ক্লাইভ বলে উঠলেন 'দুগ্গা দুগ্গা' || শোভাবাজারের দেবদের বাবুয়ানি
সেকালের কথা
কলকাতা জাঁকিয়ে দুর্গাপুজো হচ্ছে,সাহেব মেম ভিড় করে করে সেই পুজো দেখছেন। তিনকাঠি পড়ছে ঢাকে, দর্পণে দেবীমুখ উদ্ভাসিত, হঠাৎই রবার্ট ক্লাইভ বলে উঠলেন দুগ্গা দুগ্গা! হইহই পড়ে গেল দু্র্গাদালানে। সিনেমার মতো এই দৃশ্য বাস্তবেই মঞ্চস্থ হয়েছে এ শহরে, শোভাবাজার রাজবাড়িতে। কালের কষ্ঠিপাথরে ঘষে দেখলে মনে হবে এ তো বহুকাল আগের কথা, কিন্তু এ বই সে বই ঘাঁটতে বসে মনে হয় এই তো সেদিনের কাহিনি। মনে হয় ঘুরে আসি পুজো শুরুর শোভাবাজারে।
নবকুমার ভট্টাচার্য ‘দুর্গা ও দুর্গোৎসব’গ্রন্থে ‘প্রাচীন কলকাতার দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধে উল্লেখ করছেন – “১৭.১০.১৮২৯ তারিখের ‘সমাচার দর্পণ পত্রিকায় মন্তব্য করে যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সর্বপ্রথম দুর্গোৎসবে বড় জাঁকজমক করেন এবং তাঁর দৃষ্টান্ত দেখে ব্রিটিশ সরকারের আমলে যারা ধনী হয়েছেন, তাঁরা দেশের অধিপতির সামনে নিজেদের সম্পদ প্রদর্শন করতে আর ভীত নন। ... কলকাতার বাবুরা দুর্গোৎসবে তা অনুকরণ করেছিলেন, বিশেষ করে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব।“ ইংরেজদের সহায়তায় ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থাগমের প্রভূত সুযোগ পেয়েছিল কলকাতার কিছু বাঙালি। মদ্যপান, বাইজি নাচ, বিড়ালের বিয়েতে লাখ টাকা ওড়ানো, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, বুলবুলির লড়াই-এমন হাজারো বাবুয়ানি আর বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি তারা। অতীতের সেই জমক আজ নেই, কলকাতার বনেদি বাড়িগুলিতে পুজোগুলি আজও সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়, দুর্গাদালানে শ্বাস ফেলে যায় কত ইতিহাস। বাবুবাড়ির হাঁড়ির ঘবর হাটে মাঠে রটে, যা রটে তার কিছু তো ঘটে।
পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পরাজয় ঘটলে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন লর্ড ক্লাইভ। যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করার জন্য প্রভূত ধন সম্পত্তি পুরস্কার হিসাবে পান রাজা নবকৃষ্ণ দেব। এই সম্পত্তির বহর আজও ঘুরে দেখতে পারে যে কোনও কলকাতা-পাগল, সেকালের বাবুয়ানি নেই বটে, তবে তার মৌতাতটুকু আছে।
ইংরেজদের সঙ্গে নবকৃষ্ণ দেবদের সম্পর্ক অনেকটা আগে থেকেই। নবকৃষ্ণ ছিলেন কার্যত লর্ড ক্লাইভের ডানহাত। কম বয়স থেকেই বাংলা, ফারসি, উর্দু, আরবি-এই চার ভাষাতেই পারঙ্গম ছিলেন নবকৃষ্ণ। মীরজাফর, রাজবল্লভদের চিঠির পাঠোদ্ধার করতে লর্ড ক্লাইভ তারই দ্বারস্থ হতেন। ক্লাইভকে খুশি করেই পুরস্কার পান নবকৃষ্ণ। তাঁকে নাকি ৬০০০ মনসবদারি আর ৪০০০ অশ্বারোহী দিয়েছিলেন ক্লাইভ।
