মাঠে ভগবান হয়ে বেঁচে থাকা কষ্টের, জানতেন কোকেনে ডুবে যাওয়া মারাদোনা
Maradona: লোকে বলছিল, ‘শালা পাতাখোর!’; লোকে বলছিল, ‘মালটা খতম হয়ে গেছে, আর ফুটবল খেলতে হবে না’।
হোমারিয়ো [রোমারিয়ো]
কে জানে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের কোন খাঁজ থেকে বাঘটা এসে হাজির হয়, তারপর আঁচড়ে-কামড়ে ফের গায়েব হয়ে যায়। নিজের খাঁচায় অবরুদ্ধ বেচারা নিরীহ গোলকিপার চোখের পলক ফেলার সুযোগ পায় না। হোমারিয়ো ক্রমাগত, একটার পর একটা গোল করে গেছে, কখনও হাফ-ভলিতে, কখনও বাইসাইকেল, হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে কখনও, নয়তো পুরুষ্টু কলার মতো বাঁকানো শটে, ব্যাক-হিল করে, পায়ের ডগা দিয়ে খুঁচিয়ে, নইলে পায়ের পাতা দিয়ে চাঁটা মেরে।
হোমারিয়ো জন্মেছে হিউ দে জেনেইরোর শহরতলিতে জাকারাজ়িনো বস্তি এলাকায়। কিন্তু খুব ছোটবেলা থেকেই সে কাগজ-কলম পেলেই নাগাড়ে নিজের নাম সই করে যায়। মনে হয় ভবিষ্যতে দেদার অটোগ্রাফ দেওয়ার অনুশীলনটা সেই সময়েই শুরু করে দিয়েছিল। সে কিন্তু খ্যাতির চুড়োয় উঠতে যে সিঁড়ি বেয়ে এসেছে সেখানে মিথ্যাচার করেনি কখনও। গরিবের ছেলে হলেও বিলাসব্যসনে ডুবে থাকতে চাওয়াটা তার ভেতরে চিরকাল ছিল। সে যা পেতে চাইত সেটা আদায় করেই ছেড়েছে। রাতভর পানশালায় হল্লা করা প্রেমিক ছেলেটি মুখে যা এসেছে তাই বলেছে। কোন কথার কোনখানে কোন মানে হবে, এসব ফালতু চিন্তা করে সে কখনও ডরায়নি।
এখন তার গ্যারাজে মার্সেডিজ় বেঞ্জ সার দিয়ে দাঁড় করানো থাকে, জুতো আছে আড়াইশো জোড়া। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠবৃত্তে সেই ছোটবেলার বন্ধুরাই আছে। বস্তির যেসব র্যাচাটে ছেলেকে দেখলে বাবুদের টক ঢেকুর ওঠে, তারাই তাকে শিখিয়েছে মাঠে এবং মাঠের বাইরে কীভাবে আক্রমণাত্মক হতে হয়।
বাজ্জো
সাম্প্রতিককালে তার মতো এমন অনবদ্য ফুটবল আর কোনও ইতালিয় খেলেনি। সেদেশের লোকেরাও গত ক'বছরে আর কাউকে নিয়ে এত কথা বলেনি। রোবের্তো বাজ্জোর ফুটবল অত্যন্ত রহস্যময়, অতীন্দ্রিয় ইশারাসম্পন্ন। তার পায়েরও নিজস্ব মন আছে। তাই পা নিজে থেকেই চলে, গোল হবার আগেই গোল দেখতে পায় এমনই অন্তর্দৃষ্টি তার।
মনোরম ঢেউ তুলে সে যখন বল পায়ে এগিয়ে যায় তখন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা তার টাট্টু ঘোড়ার ল্যাজের মতো মাথার ঝুঁটির বাড়ি খায়। বিপক্ষের ফুটবলাররা তাকে মারে, কামড়ে দেয়, প্রচণ্ড ঘুষি চালায়। বাজ্জোর কনুইয়ের ওপরে বাঁধা অধিনায়কের ফিতের নীচেই থাকে গৌতম বুদ্ধের বাণী। বুদ্ধ তাকে আঘাত থেকে রক্ষা করেন না, আঘাত সইবার শক্তি দেন। অনুদ্বিগ্নমনা ধ্যানস্থ তথাগতের আদর্শেই বাজ্জো শিখেছে কীভাবে স্টেডিয়ামের তুমুল হৈ-হল্লা, দর্শকের উল্লাস-অভিমান, বেয়াড়া বাঁশির আওয়াজের মাঝেও নৈঃশব্দ খুঁজে নিতে হয়।
আরও পড়ুন-বন্দুকের নলের মুখে অসহায় সাংবাদিক! সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়েছিলেন এই ফুটবলার
ফুটবলের ধারাপাত
১৯৩০ থেকে ১৯৯৪-এর মধ্যে আমেরিকা আটবার বিশ্বকাপ জিতেছে আর ইওরোপ সাতবার। আমাদের মহাদেশ থেকে ব্রাজ়িল চারবার, আরহেন্তিনা দু'বার, উরুগুয়ে দু'বার জিতেছে। অতলান্তিকের ওপারে ইতালি আর জার্মানি তিনবার করে জিতেছে। ইংল্যান্ড একবারই জিতেছিল, তাও ঘরের মাঠে।
