মহিলাদের গর্ভনিরোধকে সহজ করেছিলেন এই বিজ্ঞানী, আড়ালেই রইলেন 'সহেলি'র আবিষ্কর্তা

Saheli Contraceptive Pill: প্রথম দিকে কুকুর, বিড়াল, ইদুর এবং বাঁদরদের দেহে পরীক্ষা করা হয় এই ওষুধ। পরবর্তীকালে বহু মহিলার শরীরেও সেন্টক্রোম্যানের গবেষণা করা হয়। ১৯৯০ সালে ভারত ড্রাগ রেগুলেটরি বোর্ডের মান্যতা পায় এই ও...

জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে জনসংখ্যার নিরিখে চিনকে পিছনে ফেলে প্রথম স্থানে উঠে আসবে ভারত। আগামী ২৫ বছরে চিনের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি থেকে কমে ১৩০ কোটি হবে। তবে এই সময়ে ভারতের মোট জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৬০ কোটি! ক্রমবর্ধমানভাবে জনসংখ্যা চিন্তার কারণ মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। পরিস্থিতির বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়িয়ে খানিক তথ্যতালাশ করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে সহজে। স্যাম্পেল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের (এসআরএস) তথ্য বলছে, গত এক দশকে ভারতের সাধারণ ফার্টিলিটির হার কমেছে ২০ শতাংশ। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশে গড় ফার্টিলিটি রেট ছিল ৮৬.১% যা ২০১৮-২০২০ তে কমে হয়েছে ৬৮.৭%। এই রিপোর্টটি আরও খানিক গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের ফার্টিলিটির হার লক্ষণীয় মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। গ্রামীণ ভারতে ফার্টিলিটি রেট কমেছে প্রায় ২০.২% এবং শহরে ১৫.৬%। এমনকী জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মতে, বর্তমানে ভারতের ফার্টিলিটি রেট মাত্র ২, যা পূর্ববর্তী প্রজন্মের সংখ্যাও পূরণ করতে অক্ষম!

তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, ভারত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সফল। বিশ্বে বিভিন্ন দেশের মতোই ভারত বহুদিন ধরেই নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জনসংখ্যার চাপ কমাতে। এর মধ্যে সর্বাধিক ফলপ্রসূ হয়েছিল ‘সহেলি’ নামক কন্ট্রাসেপটিভ পিলের আবিষ্কার। ১৯৯৫ সালে জাতীয় পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের হাতে চালু হওয়া এই ওষুধ বিশ্বের প্রথম স্টেরয়েডমুক্ত কন্ট্রাসেপটিভ পিল। শত শত ভারতীয় মহিলার কাছে আজাদির বিকল্প হয়ে ওঠে সহেলি। দুই দশক ধরে ডক্টর নিত্য আনন্দের কঠোর গবেষণার ফল ছিল সহেলি। কীভাবে নিত্য আনন্দ এবং তাঁর সহকারী গবেষকরা সফল হলেন সেই কাহিনিও খুবই আকর্ষণীয়।

আরও পড়ুন- ঘিঞ্জি দিঘা, ভিড় দার্জিলিং নয়, এই রাজবাড়িগুলিই এখন শীতের সেরা ডেস্টিনেশন!

ডক্টর নিত্য আনন্দের শুরুর জীবন

১৯২৫ সালের পয়লা জানুয়ারি বর্তমান পাকিস্তানের ফয়জালাবাদে জন্ম নিত্য আনন্দের। পরিবারেই ছিল শিক্ষাচর্চার পরিবেশ। বাবা শ্রী বাই বালমুকুন্দ ছিলেন স্থানীয় কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। অন্যদিকে মা সেই সময় বিধবা ও গরিব মহিলাদের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিতেন। সামাজিক কার্যকলাপের পাশাপাশি তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। লাহোর থেকে স্নাতক ডিগ্রি পাশ করে নিত্য আনন্দ দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন অধ্যাপক কে ভেঙ্কটরমণের কাছে। ভেঙ্কটরমণই ছাত্রের নাম নিত্যানন্দ থেকে করে দিয়েছিলেন নিত্য আনন্দ। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কাজ করতেন তিনি। ১৯৫০ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার কাজ শেষ করে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। আর তার পরের বছর সেন্ট্রাল ড্রাগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রসায়ন বিভাগে লেপ্রসি নিয়ে কাজ শুরু করেন নিত্য আনন্দ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তাঁর বাবা মা চেয়েছিলেন পাকিস্তানেই থেকেই যেতে। কিন্তু সেখানের পরিস্থিতির কথা জানতে পেরে বাবা মাকে নিয়ে ভারতে চলে আসেন নিত্য। টাটা এয়ারলাইনসে কর্মরত বন্ধুর সাহায্যে দু’ঘণ্টার মধ্যে স্বাধীন ভারতে পা রাখে নিত্য আনন্দের পরিবার।

