অধীন থেকেই স্বাধীন! নেতাজির দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়েছিল গান্ধী-নেহরুর হাত ধরে?

একটি রাষ্ট্রের ওপর অন্যের আধিপত্য। একজনের প্রতি অন্যর অযাচিত আধিপত্য। সমকালীন সেই ভারত ১৯৪৯ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত একপ্রকার এমন স্বাধীনতাই লাভ করেছিল!

আমরা কি সত্যিই স্বাধীন? সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে 'হ্যাজ' নামার মুহূর্তে, বেকারত্ব, দারিদ্র, ক্ষুধা, হাহাকার, রাজকীয় রাজনীতি, অযথা খরচ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মতো দেউলিয়া হওয়ার নানা আশঙ্কার মধ্যেও আজ ঘরে ঘরে পতাকা। তার কারণ, আমরা সবার আগে ভারতীয়। আমরা ভারতের গর্বিত নাগরিক। কিন্তু এসবের মধ্যেও আজ একটু অন্য কথা বলি! আমরা কি সত্যিই স্বাধীন? আপাতার্থে, আঙ্গিকে, বাহ্যিকে আমরা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণে, দাসত্বশৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছি ঠিকই। মনে রেখেছি অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা। কিন্তু এই স্বাধীনতা! যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন খোদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সেই স্বাধীনতা, যা আসলে চেয়েছিলেন দেশের জন্য নিঃস্বার্থ রক্ত ঝরানোর দল! কিন্তু ১৯৪৭-এর পরের কয়েক বছর কী পেতে হয়েছিল? যে ১৫ অগাস্ট আমরা মুক্তির স্বাদ পাচ্ছিলাম, তা আসলে কীসের বিনিময়ে? 

১৯৪৭ সাল। ১৪ অগাস্ট। মধ্যরাত। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জাতির উদ্দেশে বললেন, "মধ্যরাতে যখন সমগ্র বিশ্ব ঘুমায়, তখন আলো আর স্বাধীনতার জন্য ভারত জেগে আছে।" যে জাগ্রত সত্তা আজও প্রতিটি দেশবাসীর মনে গেঁথে রয়েছে। আজ অত্যাধুনিক ভারত স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ উদযাপন করছে। কিন্তু ওই মুহূর্তে যদি সত্যি সত্যি প্রশ্ন করা হত, আমরা কি স্বাধীন, সম্পূর্ণ মুক্ত হলাম?

১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্টের সেই স্বাধীনতা আসলেই আগামী কয়েক বছরের জন্য ছিল এক রূপক! যা দেশবাসীর, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রক্ত জল করার, মৃত্যুবরণ করার আসল পাওনা নয়। কারণ?

আরও পড়ুন: ১৫ অগাস্ট আসলে স্বাধীনতা দিবস নয়! এই দিনটির আড়ালে লুকিয়ে এক অন্য ইতিহাস

আসলে ওই সময়ে ব্রিটেন এবং ভারতের মধ্যে (প্রায় অলিখিত) এক সমঝোতা হয়েছিল 'ডমিনিয়ন' ইস্যুতে। কী এই 'ডমিনিয়ন'? সহজ বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'আধিপত্য'। অর্থাৎ, একটি রাষ্ট্রের ওপর অন্যের আধিপত্য। একজনের প্রতি অন্যর অযাচিত আধিপত্য। সমকালীন সেই ভারত ১৯৪৯ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত একপ্রকার এমন স্বাধীনতাই লাভ করেছিল!

১৯২৬ সালের ব্রিটিশ ইম্পেরিয়াল কনফারেন্সের বর্ণনা অনুযায়ী, 'ডমিনিয়ন' রাষ্ট্রগুলি স্ব-শাসিত হিসেবে তাদের শাসনকার্য পরিচলনা করলেও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত, আইন এবং কিছু বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজার সঙ্গে যোগসাধন ঘটবে অর্থাৎ স্ব-শাসিত, একটি রাষ্ট্র অন্যের অধীনে নয়, মর্যাদাপূর্ণ প্রশাসন চালাতে পারলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজার অঘোষিত 'হস্তক্ষেপ' গুরুত্বপূর্ণ থাকবে তাদের শাসনকাজ পরিচালনায়।

এই দেশ এবং পাকিস্তান এই 'ডমিনিয়ন' স্বীকৃতিলাভেই ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পায়। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হলেও প্রথম একবছর, অর্থাৎ ১৯৪৭-'৪৮ সালে স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। যা ব্রিটিশদের তৎকালীন নীতি অনুযায়ী, একটি 'ডমিনিয়ন' রাষ্ট্রের পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যতম। কারণ, স্বাধীন কিন্তু আধিপত্যপূর্ণ রাষ্ট্রের প্রায় সমস্তরকম সিদ্ধান্ত, নীতি নির্ধারণে গভর্নর জেনারেলের অনুমতি এবং ওই গভর্নরের ক্ষেত্রে ব্রিটেনের রাজার অনুমতি নেওয়া প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল। তাই, ওই সময়কালে ভারতের ক্ষেত্রেও মাউন্টব্যাটেনকে মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর। মহারাজের নামেই কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। অর্থাৎ, স্বাধীন দেশের নীতি নির্ধারণে ঘুরপথে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্রিটেনের সমকালীন রাজা ষষ্ঠ জর্জ!