কিন্তু অঙ্কটা ভালো করে খেয়াল করলে বুঝবেন, যেহেতু বিশ্বকাপে চিরকালই ইওরোপের দলগুলোর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা, ওদের অন্তত দ্বিগুণ সুযোগ ছিল বিশ্বকাপ হাসিল করার। পনেরোটা বিশ্বকাপে ইওরোপের দেশগুলো ১৫৯ বার জেতার সুযোগ পেয়েছে, পক্ষান্তরে আমাদের এদিকের দেশগুলো মাত্রই ৭৭ বার সুযোগ পেয়েছে। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বিশ্বকাপে ইওরোপের রেফারিরাও প্রথম থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
শুধু বিশ্বকাপেই নয়, আন্তর্মহাদেশীয় কাপেও আমেরিকার তুলনায় ইওরোপের দলগুলোর জেতার সুযোগ বেশি ছিল। এটা অবিশ্যি জাতীয় দলের ব্যাপার নয়, এখানে খেলে নামজাদা ক্লাবগুলো। এখানেও আমেরিকার ক্লাবগুলো জিতেছে কুড়ি বার আর ইওরোপের ক্লাব তেরো বার।
ফুটবলের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোয় ইংল্যান্ডের উপস্থিতি খুবই গোলমেলে। যখন ছোট ছিলাম, তখন আমি ব্যাপারটাকে নিজের মতো ব্যখ্যা করে নিয়েছিলাম। মানে ধরুন, ওই আমাদের ঈশ্বরের ধারণার মতো, একের মধ্যে তিন : পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা! বড় হয়েও ব্যাপারটা নিয়ে আমার মনে অনেক ধন্দ আছে। এখনও আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি না যে যুক্তরাজ্য একটা দল হিসেবে খেলে, কিন্তু ওখানে চার-চারটে দল আছে। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস আর উত্তর আয়ারল্যান্ড। অথচ সুইৎজ়ারল্যান্ড কিংবা হিস্পানি দেশের কথা ভাবুন, দুটো দেশেই জাতিগত বৈচিত্র্য কত বিপুল তবু ওরা একটা দল হিসেবেই খেলে।
তবে যাইহোক, ইওরোপের বিশ্ব ফুটবলকে নিয়ন্ত্রণ করার দিন কিন্তু ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত ফিফা অবশিষ্ট দুনিয়া থেকে একটা-দুটো দলকে খেলতে নিত। মধ্যযুগের মাপা মুন্ডি নামের মানচিত্রগুলোতে যেমন দুনিয়ার বেশিরভাগ জায়গাই দেখানো যায়নি, ফিফাও তেমনই এতকাল খুব বড় করে পৃথিবীটা দেখতে পায়নি। ’৯৮-এর বিশ্বকাপ থেকে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা চব্বিশ থেকে বেড়ে বত্রিশ হবে। সেখানেও আমেরিকার তুলনায় ইওরোপের অনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকবে। কিন্তু ওদের লড়তে হবে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকার প্রাণবন্ত, বিস্ফোরক ফুটবলের সঙ্গেও। সেই সঙ্গে আরবদেশ আর এশিয়ারও কয়েকটা দল ঢুকবে, যারা চিনের মতোই খেলাটার জন্মলগ্নের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও এখনও পর্যন্ত গ্যলারিতে বসেই বিশ্বকাপের আনন্দ উপভোগ করে এসেছে।
[এটা লিখেছিলাম ১৯৯৫ সালে। এরপর ইওরোপ আরও তিনবার এবং আমেরিকা একবার বিশ্বকাপ জিতে সব মিলিয়ে ইওরোপের পক্ষে স্কোর দাঁড়িয়েছে ১০-৯। ব্রাজ়িল পাঁচবার বাজি মেরেছে, ইতালি চারবার। কিন্তু ভৌগোলিক অসাম্য আজও বিরাজমান। ফিফা ইওরোপ থেকে আমেরিকার তুলনায় তিনগুণ বেশি দল বিশ্বকাপে খেলায়। ২০১৪-য় ব্রাজ়িল বিশ্বকাপে যেমন ইওরোপের তেরোটা দেশ খেলবে দক্ষিণ আমেরিকার চার-পাঁচটা দেশের সঙ্গে, আফ্রিকা থেকে আসবে পাঁচটা, এশিয়া থেকে চার-পাঁচটা, তিন-চারটে উত্তর-মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবিয়া থেকে, আবার সুদূর ওশিয়ানিয়া থেকেও একটা দল আসবে।]
