মহারাষ্ট্রের শনি শিগনাপুর - দরজাবিহীন এক গ্রামের গল্প
মহারাষ্ট্রের কথা বলছি। আহমেদনগর জেলা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সির্দির কাছে এক গ্রামের কথা বলছি। কী সেই গ্রাম? শনি শিগনাপুর। কী আছে গ্রামে? উত্তরে বলতে হয়, যা আছে, তার চেয়ে যা নেই তার জন্যই এই গ্রামের পরিচয়। কী নেই? দরজা। চোর। লক। লকার। প্রোটেকশনের প্রয়োজনীয়তা। এইটুকু পড়েই চমকে উঠবেন না প্রিয় পাঠক। মিথ এবং মিথের বাইরে কতটা একই থাকে, কতটা পাল্টে যায়, কতটা মিথ ঢেকে থাকে পশ্চিম ভারতের এক প্রত্যন্ত গ্রামবাসীদের ভেতর? সেই গল্পই হোক ...
কথনের কথা হোক। সে প্রায় বছর চারশ আগের কথা। স্থানীয় পনসনালা নদীর স্রোতে উঠে এসেছিল কালো রঙের এক পাথর। পুকুরপাড়ে সেই কালো পাথরে খোঁচাখুঁচি শুরু করেছিল স্থানীয় ছেলেরা। আর কথন বলছে, সেই পাথর থেকেই তখন রক্তের স্রোত। গ্রামের প্রধানের স্বপ্নে দেবতা শনির আগমন। এবং তখনই নির্দেশ, ওই কালো পাথরই পূজনীয় হোক। গ্রামের কোনও বাড়িতেই দরজার প্রয়োজন নেই, দেবতা দেখবেন সবাইকে। নিরাপত্তা, মাথার উপর ছাদ সব ওই দেবতা। তারপর থেকে আজও, ট্র্যাডিশন চলমান।
এই কথন খুব স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার আলোর বাইরে থাকা এক প্রত্যন্ত ভারতবর্ষে অতিকথনতা এবং সংস্কার মিলে বড় হয়। কিন্তু এর বাইরে জ্বলজ্বল করে অন্য এক গল্প। চুরি? অপরাধ? নাহ, সেভাবে নেই, হলেও নগণ্য। ২০০৭ ও ২০০৮-এ মাত্র তিনটি চুরির ঘটনা, ২০১০-এ চারটে। সবই মূলত শনি দেবতাকে ঘিরে তৈরি হওয়া পবিত্র চাতালের আশেপাশে। প্রসঙ্গত এই চাতালের মাথার উপর অনেকদিন অবধিই কোনও ছাদ নির্মিত হয়নি। পাথর সবার সামনেই খোলা আকাশে বিশ্বাসের ভরসায় বড় হচ্ছিল। খুব সাম্প্রতিককালে সেখানে একটি বড় মন্দির তৈরি হলেও স্বাভাবিকভাবেই তার দরজা রাখা হয়নি প্রথা মেনেই।
কিন্তু গ্রামের মানুষেরা? তাঁরা, তাঁদের ঘরবাড়ির ছবিটা কেমন? এখনও দরজা না রাখার রেওয়াজ চলে আসছে। দামি অলঙ্কার সবই আলমারির বদলে খোলা কাপবোর্ডে রাখা থাকে। একদম হাট করে খোলা। ঘরে ঢোকার জন্য দরজার মতো একটা খোলা জায়গা রাখা হলেও সেখানে শুধুমাত্র নারীদের সম্মানার্থে পাতলা পর্দা দেওয়া থাকে। কখনও কুকুর বেড়ালের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থাও থাকে। তবে তা চোর আটকানোর জন্য খুব স্বাভাবিকভাবেই কোনও ব্যবস্থা নয়। তার কারণ, চোর নেই। চুরি নেই। অপরাধ নেই। কিন্তু যদি অপরাধ হয়? চুরি হয়? সংস্কার বলছে, অপরাধী দেবতা শনির রোষে পড়ে ‘সাড়ি সাতি’ নামের একটি অভিশাপে আবদ্ধ হবে। অর্থাৎ সাড়ে সাত বছর ধরে তাকে তার নিজের বা পরিবারের কারও শারীরিক ক্ষতি, বড়সড় রোগ, মৃত্যু বা আর্থিক ক্ষতির মুখ দেখে যেতেই হবে। গ্রামবাসীদের কথা শুনে গ্রামের এক সদস্য বাড়ির মূল প্রবেশের বাইরে অস্থায়ী একটি কাঠের দরজা লাগিয়েছিলেন। কথন বলছে, পরের দিনই গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিনি। বাকিটুকু জানা নেই। এই কথনের মধ্যে কতটা অতিকথন, তাও অজানা। কিন্তু কথন রয়ে গেছে।
এ তো গেল সাধারণ মানুষ এবং ঘরবাড়ির কথা। কিন্তু পরিষেবা? শুধু মিথ দিয়ে তো গ্রাম চলে না! এইসব মাথায় রেখেই ২০১১-য় ইউকো ব্যাঙ্কের একটি শাখা চালু হয় গ্রামে। বলা হয় দেশের প্রথম লকলেস ব্যাঙ্ক। দরজা আছে, কিন্তু লক নেই। গ্রামের বিশ্বাস। পরিষেবা। দুই-ই হল।
