দশপ্রহরণধারিণী, দশ হাতের দশ অস্ত্রের অর্থেই লুকিয়ে সৃষ্টি থেকে প্রলয়ের রহস্য
Durga Puja 2022: অগ্নিদেব মহামায়াকে দেন তেজ। সূর্যদেব প্রদান করেন তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ। বিশ্বকর্মা দুর্গাকে দেন অভেদ্য কবচ কুণ্ডল
আর ১৭-১৮ দিনের অপেক্ষা। তারপরেই শুরু হচ্ছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। নতুন জামার গন্ধ, শিউলি ফুল, কুমোরটুলিতে মূর্তি গড়ার তোড়জোড়, সবই চলছে নিজের গতিতে। মহালয়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বেজে উঠতেই ঘুম ভাঙে বাঙালির। গানের কথাতেই দুর্গাকে ‘দশপ্রহরণধারিণী’ রূপে চেনা। প্রহরণ শব্দের অর্থ, যার দ্বারা সংহার করা হয় অর্থাৎ অস্ত্র। দশ হাতে দশটি অস্ত্র নিয়েই মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন দুর্গা। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, মহিষাসুরকে বধের জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের সঙ্গে একযোগে সকল দেবতার শক্তি মিলিত হলে মহামায়া আবির্ভূত হন, যিনি পরে দুর্গার রূপ ধারণ করেন। প্রত্যেক দেবতার তেজে মহামায়ার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠে এবং দশটি হাত আবির্ভূত হয়।
কাহিনি অনুযায়ী, দশটি হাত পৃথিবীর দশটি দিকের প্রতীক। এই দশটি হাতে অস্ত্র দান করেছিলেন দেবতারা। দেবী মূর্তির দিকে তাকালে দেখা যায় আটটি হাতে পৃথক পৃথক অস্ত্র থাকলেও দু’টি হাতে শুধু তিনি একটিই ত্রিশূল ধারণ করে অসুর নিধন করেছেন। মহাদেবের থেকে ত্রিশূল, বিষ্ণুর চক্র, বরুণদেবের শঙ্খ, অগ্নিদেবের থেকে অগ্নিভল্ল, পবনদেবের ধনু ও তূণ, ইন্দ্রের থেকে বজ্র, যমরাজের থেকে গদা বা কালদণ্ড, ব্রহ্মার থেকে পদ্ম অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, নাগরাজের থেকে নাগপাশ, ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতের থেকে দেবী পান ঘণ্টা এবং সর্বশেষে সিদ্ধিদাতা গণেশ দেবীকে দেন খড়্গ। এছাড়াও বিশ্বকর্মা দিয়েছিলেন কুঠার ও ঢাল। এই প্রতিটি অস্ত্রের বিশেষ তাৎপর্য আছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দুর্গার উৎপত্তি সম্পর্কে প্রথম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ত্রিশূল– দুর্গার হাতে এই ত্রিশূলই মূলত প্রধান অস্ত্র। পুরাণ মতে, মহিষাসুর বধের সময় যখন সমস্ত দেবতারা দেবীকে এক একটি অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করছেন তার মধ্যে সর্বশেষ অস্ত্র বা বলা চলে ব্রহ্মাস্ত্র ছিল মহাদেবের এই ত্রিশূল যা দিয়ে দুর্গা মহিষ রূপী অসুরের সংহার করেছিলেন। শাস্ত্র মতে, ত্রিশূল ত্রিগুণের প্রতীক অর্থাৎ সতঃ, রজঃ এবং তমঃ।
সতঃ গুণকে বলে দেবগুণ অর্থাৎ এই গুণ নিরহংকার, ত্যাগ ও উচ্চ অলৌকিকত্বের প্রকাশ যা শুধুমাত্র দেবতাদের থাকা অসম্ভব।
রজঃ গুণ হল জীব কূলের গুণ অর্থাৎ মানুষ যেমন শোক, লোভ, মায়া, মোহ, কাম, দুঃখ দ্বারা সর্বদা জর্জরিত থাকে। এই গুণ মানুষের মায়া স্বরূপ।
তমঃ গুণ হল রাক্ষস বা ঋণাত্মক শক্তির প্রকাশ অর্থাৎ সব ধ্বংসের মূল হল এই ক্রোধ, লোভ, মিথ্যা, বিলাসিতা, প্রতারণা, চুরি, হত্যা ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজ।
ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ত্রিশূলের মাঝের ফলাটি সতঃ গুণ এবং বাকি দুই দিকে রজঃ গুণ এবং তমঃ গুণ সমান উচ্চতা বিশিষ্ট দুটি ফলা। অর্থাৎ মানব জীবনের লক্ষ্য হল সতঃগুণের বিকাশ যা তাদের মুক্তির পথ দেখাবে।
আরও পড়ুন- নিম্নচাপে ভাসবে শহর, এমন বৃষ্টি কি চলবে পুজো অবধি?