আরও পড়ুন- ৬ গোল হজমের শাস্তি! ভক্তদের পাথরবৃষ্টিতে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ফুটবলাররা…
হারার পবিত্র কর্তব্য
১৯৯৪ বিশ্বকাপের মূলপর্বে বলিভিয়ার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া আর চাঁদে পৌঁছে যাওয়ার উত্তেজনা প্রায় একই রকম ছিল। ভৌগোলিক কারণে একটেরে হয়ে থাকা বলিভিয়া ইতিহাসের হাতেও বারবার নিপীড়িত হয়েছে। এর আগের দু'বার তারা বিশ্বকাপের যোগ্যতানির্ণায়ক ম্যাচ খেলে নয়, কেবল আমন্ত্রণের ভিত্তিতেই মূলপর্বে এসেছিল। কিন্তু প্রতিটি ম্যাচেই তারা হারে, এমনকী কোনও ম্যাচেই তারা গোল করতে পারেনি।
জাতীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে সাবিয়ার অ্যাস্কারগোরতাকে নিয়োগ করে একেবারে হাতে-গরম ফল পেয়েছে বলিভিয়া। তাদের সাফল্য শুধু স্বর্গের আগের স্টেশন লা পাস-এর [লা পাজ়] স্টেডিয়ামগুলোতেই সীমাবদ্ধ রইল না, মেঘের ওপরে দাঁড়িয়ে বাইরের দলের অসুবিধে হতেই পারে। কিন্তু বলিভিয়া সমুদ্রসৈকতের কাছাকছি মাঠগুলোতেও জিততে শুরু করে। তারা ক্রমশ প্রমাণ করছিল উচ্চ অক্ষাংশই তাদের সাফল্যের একমাত্র কারণ নয়, ভৌগোলিক সুবিধের থেকেও বড় খেলোয়াড় তাদের আস্তিনে লুকনো আছে। তারা ধীরে ধীরে বোঝাচ্ছিল যে এতদিন ধরে গলায় লটকে থাকা চিরস্থায়ী হেরোর তকমা এবার ঘুচতে চলেছে। এতকাল মাঠে নামার আগেই তারা হেরে বসত, এবার হাওয়া পালটেছে। যোগ্যতা নির্ণায়ক পর্বে বলিভিয়া ঝলসে উঠেছিল। মাঝমাঠে মেলগার এবং বালদিভিয়েসো, আক্রমণভাগে স্যাঞ্চেস, আর সবাইকে ছাপিয়ে ইচেভ্যারি, দেশের জয় দেখতে উন্মুখ জনতা যাকে আদর করে ডাকত ‘শয়তান’ বলে।
কিন্তু নন্দলালের মন্দ কপাল যাবে কোথায়! শুরুতেই তারা পড়ল বাঘের মুখে। বিশ্বকাপে তাদের প্রথম ম্যাচ ছিল অমিত শক্তিধর জার্মানির বিরুদ্ধে। র্যাম্বোর বিরুদ্ধে কড়ে আঙুলের সমান জোর নিয়ে দাঁড়ানোর মতো। কিন্তু খেলায় যা ঘটতে শুরু করল তা আগে কেউ ভাবতেই পারেনি! জার্মানির সামনে নিজেদের পেনাল্টি বক্সে সিঁটিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, তারা রীতিমতো আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে শুরু করল। এবারের টক্করটা সমানে সমানে ছিল না। ঠিক বোঝাতে পারলাম? বলিভিয়া কিন্তু খেলার শুরু থেকেই দাদাগিরি শুরু করেছিল। উলটে জার্মানিই আক্রমণ ভুলে রক্ষণাত্মক হয়ে পড়ল। আর বলিভিয়া তখন যেন সহসা নিজেকে চিনেছে, তার সব বাঁধ খুলে গেছে, তারা তুরীয়ানন্দে ছুটে চলেছে মাঠ জুড়ে। এভাবেই চলছিল সব, যতক্ষণ না তাদের সবচেয়ে বড় তারকা মার্কো আন্তোনিয়ো ইচেভ্যারি খেপে গিয়ে ম্যাথাউসকে লাথি মারে। তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া ছাড়া রেফারির আর কিছু করার ছিল না। সঙ্গে সঙ্গেই বলিভিয়ার তাল কেটে গেল, দলের ভিতটাই নড়ে গেল বলা ভালো। ধীরে ধীরে তারা শতাব্দী প্রাচীন অভিশাপের জেরে ফের হেরে যাওয়ার পবিত্র ব্রত উদযাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শাপমোচন অধরাই থেকে গেল।
আরও পড়ুন- ফুটবলার না হোর্ডিং! জুতোর ফিতে বাঁধার নামে আসলে ব্র্যান্ড দেখাতেই চান খেলোয়াড়রা?