১৯২৬-এর এই 'ডমিনিয়ন' নীতির পরিবর্তন ঘটে ১৯৪৯ সালের ২৮ এপ্রিল। যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিলন এবং কানাডার প্রতিনিধিদের লন্ডনে বৈঠকের পর সংশোধিত হয় এই নীতি। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে শাসনভার পরিচালনার প্রতিশ্রুতিতেই ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্য থাকা যাবে, এই সিদ্ধান্ত হয়। যার পিছনে, বৈঠকে উপস্থিত নেহরুর বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্য না থাকার বিষয়ে তেমন কোনও উচ‍্যবাচ্য নাকি তিনি করেননি, তাও শোনা যায়। এমনকী, দাবি করা হয়, এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রর দাবি নাকি বহু বছর আগে থেকেই উঠছিল। কিন্তু পূরণ হয়নি।

সত্যিই কি তাই? ২২ জানুয়ারি, ১৯৪৭। ভারতের গণপরিষদে একটি রেজলিউশন পাশ হয়। যেখানে ভারতকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে, এই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এর ক্ষেত্রে সর্বাধিক বাধা হয়ে দাঁড়ায় আধিপত্য তত্ত্ব। যদিও ১৯৪৯ সালে বিষয়টি লন্ডনের দয়ায় পূরণ হলেও এই দেরি নিয়েও ওঠে প্রশ্ন!

জানা যায়, ১৯২৯-এর জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী একটি রেজোলিউশন পেশ করেন। যার বিষয় ছিল, আগামী ১ বছরের মধ্যে ভারতকে 'ডমিনিয়ন' তকমা দিতে চলেছে ব্রিটিশরা। যে রেজলিউশনের তীব্র বিরোধিতা করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন নেহরু। যদিও এই রেজলিউশনের ভিত্তিতে ভোট দেন কংগ্রেস নেতারা। কেন এটিও ভারতের পক্ষে বিপজ্জনক এবং আসল স্বাধীনতার প্রস্তাব নয়, তা নিয়ে সরব হন বহু মানুষ। অনেকেই এর পক্ষেও যান। তাঁদের তরফে দাবি করা হয়, এটি পথের প্রথম ধাপ মাত্র, এভাবেই আসল মোক্ষলাভ সম্ভব। যদিও এর পরেই একটি সংশোধনী আনেন সুভাষচন্দ্র। নেহরু তা সমর্থন করেন। কিন্তু ১৩৫০-এর বিপরীতে ৯৭৩ ভোট পড়ে। সংশোধনী আর সংযোজিত হয়নি। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার, অজস্র সেনাবাহিনীর ব্যবহারে উপকৃত পশ্চিমি দুনিয়া, বিশেষত ব্রিটিশরা চাইছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মিটলেই ভারত-পাকিস্তান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।

শুধু ব্রিটিশ আর তাদের আধিপত্যপূর্ণ রাষ্ট্র নয়। এই দেশের স্বাধীনতার আসল 'হিরো'-দের কথা ভুলে গিয়ে তৎকালীন বর্ধমানের রাজা উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশদের ওই ১৯২৬ সালের বৈঠকে। যেখানে উপস্থিতি এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি ভারতের আনুগত্য নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন ওই রাজা। এর আগে ১৯২০ সাল নাগাদও ভারতের এই স্বীকৃতির পক্ষে মতামত শোনা যায় গান্ধীর তরফে। এদিকে ১৯২৫ নাগাদ লেবার পার্টির খসড়া এবং ১৯২৮ সালে নেহরুর একটি রিপোর্ট কিন্তু এরই পক্ষে বলেছিল বলে দাবি ওঠে। পরবর্তীকালে নেতাজির বিরুদ্ধাচরণ করেন নেহেরু, তাও শোনা যায়।

এদিকে প্রস্তাবের ওপরে মতামত চাওয়া হয়। ১৯৪৭ সালে তৈরি হয় 'ক্রিপস কমিশন'। স্যর স্টাফর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন 'ডমিনিয়ন' ইস্যুকে সমর্থন করে, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (আসলে অযথা নিহত ভারতীয় সৈনিক এবং ভারতকে অপব্যবহারের কালো ইতিহাসের জন্য বলেই মনে করে ঐতিহাসিক মহল) কারণে খানিকটা বিধিনিষেধ রাখা হয়।

এদিকে প্রশ্ন ওঠে, এই নীতিকে, এই শর্তকে, নেতাজিহীন কংগ্রেস কেন মানল? অনেকেই বলেন, সেই সময় শর্তের বিনিময়ে হলেও খানিকটা মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা, এইটুকুর বিনিময়ে দেশের জন্য কিছু করা, এই মনোভাব কংগ্রেস নেতাদের ছিল। যেভাবেই হোক, কিছু অন্তত করতে হবে। এই ভাবনার পাশাপাশি, অনেকেই কংগ্রেসের এই মেনে নেওয়ার পিছনে দেশের স্বার্থ দেখেছেন। দেশের জন্য অন্যান্য যুক্তরাজ্যগুলো একটি নির্দিষ্ট অংশের আওতাধীন এবং কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা, এটাও কিন্তু মাথায় রাখতে হয়েছিল নেতাজি-বিরোধী একটা গোষ্ঠীকে। গান্ধী, নেহরুরা একপ্রকার, দেশের যে-কোনও উপায়ে মুক্তির দিকেই লক্ষ রাখছিলেন। যার ফলে ভারতের মুক্তিলাভ হয় ঠিকই, কিন্তু খানিকটা পাঁকের মধ্যে কাদা, জলের মধ্যে পাঁকের মতো! যার দরুন সব পাওয়ার পরেও ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ পর্যন্ত নিজের মতো করে চলতে, স্বাধীন, স্বশাসিত, হস্তক্ষেপমুক্ত, প্রজাতন্ত্র পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যা স্মৃতির অতলে নিমজ্জিত হয়েছে না করে দেওয়া হয়েছে, না কি সত্যিই এমনটা ছিল তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ক থাকবেও। কিন্তু প্রশ্নও জমা হবে ইতিহাসের অন্দরে।

More Articles