ডক্টর নিত্য আনন্দ

সহেলির আবিষ্কার

১৯৫১ সালে রসায়নবিদ কাল জেরাসি এবং তাঁর সহকারী জর্জ রোসেনক্রান্টজ ও লুইস মিরামন্টেস প্রথম জন্মনিরোধক পিল আবিষ্কার করেন। বৈপ্লবিক এই আবিষ্কার পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। ফলে কোটি কোটি মহিলাদের কাছে গর্ভধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। ডি বালাসুব্রমনিয়াম বহু বছর পরে হিন্দু সংবাদপত্রে বলেছিলেন, এই পিল মহিলাদের শরীরে ওভিউলেশন অর্থাৎ ডিম্বাশয় থেকে পরিণত ডিম্বাণু বেরিয়ে আসার পদ্ধতি বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি এই ওষুধ মহিলাদের যোনিতে উপস্থিত তরলকে আরও গাঢ় এবং চটচটে তরলে পরিণত করে। ফলস্বরূপ শুক্রাণু প্রবেশ করলেও কোনওরূপ নিষেক ঘটে না। তবে মনে রাখা জরুরি, এই ওষুধ নিয়ম করে প্রতিদিন খেতে হবে। এছাড়াও এই সদ্য আবিষ্কৃত গর্ভনিরোধক ওষুধের কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল যেমন বমি বমি ভাব, হঠাৎই যোনি থেকে রক্তপাত এবং এগুলির জন্য দায়ী ছিল ওষুধে উপস্থিত স্টেরয়েড।

আরও পড়ুন- আর কিছুদিনেই পরিত্যক্ত নগরী হতে চলেছে রাজধানী দিল্লি! বিষের বাষ্পে যে ইঙ্গিত

১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে ভারত সরকার নিত্য আনন্দ এবং একাধিক বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলোচনা করে কিছু উন্নত মানের গর্ভনিরোধক ওষুধ তৈরির পরামর্শ দেন। তখন থেকেই লখনউ সেন্ট্রাল রিসার্চ ড্রাগ ইনস্টিটিউটে কাজ শুরু করেন নিত্য আনন্দ এবং তাঁর দল। অতীতের গবেষণা ঘেঁটে তাঁরা জানতে পারেন ইথামক্সিট্রিপথল নামক একটি অণুর কথা, যা প্রাণীদের শরীরে গর্ভনিরোধক হিসেবে আচরণ করে। যদিও মানব শরীরে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছিল। তবে নিত্য আনন্দ এবং তাঁর সহকারীরা এই অণুকে ভর করেই গবেষণা শুরু করেন। অবশেষে ১৯৭১ সালে হাতে আসে সঠিক উপাদানটি। তাঁরা নতুন এই মিশ্রণটির নাম দেন সেন্টক্রোম্যান। শুরু হয় ট্রায়াল। প্রথম দিকে কুকুর, বিড়াল, ইদুর এবং বাঁদরদের দেহে পরীক্ষা করা হয় এই ওষুধ। পরবর্তীকালে বহু মহিলার শরীরেও সেন্টক্রোম্যানের গবেষণা করা হয়। ১৯৯০ সালে ভারত ড্রাগ রেগুলেটরি বোর্ডের মান্যতা পায় এই ওষুধ।

জেরাসির তৈরি প্রথম পিলের সঙ্গে নতুন এই পিলের বেশ কিছু জায়গায় পার্থক্য ছিল। মূল ফারাক ছিল এই ওষুধের ক্রিয়াস্থলেই অর্থাৎ নিত্য আনন্দের তৈরি ওষুধ ওভিউলেশন ও হরমোনের ভারসাম্যের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে নিষিক্ত ডিম্বাণুর ইমপ্ল্যান্টেশনে বাধা সৃষ্টি করে। তাই সহবাসের পরেও এই ওষুধ গ্রহণ করা যায়। পাশাপাশি স্টেরয়েডমুক্ত নতুন ওষুধ প্রতিদিনের পরিবর্তে সপ্তাহে একটা করে খেলেই কাজ করবে। ফলে কোনও মহিলা ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেই পুনরায় গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠবেন। এই সেন্টক্রোম্যানই হয়ে ওঠে ভারতীয় মহিলাদের ‘সহেলি’। এই মুহূর্তে পৃথিবী ব্যাপী এই ওষুধ বিক্রি হয়।

শুধু সহেলি নয় নিত্যানন্দের বহু গবেষণা চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন তথ্য উন্মোচন করেছে। শত শত গবেষণাপত্র, পেটেন্ট রয়েছে তাঁর নামে। ২০১২ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারের সম্মানিত করা হয়েছে আনন্দকে।

More Articles