পাপের বোঝা
ফুটবলের ঐশ্বরিক ক্ষমতা যত বেড়েছে ততই সে ফুটবলের আপন-ধর্মে বিশ্বাসীদের প্রতিহিংসার মুখে ফেলেছে। পায়ে বল নিয়ে, বুকে জাতীয় পতাকার সঙ্গে মানানসই জার্সি সেঁটে, খেলোয়াড়রা দেশের প্রতিভূ হয়ে দূর-দূরান্তের যুদ্ধক্ষেত্রে স্বদেশের গরিমা ছিনিয়ে আনতে নামে। হেরে গেলে যোদ্ধাদের পতিত দেবদূত বলে গণ্য করা হয়। ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপে জঘন্য খেলে আরহেন্তিনার জাতীয় দল যখন ইসেইসা বিমান বন্দরে নামল, তখন সমর্থকেরা সেখানে ইট-পাটকেল নিয়ে হাজির ছিল। ১৯৮২-আর বিশ্বকাপে পেনাল্টি নষ্ট করার পর চিলেতে কার্লোস কাসেলির জিনা-হারাম হয়ে গিয়েছিল। এর দশ বছর পরে মিশরের কাছে ৬-১ গোলে হেরে ইথিওপিয়ার বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় জাতিসংঘের কাছে নিরাপদ রাজনৈতিক আশ্রয় দাবি করে।
আমরা টিকে আছি কেননা আমরা জিতছি, হারলে আমাদের কোনও জায়গা নেই, এটাই ফুটবলের সারসত্য। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহেরই অবকাশ নেই যে জাতীয় দলের জার্সি এখন সমষ্টিগত আত্মপরিচয়ের অংশ। ফুটবল ছাড়া যাদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার আর কোনও রাস্তা নেই এ কেবল সেই সব গরিবগুর্বো, ছোটখাটো দেশের জন্যই সত্যি, এমনটা নয়। ১৯৯৪ সালে যখন ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের মূল পর্ব থেকে ছিটকে গেল, তখন লন্ডনের ডেইলি মিরর এতবড় বিপর্যয়ের সঙ্গে মানানসই বড় হরফে প্রথম পাতায় ছেপেছিল : ‘ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’।
আর পাঁচটা ক্ষেত্রের মতোই ফুটবলেও হেরে আসার অবকাশ নেই। বিংশ শতাব্দী শেষের দিনগুলোতে ব্যর্থতার কোনও ক্ষমা নেই। ’৯৪-এর বিশ্বকাপ চলাকালীন ক্যামেরুনের একদল উগ্র সমর্থক হেরে যাওয়া দলের গোলকিপার জোসেফ বেলের বাড়ি পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই মেদেজ়িনে [মেদেলিন] আন্দ্রেস এসকোবারকে গুলি করে খুন করা হয়। এসকোবার একটা সেমসাইড গোল করে ফেলেছিল। আত্মঘাতী গোল তো বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর!
এর জন্য কি ফুটবলকে দায়ী করবেন? না কি আমাদের এই নির্বিকল্প জয়ের রাস্তায় দৌড়নোর সংস্কৃতির বিরোধিতা করা উচিত। যে বিজয়তন্ত্রের নিশান উড়িয়ে পেশাদার ফুটবল ছুটছে তার বিরোধিতা করা কি উচিত নয়? ফুটবল স্বভাবগতভাবে হিংস্র কোনও খেলা নয়। তবে কখনও কখনও খেলাটার নাক-কান দিয়ে হিংসার বাষ্প ছোটে। আমাদের গ্রহের হিংস্রতম দেশগুলির একটিতে আন্দ্রেস এসকোবারের হত্যা তো কোনও সমাপতন নয়। যে মানুষগুলো ফুটবল মাঠে জিতে উল্লাসের মাদকঠাসা সুরে পাগল হয়ে গিয়ে আনন্দ উদযাপন করে তাদের বংশানুগতির জিনে হিংসার সংকেত লেখা আছে এমনটাও নয়। কলম্বিয়ায় ঝুটঝামেলা-হিংসা অসুখের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদেশের মানুষের কপালে তো এগুলো জন্মদাগের মতো নয়। ক্ষমতাতন্ত্রই এজন্য সম্পূর্ণ দায়ী। গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়ে অসাম্য আর অপমানের বিষ চাড়িয়ে গেছে মানুষের অন্তরাত্মা পর্যন্ত। এই দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হলো মানুষের দারিদ্র্য অসম্মানের দায় ঝেড়ে ফেলা। রাজনীতি বরং অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়, হিংসার রাস্তায় মানুষকে ঠেলে দিয়ে সেটাকেই জাতীয় বৈশিষ্ট্য বলে চিহ্নিত করতে চায়।
