সভ্য সমাজের জারোয়া ঘৃণার পিছনে লুকিয়ে এক ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতার গল্প

একটার পর একটা দিন চলে যায়। দিন শেষের সূর্য সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে দেয় মুঠো মুঠো আবির। উত্তাল সমুদ্র আর শেষ বিকেলের সূর্যকে সঙ্গী করে সমগ্র প্রকৃতি মেতে ওঠে অপূর্ব এক রঙের খেলায়। আন্দামান - ব্রিটিশ যুগের কালাপানি। বর্তমান সময়েও সাধারণ মানুষের কাছে আন্দামান পরিচিত ' পানিশমেন্ট পোস্টিং ' নামে। অথচ এই আন্দামানের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। যে ইতিহাস সুভাষের গল্প বলে, শহিদ ও স্বরাজ দ্বীপের গল্প বলে, গল্প বলে দেশের স্বাধীনতার জন্য চান কবুল লড়াইয়ের। পোর্ট ব্লেয়ার, লিটল আন্দামান, ডানকান প্যাসেজের প্রতিটা মোড়ে দাঁড়িয়ে ইতিহাস যেন সর্বক্ষণ হাতছানি দেয় আমাদের।

কিন্তু সব ইতিহাস কি দেশের জন্য স্বার্থহীন আত্মত্যাগের? নাকি তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে লজ্জা, দীনতা, বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্ক?  হ্যাঁ, আছে বইকি। ইতিহাসের পাতায় সকলের অগোচরে রয়ে গেছে এমন হাজারো বিশ্বাসঘাতক যাদের জন্য বারংবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। যে আন্দামান বিপ্লবী সুভাষের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে সেই আন্দামানের বুকেই রচিত হয়েছে লজ্জার এক অন্যতম অধ্যায়। 

সালটা ১৮৫৭। ভারতের মাটিতে তখন চলছে লর্ড ক্যানিংয়ের রাজত্বকাল। ইতিহাসের পাতা বলছে সময়টা উত্তাল। ভারতের বাতাসে বারুদের গন্ধ তখনও টাটকা। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের মাত্রা প্রতিনিয়ত এমন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে ঠিক একইভাবে ইংরেজ সরকারের দমননীতির গ্রাফ চড়ছে পাল্লা দিয়ে। এমনই এক অস্থির পরিস্থিতিতে ভারতবাসীর বিদ্রোহের বহ্নিশিখায় নতুন করে ঘৃতাহুতি করল সিপাহী বিদ্রোহ। তবে ১৮৫৭ নয়, তার বহু আগে থেকেই প্রস্তুত হয়েছিল এই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট। বিভিন্ন অজুহাতে লর্ড ডালহৌসি ঝাসি নাগপুর সাতারা প্রভৃতি রাজ্যগুলি দখল করলে ভারতবাসীর মনে ক্ষোভের বারুদ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। অন্য দিকে দেশীয় পণ্যের বাজারকে বিনষ্ট করে ভারতবর্ষে আমদানি হতে থাকে প্রচুর পরিমাণে বিদেশী পণ্য। ফলে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম বেকারত্বের, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কৃষকদের গলায় ফাঁসির দড়ি রূপে দেখা যায় এই সময় থেকেই। ফলে ভারতবর্ষের মধ্যে বিদ্রোহের মশাল প্রস্তুত ছিল বহুদিন ধরেই। নতুন করে সেই মশালে অগ্নিসংযোগ করে একটি ঘটনা - ১৮৫৭ সালের প্রথম দিকে এনফিল্ড রাইফেলের টোটা ব্যবহারে অসম্মত হন ভারতীয় সিপাহীরা। কারণ হিসেবে তারা জানান রাইফেলের টোটাটি গরু এবং শুয়োরের চর্বি দ্বারা নির্মিত।

আরও পড়ুন-তুলোর হৃদয় শুকনো ফুলের প্রেমদিবস কি বাঙালিয়ানা?

ফলে হিন্দু ও মুসলিম উভয়পক্ষকেই ধর্মচ্যুত হবার ভয় তারা করছিল প্রতি মুহূর্তে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি বহরমপুরের সেনানিবাসে বিক্ষোভ দেখান সিপাহীরা। ফেব্রুয়ারি মাসে যে আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল কয়েকজনের বিক্ষোভে, মার্চ মাসে তাই রূপ নিল বাঁধভাঙ্গা জনসমুদ্রে।২৯ শে মার্চ মঙ্গল পান্ডে সরাসরি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। বাংলার বুকে রচিত হলো স্বাধীনতা আন্দোলনের আর এক নবতম অধ্যায় - সিপাহী বিদ্রোহ।

'সবুজ দ্বীপের রাজা' সিনেমাটির কথা মনে আছে? যেখানে বিপ্লবী গুণদা তালুকদার একপ্রকার স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন সভ্য জগতে থেকে? তিনি থেকে গিয়েছিলেন জারোয়াদের সঙ্গে - এও তেমন এক বিপ্লবীর গল্প। যদিও এ গল্পে আগাগোড়া মিশে আছে স্বার্থপরতা আর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। দুধনাথ তেওয়ারি ছিলেন ১৪ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের পদাতিক বাহিনীর একজন সৈনিক। ১৮৫৮ সালের ৬ই এপ্রিল সিপাহী বিদ্রোহের যোগদানের অপরাধে দুধনাথকে নিয়ে আসা হল নিয়ে আসা হল আন্দামানে। তৎকালীন সময়ে আন্দামানে দ্বীপান্তরের দণ্ডাদেশ পাওয়া মানে সাক্ষাৎ যমের শমন হাতে পাওয়া। একাকিত্বের যন্ত্রণা যেমন বন্দীদের দগ্ধ করে মারতো সর্বক্ষণ তারই সঙ্গে দোসর হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ সরকারের নির্মম অত্যাচার। যদিও দেশমাতৃকার বন্দনার তুলনায় বিপ্লবীদের কাছে এ ত্যাগস্বীকার ছিল তুচ্ছ। কিন্তু দুধনাথ ছিলেন ব্যতিক্রম, তার বিপ্লবী মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক বিশ্বাসঘাতকের ঘৃণ্য চেহারা।

