরিবারের মেয়ে। সিআইএসএফের জওয়ান। প্রবল ক্ষমতাধরের গালে একটা থাপ্পড় মেরে কুলবিন্দর বুঝিয়ে দিয়েছেন, হেরে যেতে যেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোটাই দস্তুর! হতে পারে, সেই পথ বিপদসংকুল। অনেক কাঁটা বিছানো, বন্ধুর। কিন্তু তবুও সেই পথে কখনও কখনও হাঁটতে হয়। সংখ্যাগুরুকেও কখনও কখনও তাঁর সীমাটা বুঝিয়ে দিতে হয়।

আসলে কঙ্গনা-সহ বিজেপির বহু নেতানেত্রীই ভারতবর্ষের বুকে ঘটে যাওয়া এই কৃষক আন্দোলনকে কখনও খালিস্তানি আন্দোলন বলেছেন। কখনও ১০০-২০০ টাকা নিয়ে মহিলারা আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন বলে অপমান করেছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেই সে 'আন্দোলনজীবী'। প্রতিবাদী যদি ধর্মে 'শিখ' হয়, তবে সে 'খালিস্তানি'। বাঙালি হলে 'বাংলাদেশী'। মুসলিম হলে 'পাকিস্তানি', বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ছেলেমেয়ে থেকে বুদ্ধিজীবীরা 'আরবান নকশাল'! এই যে দাগিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা গত দশ বছর ধরে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং কঙ্গনাদের মতো মানুষেরা চালু করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধেই যেন কুলবিন্দরের এই থাপ্পড়। কিন্তু একটা থাপ্পড়ের চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল সেই থাপ্পড়ের অভিঘাত। দিল্লি পৌঁছে কঙ্গনা সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তিনি ভালো আছেন। সুস্থ আছেন। সুস্থ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ঘটনার যে অনুরণন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো, তা কি মুছতে পারবেন কঙ্গনা?

এই যে শাসকের উপরে এক প্রবল ক্ষোভ, দিনের পর দিন ধরে একের পর এক অপমানজনক মন্তব্য, তা তো শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নয়। কঙ্গনা-সহ বিজেপি নেতা-নেত্রীদের একেকটা মন্তব্য আসলে দেশের ইতিহাস,দেশের সংবিধানকেই চ্যালেঞ্জ করে। ইতিহাসকে মুছে দিয়ে এক নয়া গৈরিক ইতিহাস রচনায় ব্রতী হতে চান নরেন্দ্র মোদি। কঙ্গনা রানাউত যখন বলেন '১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃত স্বাধীনতা এসেছে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে', তখন এই মন্তব্য কেবল কংগ্রেস-গান্ধি-নেহরুকেই অপমান করে না। এই মন্তব্য আসলে এ দেশের লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামী, তাদের পরিবারকে অপমান করে। কঙ্গনা নিশ্চিতভাবেই গণেশ ঘোষকে চেনেন না। হেমচন্দ্র কানুনগো, উল্লাসকর দত্ত-রা তাঁর জ্ঞানের পরিধির বাইরে। কিন্তু কঙ্গনার এহেন মন্তব্যেও বিচলিত হয় না দেশের শাসক দল বিজেপি। উল্টে তাঁকে লোকসভার টিকিট দিয়ে তাঁর সীমাহীন স্তাবকতাকে স্বীকৃতি দেন মোদি-শাহরা! কঙ্গনাও ৭৪ হাজার ভোটে জিতে তাঁর উপরে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থা-ভরসার মান রেখেছেন। কিন্তু সেই জয়ের রেশের মধ্যেই এক সামান্য সিআইএসএফ জওয়ানের হাতের থাপ্পড় সাংসদ হিসেবে তাঁর নয়া ইনিংস শুরুর আগেই যেন খানিকটা দাগ রেখে দিয়ে গেল। আর সেই থাপ্পড় কঙ্গনাকে সহানুভূতি তো জোগালোই না, উল্টে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এনে দিল প্রবল এক রঙ্গ-রসিকতার উপাদান।

অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। প্রতিভাবান অভিনেত্রী। বলিউডের 'নেপোটিজমে'র বিপক্ষে একের পর এক শানিত আক্রমণ কঙ্গনার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বলিউডের পরিবারতন্ত্রের মধ্যে অজ্ঞাতকুলশীল থেকে অভিনেত্রী হিসেবে চার-চারটি জাতীয় পুরস্কার জিতে নেওয়া! যে কোনো 'স্ট্রাগলিং' অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্য রোল মডেল হতে পারতেন কঙ্গনা। ঝড়ও কম সামলাননি। কিন্ত তবুও সাফল্যকে হাতের মুঠোয় করেছিলেন। কিন্তু ওই যে, ক্ষমতা। এবং নিজেকে এক প্রবল শক্তিধর ভাবার বাসনাই বোধহয় মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনে। কঙ্গনার ক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছে৷

আরও পড়ুন: যে চড় ভুলবেন না কোনওদিনও! কঙ্গনাকে থাপ্পড় মারা সিআইএসএফ কনস্টেবল আসলে কে?

বৃহস্পতিবার সন্ধের পরে কুলবিন্দর কৌর আর কঙ্গনা রানাউত যেন হঠাৎ করেই এক বন্ধনীতে চলে এসেছেন। দু'জনেরই নামের আদ্যাক্ষর 'ক'। দু'জনের নাম পাশাপাশি রেখে অনুপ্রাস করাই যেতো। কিন্তু আপাতত সেই সুযোগ নেই। কারণ, এই মুহুর্তে দু'জনের অবস্থান চরম বিপ্রতীপে।

একজনের অবস্থান ক্ষমতার নিউক্লিয়াসে। অন্যজন আপাতত এক চূড়ান্ত অনিশ্চিত জীবনে। কে বলতে পারে এই কুলবিন্দরই হয়তো ভবিষ্যতে রাজনীতিতে আসবেন না? কিন্তু আপাতত তাঁর জীবনে বহু আইনি জটিলতা। কিন্তু সেসবকে অতিক্রম করে কুলবিন্দর যেন 'কমন ম্যানে'র উদাহরণ হয়ে উঠে এলেন। ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী আর.কে.লক্ষনের বিখ্যাত 'কমন ম্যানে'র মতো আপাত নিরীহ 'কমন ম্যান' নন। বলিউডের নায়িকাকে থাপ্পড় মারা কুলবিন্দর যেন বলিউডি ছবির বিখ্যাত সংলাপের মতোই বলে উঠেছেন, " ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ আ কমন ম্যান''। এক্ষেত্রে কেউ 'ম্যান' কে 'উওম্যান' বলতে পারেন। কিন্তু লিঙ্গ এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আসল ওই 'থাপ্পড়'। যা কঙ্গনা খেয়েছেন। গণতন্ত্রে আসলে এমন কিছু কিছু সময় আসে, যেখানে একেকটা থাপ্পড়ের অনেক বড় ভূমিকা থাকে। সেই থাপ্পড় হয়তো সশব্দ হয় না। পাঁচ আঙুলের দাগ পড়ে না। কিন্তু গণতন্ত্রের থাপ্পড় অনেক বেশী আঘাত আনে শাসকের মসৃণ চেহারায়। পৃথিবীর ইতিহাসে, গণআন্দোলনের ইতিহাসে এমন বহু থাপ্পড় আমরা দেখেছি। যেখানে সংখ্যাগুরুর ঔদ্ধত্য ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছে এক অতিসাধারণ মানুষের সপাট থাপ্পড়ে!

More Articles