১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মানবাধিকার বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে দেখছি কয়েকশো কলম্বিয়াবাসীকে "১৯৯৩ সালে সশস্ত্র বাহিনী আর তাদের লেজুড় সংসদীয় দলগুলি বিচারবিভাগীয় কায়দাকানুন না মেনেই ফাঁসি দিয়েছে। এইসব হতভাগ্য মানুষগুলো, যারা আইনি রক্ষাকবচের সুরক্ষা ছাড়াই খুন হলো, তাদের সেই অর্থে কোনও রাজনৈতিক পরিচিতিও ছিল না।"
অ্যামনেস্টি ওই প্রতিবেদনে ‘সামাজিক পরিচ্ছন্নতা’ প্রকল্পে কলম্বিয়ার পুলিশের ঘৃণ্য অবস্থানের কথাও সাতকাহন করে বলা আছে। একটা গণ উন্মাদনা তৈরি করে সেদেশের পুলিশ-প্রশাসন সমকামী, বেশ্যা, নেশাগ্রস্ত, ভিখিরি, পাগল এবং পথশিশুদের নিখুঁত নকশায় নিকেশ করেছে। সমাজ যাকে ‘বর্জনীয়’ আখ্যা দেয়, সেইসব মনুষ্য-জঞ্জালের মরাই তো উচিত।
যে জগতে পরাজিতদের শাস্তি হয়, সে জগতে বারোমেসে হেরো প্রজন্মেরই তো জন্ম হবে।
আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল
মারাদোনা
যতদিন তাকে খেলতে দিয়েছে, ততদিন সে জিতেছে। যেদিন হারল, সেদিন পেচ্ছাপ করেছিল। ল্যাবরেটরিতে তার মূত্রের নমুনা নিয়ে অনেক নাড়াঘাঁটা করে ওরা এফিড্রিন খুঁজে পেয়েছিল, তাই ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ থেকে মারাদোনাকে লাত্থি মেরে তাড়ানো হল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বলুন বা অন্য কোনও দেশ, পেশাদার খেলোয়াড়দের জগতে এফিড্রিনকে আদৌ কোনও গুপ্ত-মহৌষধি বলে গণ্য করা হয় না। কিন্তু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোয় ওটা নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকায় আছে।
সঙ্গে সঙ্গেই কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেল, নীতিবাগিশদের টিকি নড়ে উঠল, পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে চিল-চিৎকারে কানে তালা লেগে যাবার মতো অবস্থা। যদিও প্রায় অপঘাতে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো নায়কের পক্ষেও কিছু গলা শোনা গেল এবং সেটা শুধুমাত্র ব্যথায় বধির হয়ে যাওয়া তার জন্মভূমি আরহেন্তিনা থেকেই নয়, সুদূর বাংলাদেশের রাস্তায়-রাস্তায় মানুষ ফিফার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়। সবার একটাই বক্তব্য, অবিলম্বে মারাদোনাকে মাঠে ফেরাতে হবে। বিচারের নামে পঞ্চায়েত বসিয়ে কাউকে মায়ের ভোগে পাঠানো খুবই সহজ কাজ। কিন্তু মারাদোনা যে বছরের পর বছর দুনিয়ার সেরা ফুটবলার ছিল এটা ভুলে যাওয়া সহজ নয়। ভুলে যাওয়া সহজ নয়, ক্ষমতাশালীরা যেসব কথা চাপা দিতে ব্যস্ত সেইসব কথা মারাদোনা কেমন অবলীলায় উগড়ে দিত। একথাও ভুলি কী করে যে সে ন্যাটা ছিল, অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে ন্যাটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে : "যা বাঁ-হাত সম্পর্কিত’, কিন্তু অশুভ এবং সন্দেহজনক"।
দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা খেলার আগে শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে নিষিদ্ধ ওষুধ খেত না। আবার এটাও মিথ্যে নয় যে কোকেনে তার আসক্তি ছিল। কিন্তু সে কোকেন নিত রাতের বিষণ্ণ পার্টিগুলোয়, যেখানে ভুবনজোড়া খ্যাতির চাপে সে নুয়ে পড়ত, একঘরে লাগত। আবার যে খ্যাতি তাকে স্বস্তিতে থাকতে দিত না, সেই খ্যাতি ত্যাগ করেও তার বাঁচার উপায় ছিল না। নাম-যশের প্রতি তার কোনও মোহ ছিল না এমনটাও নয়। মারাদোনা কোকেন নিয়েও এই গ্রহে সবার চেয়ে ভালো ফুটবল খেলত, কোকেনের দৌলতে নয়।
