গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়ে রাতভর ইজরায়েলি অভিযান, দীর্ঘ হচ্ছে শবদেহের মিছিল

Israel-Palestine conflict: ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-সহ একাধিক জায়গায় ইজরায়েলি সেনা চালিয়ে যাচ্ছে লাগাতার অভিযান। সারা রাত ধরে অজস্র ইজরায়েলি সেনা ওই সব এলাকা দিয়ে ঢুকে আসছে গাজায়। চলছে বন্দুক, গোলাগুলি।

বধ্যভূমি গাজা। চার সপ্তাহের ভয়াবহ যুদ্ধে ছাড়খার হয়ে গিয়েছে গোটা শহর। হাসপাতাল হোক বা গির্জা, যেখানেসেখানে নেমে আসছে ইজরায়েলের রকেট। মুহূর্তে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে সব কিছু। এমনকী যে বাস্তুচ্যুত যে মানুষগুলো নিরাপদ আশ্রয় ভেবে মাথা গুঁজেছিলেন শরণার্থী শিবিরে, সেই শিবির উড়িয়ে দিতেও দ্বিতীয়বার ভাবেনি ইজরায়েলি সেনা। একদিকে গাজার আনাচকানাচ জুড়ে চলছে ইজরায়েলের লাগাতার রকেট হামলা আর অন্যদিকে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-সহ একাধিক জায়গায় ইজরায়েলি সেনা চালিয়ে যাচ্ছে লাগাতার অভিযান। সারা রাত ধরে অজস্র ইজরায়েলি সেনা ওই সব এলাকা দিয়ে ঢুকে আসছে গাজায়। চলছে বন্দুক, গোলাগুলি।

সব দিক থেকেই গাজাকে পিষে মারতে উঠেপড়ে লেগেছে ইজরায়েল। জল নেই, খাবার নেই। ওষুধপত্র নেই। এদিকে সারা রাত ধরে আকাশ পথে গাজার এদিক ওদিকে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। গাজার দ্বিতীয় বড় শহর খান ইউনিসে মঙ্গলবারও সারা রাত ধরে আকাশপথে হামলা চলেছে। খোঁজ চলছে হামাস এবং ফাতাহ নেতাদের। তাঁদের খতম করার রোখে একের পর এক গাজার সাধারণ মানুষের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। জানা গিয়েছে সাম্প্রতিক এই অভিযানে এক ফাতাহ নেতাকে গ্রেফতার করেছে ইজরায়েলি সেনা। হ্যাঁ, তিনি গ্রেফতার হয়েছেন বটে। কিন্তু তার সঙ্গেই অধিকৃত পশ্চিম তীরে প্রাণ গিয়েছে পাঁচ নিরপরাধ ফিলিস্তিনির।

আরও পড়ুন: ইজরায়েল গাজা যুদ্ধে ভারত কী চায়? উত্তর লুকিয়ে ৭৩ বছর আগের এই ঘটনায়…

অবশ্য এই কোল্যাটারাল ড্যামেজ দেখতে দেখতে এখন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে ইজরায়েল। এমনকী বিশ্বও। যে সাড়ে ৮ হাজার নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মৃত্য়ু হয়েছে গাজায়, তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু। আর বাকিরাও সকলেই নিরপরাধ সাধারণ মানুষ। যাদের এই যুদ্ধের সঙ্গে ন্যূনতম যোগটুকুও নেই। তবু উলুখাগড়ার মতোই তাঁদের মৃত্যু লেখা রয়েছে ইজরায়েলের হাতে। তাদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই নেতানিয়াহু সরকারের। এমনকী হামাস বাহিনীর হাতে বন্দি ইজরায়েলি বাসিন্দাদের জন্যও সরকারের তেমন চিন্তা রয়েছে বলে মনে হয় না। প্রায় আড়াইশো জন ইজরায়েলি এখনও বন্দি হামাস-বাহিনীর হাতে। তাদেরকে উদ্ধারের জন্য কোনও সদিচ্ছা দেখা যায়নি নেতানিয়াহু সরকারের মধ্যে। গাজাকে সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করতেই আপাতত বেশি আগ্রহ ইজরায়েলের।