‘বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি’ গ্রন্থে দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ি সম্পর্কে লিখেছেন—“তেরো বিঘে পাঁচ ছ'টাকের কিছু বেশি জমির ওপর তৈরি এই প্রাসাদটি নাকি ছিল প্রথমে শোভারাম বসাকের। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর নবকৃষ্ণ এটি হাতে পান।’’ ১৭৫৭ সালে নবকৃষ্ণই প্রথম বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন, যা আসলে ছিল ক্লাইভের ভিক্ট্রি কার্নিভাল- বিজয়োৎসব। লর্ড ক্লাইভ স্বয়ং যোগ দেন এই মোচ্ছবে। ইংরেজ সাহেব এবং অতিথি অভ্যাগতদের জন্য ছিল বিপুল বিনোদন এবং পানভোজনের ব্যবস্থা। ৩৩/আর রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের বাড়িটি নবকৃষ্ণ দেবের দত্তক পুত্র গোপীমোহন দেব এবং তাঁর উত্তরসূরিদের। এই বাড়িতেই নবকৃষ্ণ প্রথম পুজো করেন। বিবাহের পর দীর্ঘকাল নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। অবশেষে ১৭৬৮ সালে বড়দাদা রামসুন্দরের ছেলে গোপীমোহনকে দত্তক নেন। ১৭৮২ সালে জন্মায় নিজের ঔরসজাত সন্তান ,রাজকৃষ্ণ। ১৭৯০ সালে পণ্ডিতদের গণনা অনুযায়ী রাজকৃষ্ণের জন্য রাস্তার উত্তরদিকে ঠাকুরদালান সহ তৈরি করেন ছ’মহলা বাড়ি। সেই বছর থেকে এই বাড়িতেও শুরু হয় দুর্গাপুজো।
শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় অতিথিদের জন্য অন্যতম বিনোদন ছিল বাইজি নাচ। শ্রীপান্থ তাঁর ‘কলকাতা’ গ্রন্থে ‘কোম্পানির দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধে পুজোয় বিনোদনের ব্যবস্থার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখেছেন—“১৮২৬ সালের গভর্নমেন্ট গেজেট লিখছে : গোপীমোহন দেবের বাড়িতে নাচবার জন্য সুদুর ব্রমহদেশ দেশ থেকে একদল সুন্দরি এবং সুগায়িকা নর্তকী আনা হয়েছে।নাচের সঙ্গে পুজোয় আর একটি উপাচার ছিল সঙ। তারা কখনও রণ পা চড়ে নেচে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত, কখনও বা বসে বসে কাচের বোতল চিবোতো। কোনও কোনও সাহেব সন্দেহ করেছেন, তাঁরা চলে আসার পর নাটমন্দিরের দরজা বন্ধ করে এই সব সঙেরা নিশ্চয় তাঁদের এবং তাঁদের বিবিদের ভাবভঙ্গি নকল করে বাবুদের মজা দিত।’’
শোভাবাজারে লক্ষনৌ থেকেও বক্ষে কাঁচুলি কর্ণে কর্ণভুষা নয়নে অঞ্জন ওষ্ঠে মিসি বাইজী এসেছিল প্রমোদের আঁচে ঘৃত ঢালতে। শোনা যায় নিকি নামক নর্তকীকে বাইজি নাচের আসরে আনার কথা বলেছিলেন স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ। কে এই নিকি? সে সময় কলকাতা মাতাতেন যাঁরা তাদের নাম- আসরন, জিন্নাত, বেগমজান, হিঙ্গুলা, মীর্জাজান, নান্নীজান, সুপনজান প্রমুখ। নিকি ছিলেন এদের সকলের ঈর্ষার পাত্রী।