দিয়েগো নিজের ব্যক্তিত্বের ভারে বিহ্বল হয়ে পড়ত। সেই যেদিন থেকে মানুষ তার নামে গান বাঁধতে শুরু করল, সেদিন থেকেই তার কশেরুকার ওপর বাড়তি চাপ পড়া শুরু। কী করবে বেচারা, তাকে যে মারাদোনা নামের বোঝাটা সারাজীবন বইতে হলো, নামের ভারে তার পিঠ বেঁকে গেছে। শরীরটা রূপক মাত্র; তার পায়ে যে মারাত্মক যন্ত্রণা, রোজ রাতে ঘুমের বড়ি না গিললে দু'চোখের পাতা এক করতে পারত না। একথাও ভুলব কী করে? সে খুব অল্প বয়সেই বুঝে গিয়েছিল, মাঠের ভগবান হয়ে বেঁচে থাকাটা কতটা কষ্টকর। কিন্তু জানত যে হাল ছাড়লে চলবে না। দীর্ঘদিন ধরে ফুটবল মাঠে অতিমানবিক কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে সে পরে স্বীকারও করেছে খ্যাতির যন্ত্রণাময় বিভা তার কাছে অত্যন্ত জরুরি, "আমার নিজের জন্যই এইসব বিড়ম্বনাও চাই"। কোর্টিজ়োন ইনজেকশন, ব্যথা কমানোর ওষুধ আর তুমুল প্রশংসায় সে ফুলে ঢোল হয়ে থাকত। ভক্তদের চাহিদা মেটাতে বিব্রত হতো। অন্যদিকে যাদের চটিয়ে রেখেছিল, তাদের ঘৃণার সাগর সাঁতরে পেরতে হতো।
প্রতিষ্ঠিত নায়কের মূর্তি ভাঙার উল্লাসের সঙ্গে নতুন নায়ক-নির্মাণের সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে। মারাদোনা যখন বার্সেলোনায় খেলতে গিয়েছিল, পেছন থেকে লাথি মেরে আতলেতিকো বিলবাওয়ের গয়কোচেয়া তার গোড়ালিটা ভেঙে দিল। পায়ে তখন বলও ছিল না, ওই এক লাথিতে বেশ কয়েক মাস মারাদোনাকে মাঠের বাইরে বসে থাকতে হয়। সেদিনও কিন্তু মারাদোনার পা ভেঙে দেওয়ার উল্লাসে বহু সমর্থক ‘বিলবাওয়ের কসাই’ গয়কোচেয়াকে কাঁধে তুলে নাচানাচি করে। পৃথিবীর দুই গোলার্ধেই বহু মানুষ তখন তারকাদের কক্ষপথে অনুপ্রবেশকারী, উদ্ধত ছেলেটার ফুটবলজীবন খতম হয়ে গেল অনুমান করে উৎসব করতে একপায়ে খাড়া ছিল। একটা ভুঁইফোঁড়, খিদের জ্বালা মেটাতে দৌড়চ্ছে, শালা রাস্তার গুণ্ডা, তার এত অহংকার!
আরও পড়ুন- এক ম্যাচে ৪৪ টা পেনাল্টি! ফুটবলের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে যে ম্যাচ…
পরে নাপোলিতে গিয়ে মারাদোনা অবিশ্যি ‘সন্ত মারাদোনা’য় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। নাপোলিতে গৃহদেবতার মতো ঘরে ঘরে পূজিত সান জেন্নারোকে লোকে সান জেনআরমান্দো বলতে শুরু করেছিল। নাপোলির অলিতে-গলিতে তখন খেলার পোশাকে মারাদোনার ছবি দেদার বিক্রি হচ্ছে। সেইসব ছবিতে তার ঐশ্বরিক ক্ষমতা বোঝাতে মাতা মেরির মতোই মারাদোনার মাথার চারপাশে আলৌকিক জ্যোতির্বলয় আঁকা। নাপোলিবাসী বিশ্বাস করে তৃতীয় শতাব্দীর সান জেন্নারো এখনও ছ'মাস অন্তর রক্তাক্ত হয়ে চলেছেন। কোনও কোনও ছবিতে মারাদোনাকে সেই সান জেন্নারোর মতো আঙরাখা পরানো হতো। তারা উত্তর ইতালির ক্লাবগুলোকে দাফন করার জন্য শবাধারও বিক্রি করত, সেই সঙ্গে সিলভিয়ো বার্লুসকোনির চোখের জলভরা ছোটো ছোটো শিশিও।
বাচ্চাদের, এমনকী রাস্তার নেড়িগুলোকেও মারাদোনার মতো পরচুল পরানো হতো। কে যেন গিয়ে দান্তের মূর্তির পায়ের কাছে একটা ফুটবল বসিয়ে দিয়েছিল। এমনকী শহরের বিখ্যাত ত্রিতোনের ফোয়ারায় সমুদ্রদেবতা ত্রিতোনকেও কেউ একটা নাপোলির নীল জার্সি পরিয়ে দিয়েছিল। ভিসুভিয়াসের ক্রোধ আর ফুটবল মাঠে প্রতিনিয়ত হারকেই নাপোলিবাসী এতদিন ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিল। গত পঞ্চাশ বছরে তারা চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেনি। দক্ষিণ ইতালির যে লোকেদের এতদিন উত্তর ইতালির মানুষেরা কালা আদমি বলে নিরন্তর গাল পাড়ত, তারা মারাদোনার জন্যই অহংকারী উত্তর ইতালির মুখে ঝামা ঘষে দিতে পেরেছিল। একের পর এক চ্যাম্পিয়নশিপে, ইতালিতে এবং ইওরোপের অন্যান্য দেশের স্টেডিয়ামগুলোতেও নাপোলি জিতেই চলল। নাপোলির প্রতিটি গোল ছিল