বুধবার ভোর রাতে খান ইউনিসের দু'টি আবাসিক ভবনকে নিশানা করে ইজরায়েলি সেনা। ওই দুটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছিল বহু গাজা শরণার্থী। ইজরায়েলি সেনার দক্ষিণ গাজা খালি করে দেওয়ার নির্দেশের পর বহু বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাই আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানে। আর সেই ভবন দু'টিকেই নিশানা করেছিল ইজরায়েলি সেনা। সেই হামলায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১২ জনের। আর জখম ২ ডজনেরও বেশি।

ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে অক্টোবর থেকে অন্তত ১৩০ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। সবচেয়ে বড় হামলা চলে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের উত্তর জেনিন শরণার্থী শিবিরে। সেই হামলায় তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। হ্যাঁ, সংখ্যাগুলো ছোট মনে হলেও এই বিন্দু বিন্দু জমতে জমতেই সাড়ে আট হাজারে পৌঁছেছে গাজার মৃত্যুমিছিল। গাজার সংবাদমাধ্যম কর্মীদের পরিবারের উপর বারংবার নেমেছে আঘাত। আল জাজিরা সংবাদমাধ্য়মের বহু কর্মীর পরিজনেরা মারা গিয়েছেন হামলায়। রামাল্লা থেকে এক সংবাদকর্মী জানিয়েছেন, মধ্যরাতে শুরু হয়েছিল ইজরায়েলি বাহিনীর হামলা। যা শেষ হয়েছে প্রায় সকালে। ততক্ষণে ধুলোয় মিশে গিয়েছে পারিপার্শ্বিক সব কিছু। গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে এমন অসংখ্য হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে গাজায়। জেনিন শরণার্থী শিবিরের ওই হামলাটি ছিল এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। বিরাট সংখ্যক ইজরায়েলি সেনা দখল নেয় এলাকার। একের পর এক সাঁজোয়া গাড়ি, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছিল তারা। এক রাতেই তছনছ হয়ে গিয়েছিল শরণার্থী শিবিরটি।

৭ অক্টোবর হামাস বাহিনীর ইজরায়েল আক্রমণের পর থেকেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক-সহ গাজার একাধিক এলাকায় হামাস নেতা ও কর্মীদের উপরে নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। গ্রেফতার হওয়া ফাতাহ নেতাদের উপর চলছে নির্যাতন। বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী কাউকেই ছাড়ছে না ইজরায়েলি সেনা। প্রাথমিক হিসেব বলছে, এখনও পর্যন্ত মোট ৩০ জন গ্রেফতার হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ইজরায়েলি সেনাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে ফিলিস্তিনিরাও। বহু জায়গাতেই সশস্ত্র সংগ্রামেও নেমেছে তারা। ইজরায়েলের মারাত্মক হামলার নিন্দা জানাতে আসা বিক্ষোভকারীদের উপরে নৃশংস ভাবে গুলি চালায় নেতানিয়াহু সেনা। তার মধ্যে ছিল বছর ষোলোর এক কিশোরও। ইজরায়েলি সেনার গুলি ফুঁড়ে দেয় তার বুক।

গাজার অধিকাংশ জায়গাতেই মুহূর্মুহু হামলা চালাচ্ছে ইজরায়েল। ইচ্ছা করেই বারবার ইজরায়েল গাজার টেলিকমিউনিকেশন ভবনগুলিকে রকেট হামলা চালিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যাতে গোটা বিশ্বের থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায় গাজাকে। ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট ব্যবস্থা। জল সরবরাহ বন্ধ। বাসিন্দাদের ন্যূনতম সুস্বাস্থ্যটুকু বজায় রাখাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে গাজায়।

আরও পড়ুন: হামাসের কবল থেকে কবে ফিরবে প্রিয়জনেরা? শয্যা সাজিয়ে অপেক্ষায় জেরুজালেম

হামাসদের শেষ দেখতে চায় ইজরায়েল। আর সেই শেষ দেখার পথে শেষ হয়ে যাচ্ছে গোটা একটা জনপদ। রাষ্ট্রপুঞ্জের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে ফুৎকারে উড়িয়েছে ইজরায়েল। ১২০টিরও বেশি দেশের উদ্বেগের মুখের উপর দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। একেকটা রকেট হামলায় মাটি জুড়ে তৈরি হচ্ছে সাত-আটটি বিশালাকার গর্ত। সেখানে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন অসংখ্য মানুষ, অসংখ্য শিশু। দিনের পর দিন আলো থেকে আরও দূরে, আরও অনেক দূরে সরে যাচ্ছেন বাসিন্দারা, ক্রমে অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে গাজায়।

More Articles