শঙ্খ –দুর্গার বাঁ হাতে শাঁখ থাকে। বরুণ দেব এই অস্ত্র প্রদান করেছিলেন এবং সমগ্র জীব জগতের স্পন্দন রূপে এই অস্ত্র দেবীর হাতে সজ্জিত থাকে। শঙ্খ জাগরণের প্রতীক। যুদ্ধের সময় এর শব্দ যেমন শত্রুকে সতর্ক করে তেমনি জাগরণী শক্তি হিসেবেও কাজ করে। বলা হয়, সৃষ্টির শুরুতে যখন সমস্ত চরাচর জলমগ্ন ছিল তখন বিষ্ণু শাঁখের আধারে সমুদ্রের নীচে অবস্থান করছিলেন। দেবতাদের প্রার্থনায় তিনি সমুদ্র থেকে শাঁখ সঙ্গে নিয়ে উঠে আসেন।
আবার একদলের মতে, শাঁখ একপ্রকার সামুদ্রিক জলজ শামুক গোত্রীয় প্রাণীর দেহকোষ থেকে নির্মিত। তাই শঙ্খ জগৎ সৃষ্টির প্রথম প্রাণের স্পন্দন স্বরূপ। সেক্ষেত্রে প্রাণ শক্তির উৎস হিসেবে শাঁখ থাকে দুর্গার হাতে।
চক্র – দুর্গার ডান হাতে থাকে সুদর্শন চক্র। এর অর্থ সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রে রয়েছেন দুর্গা এবং তাকে কেন্দ্র করে সমস্ত বিশ্ব আবর্তিত হচ্ছে। অপরদিকে ‘সু’ কথার অর্থ সুন্দর আর ‘দর্শন’ কথার অর্থ দৃশ্যমান। সুদর্শন চক্র এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অপার সৌন্দর্যের প্রতীক। বিশ্বকর্মা বিষ্ণুর জন্য এই চক্র নির্মাণ করেছিলেন।
খড়্গ– দুর্গার ডান হাতে খড়্গ বা খাঁড়া থাকে। খাঁড়া দিয়ে দুর্গা অসুরের মাথা ছিন্ন করে সেই মুণ্ডমালা নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। খড়্গ হল বলি প্রদানের অস্ত্র। বলি হল, বিবেক বুদ্ধির মধ্যে নিহিত অশুভের নিধন যজ্ঞ। হিংসা, গ্লানি, ক্রোধ, অহং সহ ষড়রিপু থেকে নিজের আত্মাকে শুদ্ধির প্রক্রিয়া। তাই দুর্গার হাতে সজ্জিত খড়্গ হল মোক্ষের প্রতীক। এই খড়্গ অভয় প্রদানকারী।
কালদণ্ড বা গদা– গদা বা কালদণ্ড এই অস্ত্রটি মহিষাসুর নিধন যজ্ঞে মহামায়াকে দান করেছিলেন ধর্মরাজ যম। গদা প্রীতি ও আনুগত্যের প্রতীক। কালের কাছে সকলেই অনুগত। দেব-দেবী-মানুষ সকল শুভ-অশুভ শক্তি এই মহামায়ার নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই দুর্গার বাঁ হাতে থাকা কালদণ্ড সম্মোহনকারী শক্তির প্রতীক।
ধনুর্বাণ– তির ও ধনুক দুর্গার বাঁ হাতে থাকে। পবনদেব দুর্গাকে এই ধনুর্বাণ দান করেছিলেন। স্থির লক্ষ্য এবং ঋণাত্মক শক্তির প্রতীক এই তির-ধনুক। জীবনের সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লক্ষ্য স্থির রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায় তির-ধনুক।