চলতি রেওয়াজের বিরুদ্ধে, ইতিহাসের উপেক্ষার বিরুদ্ধেও জ্বলজ্যান্ত প্রতিশোধ। মিলানের সমর্থকেরা প্রকাশ্যে তাদের এই অসম্মানের জন্য দায়ী গরিবঘরের ছেলেটিকে ঘৃণা মিশিয়ে বলত; ‘কোঁকড়াচুলের শুয়োরের বাচ্চা’। শুধু মিলানেই নয়, ১৯৯০-এর বিশ্বকাপে মারাদোনার পায়ে বল গেলেই ইতালির দর্শক তীব্র বাঁশির আওয়াজে তার মনঃসংযোগ নষ্ট করার চেষ্টা করত। ফাইনালে জার্মানির কাছে আরহেন্তিনা হেরে যাওয়ার পর তারা এমন উৎসব করেছিল যে মনে হচ্ছিল জার্মানি নয়, বিশ্বকাপটা ইতালিই জিতেছে।
কিন্তু ‘সন্ত মারাদোনা’ যেদিন বলল সে নাপোলি ছেড়ে যেতে চায়, তখন নাপোলির কিছু মানুষ জানলা দিয়ে তার ঘরের ভেতরে পেরেক-গাঁথা মোমের পুতুল ছুঁড়ে মেরেছিল। যে শহর একসময় তাকে ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে, সেই শহরে সে তখন বন্দিদশায় দিন কাটাচ্ছে। শুধু শহরের মানুষের হাতেই নয়, নাপোলির মালিক কুখ্যাত মাফিয়া কামোরার হাতেও সে বন্দি তখন। মারাদোনা সেই দিনগুলোতে হৃদয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে, পায়ের স্বাভাবিক গতির বিরুদ্ধে গিয়ে খেলেছে। তখনই কোকেন কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ্যে আসে। রাতারাতি মারাদোনার নাম হয়ে যায় মারাকোকা। মারাদোনা তখন যেন একজন জন্ম-অপরাধী, যে সাধারণ মানুষকে এতকাল ভুল বুঝিয়ে এসেছে, লোকে যেন পাক্কা একটা শয়তানকে এতকাল নায়কের সম্মান দিয়েছিল।
যে চাকুতে মারাদোনাকে খুঁচিয়ে মারা হচ্ছিল, বুয়েনস আইরেসের সংবাদমাধ্যম তাতে আরও একদফা প্রাণঘাতী প্যাঁচ দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিল টিভিতে মারাদোনাকে গ্রেফতারের সরাসরি সম্প্রচার করে। তাদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি কোনও ফুটবল ম্যাচ চলছে। আর মানুষ রাজার কাপড় খুলে নিয়ে উলঙ্গ করার দৃশ্য উপভোগ করছিল তারিয়ে তারিয়ে।
লোকে বলছিল, ‘শালা পাতাখোর!’; লোকে বলছিল, ‘মালটা খতম হয়ে গেছে, আর ফুটবল খেলতে হবে না’। স্মরণাতীত কাল থেকে বঞ্চিত-অবজ্ঞাত দক্ষিণ ইতালির শাপমোচনের এই মসিহাই কিন্তু ফকল্যান্ডের যুদ্ধে আরহেন্তিনার করুণ পরিণতিরও প্রতিশোধ নিয়েছিল। সেদিন মারাদোনা প্রথমে একটা কৌশলী গোল করেছিল, আর তার ঠিক পরের গোলটায় সে ইংরেজদের এমন ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল যে সাহেবদের মাথা অনেকদিন পর্যন্ত লাটিমের মতো পাক-ঘুরঘুর করেছে। কিন্তু দশচক্রে সে যখন মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল, তখন এতকালের সোনার ছেলে হয়ে গেল ইতর-ধান্দাবাজ-প্রতারক। মারাদোনাকে যারা ভগবান মানত সেই কোটি কোটি বাচ্চাকে নাকি সে ঠকিয়েছে! শুধু তাই নয়, ফুটবলের মতো মহান খেলার গায়েও কলঙ্কের ছিটে লাগিয়েছে, সবাই একবাক্যে তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে দেয়।
কিন্তু মৃতদেহটি ফের খাড়া হয়ে বসে। কোকেন কাণ্ডে জেলখাটার পরও সে যে আরহেন্তিনার জাতীয় দলের সেরা খেলোয়াড়। আরহেন্তিনা সেবার বিশ্বকাপের মূল পর্বে সুযোগ পাবে কিনা সেটাই তখন লাখ টাকার প্রশ্ন ছিল। যাইহোক, মারাদোনার কাঁধে চড়ে আরহেন্তিনা সেবার তরে যায়। ’৯৪-এর বিশ্বকাপে আবার সেই পুরোনো দিনের মতোই, মারাদোনাই ছিল সেরা। আর ঠিক তখনই এফিড্রিন কেলেঙ্কারি সামনে এল।
ক্ষমতার শীর্ষে বসে থাকা ফুটবলের মোহন্তরা তাকে গিলে খাওয়ার শপথ নিয়ে রেখেছিল। তুমি মুখের উপর সত্যি কথা বলে দিলে তার মূল্য তো দিতেই হবে। এক্ষেত্রে দামটা নগদেই চোকাতে হল, কিস্তিতে মেটানোর কোনও সুযোগই রাখা হয়নি। আর মারাদোনা তো ওদের হাতে নিজেই অস্ত্র তুলে দিল। চিরকালই সে শত্রুদের খাবারের থালায় নিজের মুণ্ডুটা পরিবেশন করে এসেছে। রাস্তায় তাকে ধরার জন্য যত ফাঁদ পাতা হয়েছে তার প্রায় প্রত্যেকটিতেই বাচ্চাছেলের মতো ধরা দিয়ে এসেছে।
