'ওদিকে তাকালে চোখ খারাপ হয়!' টুকি ও নব্বইয়ের সেই বৈশাখী বিকেল
Kolkata 90's: উদ্বোধনী সংগীত হওয়ার আগেই আকাশ কড়কানোর আওয়াজ পাওয়া গেল।
একটা ব্যাজ। একটা ব্যাজ যে জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তা জানে শুধু এই বিশেষ বিকেলগুলো।হিলিয়াম আলোর চক্করে বিকেলের শেষ আলো মুখচোরা উঠতি বিড়িখোরের মতো সুবিধেজনক গলি খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে ততক্ষণে, আর হিলিয়াম আলোকে কর্তাব্যক্তি ভেবে ভিড় জমাচ্ছে অজস্র পোকা। আমিও ঘুরঘুর করছি পাড়ার দাদাদের চারপাশে, কখনও জুটছে উপেক্ষা, কখনও মৃদু অভয়ের খুচরো ছুড়ে দিচ্ছেন তাকানোর অজুহাতে, সেই আতিশয্যেই দু'সারি কার্ডবোর্ডের চেয়ার পেতে ফেলছি আমি।
ভোম্বলদা চেয়ার বাগিয়ে বসে গেছেন, মাইক টেস্টিং! মাইকের প্রতি ভোম্বলদার অপত্য স্নেহ, তেমনই অধিকারবোধ। যে-কোনও কারণেই পাড়ায় মাইক আসুক, ভোম্বলদার মাইক চাই। তার জন্য ত্যাগস্বীকার অবশ্য কিছু কম করেন না ভোম্বলদা, এমনও হয়েছে, পুরো পরিবার ঝেঁটিয়ে গেছে কাশ্মীর, ভোম্বলদা আজাদগড়ের বান্টি হারিয়ে গেলে কোথায় যোগাযোগ করবে বলার জন্য 'মজলিশ'-এর তড়কা, রুটি খেয়ে পুরো পুজো কাটিয়ে দিয়েছে, কিন্তু মাইক ছাড়েনি।
এহেন ভোম্বলদা যে সন্ধে পড়ার আগেই মাইকের দখল নেবেন, তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। চেয়ার পাতা আমাদের সারা, তাতেও অসুবিধে নেই। টুকি চলে আসবে, একটা ব্যাজ আমার লাগবে ও আসার আগেই, যেভাবেই হোক। টুকি রবীন্দ্রসংগীতের দলে আছে, ওরা সবাই বাবুসোনার বাড়িতে তৈরি হচ্ছে, তবলার ঠুকঠাক, হালকা হাসির উচ্ছ্বাস- সবই ভেসে আসছে ওদের বাড়ি থেকে। তা আসুক, টুকি যে এখনও আসেনি, তা আমি বিলক্ষণ জানি।
আরও পড়ুন: যারা ফিতে কাটছে পারিশ্রমিক নিয়ে, বেশ করছে! শিল্পীদের সময়ের দাম আছে বইকি
প্রায় একসঙ্গেই ঘটল ঘটনাটা, পাড়ার দাদা দয়াপরবশ হয়ে ব্যাজ পরাচ্ছিল, এমন সময় মাঠের এক কোনা দিয়ে হেঁটে আস্তে দেখলাম টুকিকে। বুকে সেফটিপিন ফুটল কি? জানি না। আসলে ঠিক তার আশপাশে এত অজস্র পিন ফুটছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে, সেফটি পিন কোন ছাড় যে, টের পাব? ভাগ্য করে কিছু বেলফুল জন্মেছিল আজ, যারা ওর খোঁপার স্রোতে থমকে আছে, পঁচিশে বৈশাখের ঘাম ব্লাউজের ওপরের পিঠের অংশে জমে আছে শিশিরের মতো। আমার দিকে একটিবারও না তাকিয়ে ও বাবুসোনাদের বাড়িতে ঢুকে গেল।
সময়টা মে মাসের শুরু হলেও বিকেলবেলা মাঝেমধ্যে আশ্চর্য লিলুয়া বাতাস বয় এই সময়, যা আজও বইল খানিক এই অলক্ষুণে সময়টাতেই। মিষ্টুদি-দের চিলতে বাগান কেঁপে উঠল ওই হাওয়ায় সলতের মতো। আমার মনকেমনের সঙ্গী হলো শুধু বাবুয়াদার গ্রিল কারখানার ঝালাই মেশিন। ওদিকে বেশিক্ষণ তাকালে চোখ খারাপ হয় জানতাম, কিন্তু মন কবে বারণ শুনেছে? মন তো আলোর চারপাশে ভিড় করা ওই পোকাগুলো অথবা টুকির চারপাশে আমি।
সন্ধে পেকে উঠেছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে ব্যাজেদের ব্যাস্ততা। বয়স্কদের ধরে চেয়ারে বসাচ্ছি, যিনি হয়তো বিন্দুমাত্র উৎসাহী নন, শুধুমাত্র সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছেন; তাদেরকেও ধরে বসিয়ে দিই পারলে। এদিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ক্যাঁচাল, লোকাল কাউন্সিলরকে পায়রা দেওয়া হয়েছে ওড়ানোর জন্য, তিনি ওড়াবেনই, কমলদার পায়রাও তেমন গোঁ ধরেছে, উড়বে না। শেষে খেপে গিয়ে যখন উনি দু'হাতে পায়রা চেপে ধরে ইন্টারন্যাশনাল গাইতে শুরু করলেন ওকে ধরে ধরে নামানো হলো।
কিন্তু উদ্বোধনী সংগীত হওয়ার আগেই আকাশ কড়কানোর আওয়াজ পাওয়া গেল, তারপর যেমনটা হয়ে থাকে বৈশাখী বিকেলে, মুহূর্তে সব লন্ডভন্ড। মঞ্চের পিছনের টেম্পোরারি সাজঘর উড়ে গেছে, তাই সবাই মঞ্চে জড়ো হয়েছি বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য। টুকির মুখ ভার, ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
-কী রে? খারাপ লাগছে?'
টুকি বৃষ্টি দেখতে দেখতেই বলল, "খারাপ লাগবে না? সব ভেস্তে গেল।"
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, "ওয়ার্ড কমিটি তো বলেছে, পরের রবিবার করবে।"
-পরের রবিবার!
নিজের মনে শব্দদুটোর ওজন করল যেন, তারপর নিজের মনেই বলল, "আবার সাজতে হবে?"
টুকির এই প্রশ্নের উত্তর তৈরি ছিল, বললাম, "প্লিজ সাজিস।"
তারপর আর ওর সামনে দাঁড়াইনি। স্বেচ্ছাসেবকের কি আর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে চলে?
“বাবা”, সহজের ডাকে চটকা ভাঙল। শেরউড-এ আজকে বিজয়া সম্মিলনী, তাই মিস জোজো মানে জোজোদি আসবে। সহজ তাই নিয়ে প্রবল উত্তেজিত, আমাকে তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়েছে যাতে তাড়াতাড়ি সাইকেল প্র্যাকটিস সেরে শো শুরু থেকে দেখতে পারে। আমার চোখের সামনে মঞ্চ তৈরি হচ্ছে, আমি সেসব দেখতে দেখতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। সহজ আমার পাশে বসতে বসতে বলল, "বাবা দেখো, জাস্ট লাইক তারাবাতি", আমি তাকিয়ে দেখলাম মঞ্চের এককোনায় শেষ মুহূর্তের ঝালাই চলছে কিছুর। আমি বললাম, "ওদিকে তাকিও না সহজ, চোখ খারাপ হয়।"