ঘণ্টা– দেবীর বাঁ হাতে থাকে ঘণ্টা। ঘণ্টা অস্ত্রটি চণ্ডীকে দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত দান করেছিলেন। ঘণ্টা ডঙ্কার ধ্বনি যুদ্ধের আহ্বান করে। তা আসুরিক শক্তিকে দুর্বল করে। শ্রী শ্রী চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গা মহিষাসুরকে আহ্বান করার সময় সতর্ক বার্তা স্বরূপ অট্টহাসি হাসেন এবং শঙ্খ ও ঘণ্টার ধ্বনিতে যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ দেন।
নাগপাশ–দুর্গার বাঁ হাতের নীচের দিকে নাগপাশ থাকে যা বরুণ দেব প্রদান করেছিলেন। নাগপাশ বিশুদ্ধ চেতনার প্রতীক। তবে এ নিয়ে দ্বিমত আছে। নাগপাশ অনন্ত নাগ অস্ত্র হিসাবে প্রদান করেছিলেন বলেও জানা যায়। দেবী যখন মহিষরূপী অসুরকে নিয়ন্ত্রণ করতে ক্লান্ত তখন একমাত্র নাগপাশেই তিনি ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তনকারী অসুরকে আবদ্ধ করে তার কেশ বাঁ হাতের মুঠোয় ধরেন। আর নাগপাশে জর্জরিত অসুরের চেতনা ফেরে যে তিনি বন্দি হয়েছেন। দুর্গা বাঁ হাতের নাগপাশে আবদ্ধ অসুরকে ধরেন, তার উরুতে নিজের বাম পা রেখে মহিষাসুরকে বধ করেন।
আরও পড়ুন- দুর্গাপুজোয় সারা রাতের প্ল্যান! রইল কলকাতার সেরা রুফটপ লাউঞ্জের সেরা ঠিকানা-মেনু-খরচ
বজ্র- দুর্গার বাঁ হাতে থাকে ব্রজ্র। দেবরাজ ইন্দ্র এই অস্ত্র প্রদান করেছিলেন। যা দৃঢ়তা এবং সংহতির প্রতীক। এই দু’টি গুণের বশেই মানুষ জীবনে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়। দেবীর হাতের এই বজ্র দধীচি মুনির হাড় দিয়ে তৈরি।
পদ্ম, অক্ষমালা এবং কমণ্ডলু– দুর্গাকে পদ্ম, অক্ষমালা এবং কমণ্ডলু প্রদান করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। পদ্ম পাঁকে জন্মালেও সে পবিত্র। অসুরেরা তাদের ভিতরের অন্ধকার থেকে যেন মুক্ত হয় এই বার্তা দেয় পদ্মফুল। পদ্ম একাধারে সর্বশক্তির আধার। এছাড়া দুর্গার ডান হাতে থাকা অক্ষমালা এবং কমণ্ডলু পবিত্রতার প্রতীক।
এইসব অস্ত্র ছাড়াও দেবীকে নানা আবরণে সুসজ্জিত করেছিলেন কুবের। ধনদেব কুবের দুর্গাকে নানাবিধ অলঙ্কারে সাজিয়ে তুলেছিলেন। অগ্নিদেব মহামায়াকে দেন তেজ। সূর্যদেব প্রদান করেন তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ। বিশ্বকর্মা দুর্গাকে দেন অভেদ্য কবচ কুণ্ডল এবং অক্ষয় বস্ত্র যা তাঁর রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। হিমালয় বা গিরিরাজ দুর্গাকে দিয়েছিলেন তাঁর বাহন সিংহ। দেবতাদের মিলিত তেজে আর শক্তিতে বলীয়ান হয়েই দুর্গা অসুর নিধন করে মহিষাসুরমর্দিনী রূপ লাভ করেন।