যে সাংবাদিকেরা মাইক্রোফোন হাতে তাকে নাকাল করত, তারা প্রকাশ্যে তার ঔদ্ধত্য আর বায়নাক্কার সমালোচনা করতে শুরু করল, তার বিরুদ্ধে বাচালতার অভিযোগও তুলল। ওরা খুব একটা ভুল বলেনি। তবে একটু ভেবে দেখুন, শুধু এই কারণেই কি তাকে ক্ষমার অযোগ্য জ্ঞান করা যায়? আসলে বিভিন্ন সময়ে মারাদোনার মন্তব্য ভুলতে পারেনি ওরা। মাথাগরম, গাঁট্টাগোট্টা, সহজ প্রাজ্ঞতায় ভরা অল্প-শিক্ষিত ছেলেটি যে মাঝে মাঝে অনেকের চিবুক লক্ষ্য করে আপারকাট মেরেছে। ১৯৮৬ এবং ১৯৯৪ সালে, মেহিকো আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সে সর্বশক্তিমান টেলিভিশনের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিল। আর বলবে নাই বা কেন, বানিয়াগুলো ভরদুপুরে মাঠে নামিয়ে ফুটবলারদের আচ্ছাসে সেঁকে হাড়ে ডুগডুগি বাজিয়ে ছেড়েছিল। জীবনের ওঠাপড়ার মাঝেই মারাদোনা অন্তত একহাজার এক বার ভিমরুলের চাকে ঢিল মেরেছে। খেলার মাঠে সে একাই অবাধ্য ছিল এমন নয়, কিন্তু তার গলাতেই সবচেয়ে জোরে আর স্পষ্ট শোনা যেত নানান আক্রমণাত্মক প্রশ্ন। কেন ফুটবলেও আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ধারাগুলি প্রযুক্ত হবে না? কোনও মঞ্চসফল শিল্পী যদি জানতে পারে একটা অনুষ্ঠান থেকে কত টাকা উঠছে, তাহলে ফুটবলাররা কেন বহুজাতিক সংস্থার সমতুল্য ফুটবল ব্যবসায়ীদের টাকাপয়সার চিত্রগুপ্তের খাতা দেখতে পাবে না? আভেলাঞ্জি আরও হরেক কাজে ব্যস্ত থাকায় মুখ বন্ধ রেখেছিল, কিন্তু শেপ ব্লাটার অন্য ধাতুতে গড়া। জীবনে কোনওদিন বলে পা না দিয়েও ফিফার প্রধান হিসেবে একজন কৃষ্ণাঙ্গ চালক সহ পঁচিশ ফুট লম্বা একটা লিমুজ়িনে চড়ে ঘোরার অধিকার পেয়েছে। সে বেশি কিছু না বলে মন্তব্য করেছিল: ‘আরহেন্তিনার শেষ তারকা ফুটবলার দি স্তেফানো’।
মারাদোনাকে যখন ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ থেকে বের করে দিল, ফুটবল তার সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদীকে হারাল। অনন্য একজন ফুটবলারকে তো বটেই। মারদোনা কথা বলতে শুরু করলে তাকে থামানো যায় না, কিন্তু পায়ে বল পড়লে তাকে থামানো আরও শক্ত। কেউ জানে না অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটাতে ওস্তাদ লোকটা কখন কোন শয়তানি প্যাঁচে শুধু প্রতিপক্ষকেই নয়, আজকালকার কম্পিউটারকেও ছুঁড়ে ফেলে নির্মল আনন্দে মন ভরিয়ে দেবে। আর হ্যাঁ, সে কখনও একই কায়দার পুনরাবৃত্তি করত না। প্রত্যেকবার তার নতুন কৌশল মজুত থাকত। সে যে খুব জোরে দৌড়ত তাও নয়, বরং ছোট ছোট পায়ের একটা ষাঁড় দৌড়চ্ছে বলে মনে হতো। তবে বল তার পায়ের সঙ্গে সেলাই করা থাকত। তার গোটা শরীর জুড়ে চোখ ছিল। বল নিয়ে কসরত দেখিয়ে সে মাঠের দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিত। প্রতিপক্ষের গোলের দিকে পিঠ করে থেকেও বেদম জোরে শট নিয়ে ম্যাচ জেতাতে পারত, কিংবা অনেক দূর থেকে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের পায়ের জঙ্গল কাটিয়ে অসম্ভব পাস বাড়াত। সে যখন ঠিক করত বল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে কাটিয়ে যাবে, কারও বাপের সাধ্যি ছিল না তাকে আটকায়।
আজকের দুনিয়ার আড়ষ্ট ফুটবলে, যেখানে হারা এবং খেলতে নেমে মজা করা নিষিদ্ধ, ওই লোকটাই প্রমাণ করেছিল কিছু কিছু রূপকথা সত্যি হয়।