১৮৫৮ সালের ২৩  এপ্রিল। দুধনাথের জীবনে এক উল্লেখযোগ্য দিন। শুধু দুধনাথ নয়, ভারতের ইতিহাসেও এই দিনটি উল্লেখযোগ্য। কারণ এই দিনেই দুধনাথ-সহ আরও বেশ কিছুজন বন্দি( সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে, প্রায় ৯০ জন বলে মনে করা হয়) ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান, আর এরই সঙ্গে ভারতের ইতিহাসের শুরু হলো এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। সেই সময় আন্দামানের একচ্ছত্র অধিপতি ছিল জারোয়া সহ আরো বেশ কিছু উপজাতি। কোনো এক অজানা কারণে সভ্য জগতে থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ তারা। অবশ্য সেই অর্থে যাদের তথাকথিত 'সভ্য' বলে আমরা অভিহিত করি তারাই একসময় অনধিকার প্রবেশ করেছে জারোয়াদের এলাকায়। ফলশ্রুতি হয়েছে ভয়ঙ্কর - বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব উপজাতিদের বিষাক্ত তীর সেইসব ' সভ্য' মানুষদের পৌঁছে দিয়েছে মৃত্যুর দরজায়। না, বাদ যায়নি ব্রিটিশরাও। কোনো এক অলিখিত নিয়মে এ দেশের শত্রু এবং মিত্রের তফাৎ বুঝতে শিখে নিয়েছিল এই 'অসভ্য' তকমা পাওয়া মানুষগুলো। তাই বারংবার সভ্য মানুষরা তাদের তীরের মুখে পড়লেও দুধনাথকে তারা আপন করে নিয়েছিল কোন এক অজানা কারণে, আর এই বন্ধুত্বের মাশুল তাদের দিতে হয়েছিল আজীবন।

জারোয়ারা আশ্রয় দিয়েছিল পলাতক দুধনাথকে। শুধু তাই নয়, জারোয়াদের সঙ্গে বসবাসের চার মাসের মাথায় দুধনাথ লিপা এবং জিগা নামক দুই যুবতীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হন। প্রথমদিন থেকেই দুধনাথ যে জারোয়াদের কাছে সমাদর পেয়ে এসেছেন এমন নয়, তার সঙ্গীদেরই জারোয়াদের তীরের আঘাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। এমনকী প্রথম দিকে জারোয়াদের শিকার অথবা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে দুধনাথ যোগ দিতে পারত না। যদিও লিপা ও জিগার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর জারোয়ারা দুধনাথকে তাদেরই একজন বলে ভাবতে শুরু করে।

১৭ মে, ১৮৫৯। তার কিছুদিন আগে থেকেই জারোয়াদের মধ্যে প্রস্তুতি ছিল তুঙ্গে। ব্রিটিশদের উপর প্রাণঘাতী আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল জারোয়াদের। অথচ সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় বিশ্বাসঘাতক দুধনাথের জন্য। দুধনাথ এবং তার সঙ্গী সাদুল ১৮৫৯ সালের ১৭ মে জারোয়াদের যুদ্ধপ্রস্তুতির ব্যাপারে খবর দেয় ব্রিটিশ সরকারকে। এই খবর পাওয়ার পর লেফটেন্যান্ট ওয়ার্ডেন শার্লট নামক জাহাজ কে সঙ্গে নিয়ে জারোয়াদের প্রতিআক্রমণ করলেন। না, জারোয়ারা হার মানেনি। ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সামনে তীরধনুক হাতেই লড়ে গিয়েছিল তারা। একের পর এক তীরের মুখে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন লেফটেন্যান্ট ওয়ারডেন। আদিবাসীদের চোয়াল চাপা লড়াইয়ের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হলেন তিনি। ইতিহাসে এই যুদ্ধ পরিচিত 'অ্যাবারডিনের যুদ্ধ' নামে। ১৮৬০ সাল নাগাদ দুধনাথ এবং তার সঙ্গী সাদুল রাজভক্তির পুরস্কার লাভ করে। ব্রিটিশ সরকার মুক্তি দেয় দুধনাথ এবং সাদুলকে। দুধনাথের স্ত্রী লিপা তখন গর্ভবতী।

আন্দামানের যে মাটিতে সুভাষ উড়িয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা, দুধনাথ সেই মাটিতেই রচনা করলেন স্বার্থপরতার দিনপঞ্জি। সেইসঙ্গে জারোয়াদের মনে আরো একবার রোপিত হলো সভ্য জগতের প্রতি বিদ্বেষের বীজ।

তথ্যসূত্র:

১. 'জারোয়াদের দেশে'- জয়ন্ত সরকার
২. https://wikigbn.icu/wiki/Dudhnath_Tewari
৩.https://www.prohor.in/robbaranda-amit-ray-kalapani-andamaan-4

More Articles