আপাত ছবিটা এটাই। এবার অবশ্য মিথের বাইরের কথা। পরিবর্তিত শনি শিগনাপুরের কথা। যা একটু ভেতরে গেলে, গভীরে গেলে, প্রিয় পাঠক, ধরতে পারবেন। শনিমন্দির এবং গ্রামের চুরি না হওয়ার মিথ – মূলত এই দুইয়ের ভরসায় প্রতিদিন প্রায় ৪০,০০০ পর্যটকের ভিড় হয় শনি শিগনাপুরে। ফলে একসময়ের প্রত্যন্ত শনি শিগনাপুর আজ ছোটখাটো এক শহরের ট্রানজিশনে আছে। ২০১১-এর ৫ ফেব্রুয়ারি। এই ট্রানজিশন শুরুর মুখেই হঠাৎ-ই এক ঘটনা মিথিকাল সেই গ্রামে। কী ঘটনা? বাকি ভারতবর্ষের কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও এই গ্রামে আশ্চর্যের এক সংবাদ। প্রিয় পাঠক, যা ভেবেছেন, তাই। চুরি। শনিমন্দিরের এক ট্রাস্টি সদস্যের বাড়ি থেকে ৭৩,০০০ টাকা মূল্যের সোনা এবং মোবাইল ফোন চুরি হয়ে যায়।
আর এখানেই মিথ ভেঙে যাওয়া বা মিথের বাইরে অন্য এক গল্পের সূত্রপাত। পুলিশ বলছে, চুরি না হওয়ার মিথ একটা সময়ে থাকলেও বহু আগেই নাকি ভেঙে গেছিল শনি শিগনাপুরে। তাহলে? পুলিশি রেকর্ড? সরকারি নথি। সেখানে তো কিছু নেই। এফআইআর নেই। সেখানেই মজা। গ্রামের মিথ ভেঙে যাওয়ার ভয়ে, পর্যটক না আসার ভয়ে, বা বাকি বরিষ্ঠ গ্রামবাসীদের সংস্কারের চাপে অধিকাংশ মানুষই নাকি চুরি বা অপরাধের পুলিশি রিপোর্ট করছেন না। শনি শিগনাপুরে চুরি হলে আর গ্রামের থাকলটা কী? হোক না একটু ক্ষতি। মেনে নিই বৃহত্তর স্বার্থে। দেবতার উপর ভরসা। অপরাধী নিশ্চয়ই ‘সাড়ি সাতি’-র কোপে পড়বে। কিন্তু ব্যাঙ্কের শাখা? সেখানে যে লকলেসের লেজেন্ড! খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানেও মিথ। অর্থাৎ, ব্যাঙ্কের কাচের দরজায় আপাতভাবে লক না থাকলেও সূক্ষ্মভাবে একটি রিমোট কন্ট্রোল চালিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক লক আছে। যা গ্রামের মধ্যে অতটা পরিচিত নয়। এবং ক্যাশ উন্মুক্ত রাখার কাহিনিও ভেঙে যায়, যখন খোদ ব্যাঙ্কের কর্মকর্তারাই নাম না প্রকাশ করে বলেন, রোজ ব্যাঙ্কিং আওয়ার্স শেষে সমস্ত ক্যাশ তাঁরা স্থানীয় সোনাই গ্রামের একটি ব্যাঙ্কের শাখায় জমা করে আসেন। পরের দিন সকালে আবার নিয়ে আসেন। সকালে, গোটা দিনে শনি দেখবেন। রাতে ঈশ্বরের উপর ভরসা করতে পারেননি ব্যাঙ্ককর্মীরা।
এইসব মিথের মধ্যেই শনি শিগনাপুর। চুরি না হওয়ার মিথের বাইরেও আরও অনেক ঘটনার সাক্ষী। ২০১৬ সালে সমাজকর্মী ত্রুপ্তি দেশাইয়ের নেতৃত্বে তাঁর ভূমাতা ব্রিগেডকে নিয়ে ইতিহাসে প্রথমবার মহিলা হিসেবে গ্রামের শনিমন্দিরের খোদ গর্ভগৃহে প্রবেশ। চিরাচরিত পুরুষ ট্যাবু ভেঙে যাওয়া। যা শবরীমালা আরও অন্যান্য ইতিহাসের অগ্রদূত। এবং শেষমেশ অতিমারির প্রকোপে বাকি ভারতবর্ষের মতো এই গ্রামেও অসুখ, মৃত্যু, সংক্রমণ, আতঙ্ক। যে ছবিটা বড় বেশি চেনা ...
চুরিবিহীন শনি শিগনাপুরের এইসব কাহিনি হয়ত মিথ, তবু পর্যটন সংস্কৃতির স্বার্থে, কর্মসংস্থানের স্বার্থে না ভাঙুক এটাই কাম্য। ত্রুপ্তি দেশাইয়ের আন্দোলনের পরেও বাইরের মেয়েরা এলেও গ্রামের মহিলারা আজও গর্ভগৃহে ঢোকেননি সংস্কারের ভয়ে, পাপপুণ্যের ভয়ে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই দরজা রাখার কথা ভাবছেন, এক এক করে শুরু করছেন, যা সত্যিই পুরোনো মিথিকাল ভারতবর্ষ ভেঙে যাওয়ার এক কষ্টের কথা বলে, সন্দেহ নেই।
তাই যতদিন পারে, পুরোনো সেই শনি শিগনাপুর বেঁচে থাকুক, আরও কটা দিন, কটা বছর ...
তথ্যঋণ –
১. https://www.bbc.com/travel/article/20160526-the-village-with-no-locks-or-doors