শোভাবাজারে দশমীর দিন থাকত এলাহি আয়োজন। গাঁজা, চড়স, দুধ, ভ্যালসা অম্বুরী ,ইরানি তামাকের নেশায় মাত শহরের বাবুদের কে দেখে! নবকৃষ্ণ দেবের বাবুয়ানির গল্প বলে শেষ করা যাবে না। সেকালে তিনি মায়ের শ্রাদ্ধে ১০ লক্ষ টাকা খরচ করে লোক খাইয়েছিলেন। বেহালা থেকে কুলপি-প্রায় ৫২ কিলোমিটার রাস্তা তাঁরই তৈরি করা। কলকাতা মাদ্রাসা তৈরি করার অর্থও তিনিই প্রদান করেন। আবার সেন্ট জনস গির্জা তৈরির অর্থানুদানও তিনিই দেন। কলকাতার আদিবাবুরা অনেকেই নব্যবাবু নবকৃষ্ণকে বাঁকা চোখে দেখতেন। তবে এ শহরের ইতিহাস লিখতে বসে তাঁকে বাদ দিতে পারেননি কোনও ঐতিহাসিকই।
শোভাবাজার রাজবাড়ি: এখন
গোপীমোহন দেবের বাড়িতে রথের দিন এবং রাজকৃষ্ণের বাড়িতে উল্টো রথের দিন একখণ্ড বাঁশ পুজো করা হয়।যা ‘কাঠামো পুজো’ হিসাবে পরিচিত।প্রতিমা তৈরির সময় এই বাঁশটিকে দেবীর দক্ষিন পদে স্থাপন করা হয়। পুজর ১৫ দিন আগে থেকে দেবীর বোধন হয় দু’বাড়িতেই অর্থাৎ কৃষ্ণ নবমীতে শুরু হয় পুজো। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্রাক্ষ্মন পণ্ডিতেরা ঠাকুর দালানে চণ্ডীপাঠ ,ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, রামায়ণ,মহাভারত প্রভৃতি নানা গ্রন্থ পাঠ করতেন একসময়। তাঁদের প্রণামী হিসাবে দেওয়া হত জমি,গরু। এখনও কলকাতা শহরের পণ্ডিতেরা আসেন এবং তাঁদের প্রনামী হিসেবে টাকা দেওয়ার রীতি আজও আছে। পুজো হয় বৃহৎ নন্দীকেশরপুরাণ মতে।
দেবী দুর্গা এখানে কন্যারূপে পূজিত হন। প্রতিমার গায়ে খুব অল্পপরিমাণে অলংকার থাকলেও বেশিরভাগই ডাকের সাজ। সন্ধিপুজোর শুরু ও শেষ বোঝাবার জন্য এক সময়ে তোপদাগা হত। বর্তমানে রীতি মেনে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করা হয়। রাজকৃষ্ণের বাড়িতে আজও পাঠাবলির নিয়ম প্রচলিত থাকলেও অন্য বাড়িতে তা আজ বন্ধ। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে, শোনা যায় রাধাকান্ত দেবের আমলে একবার বলির সময় পাঠাটি সম্পূর্ণভাবে বলি হয়নি এই অবস্থাতেই তা বলিকাঠ থেকে বেরিয়ে রাজার পায়ের কাছে এসে ধুঁকতে থাকে। তিনি বলেন,এভাবে যখন একটা প্রাণ তাঁর কাছে আশ্রয় চাইছে তখন তিনি তাঁকে মারতে পারেন না। তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় বলি। তবে নবমীর দিন মাগুর মাছ বলি হয়।
শোভাবাজারের গর্ব সাবেকী এক চালার প্রতিমা। প্রতিমা শিল্পী, মোদক, ঢাকি বংশ পরম্পরায় জড়িয়ে আছেন এই পুজোর সঙ্গে। দশমীর পুজোর অন্যতম নিয়ম ‘কনকাঞ্জলি প্রথা’। বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠা সবৎসা মহিলা বেনারসি শাড়ি পরে আঁচল পেতে দাঁড়ান প্রতিমার পিছনে। পুরোহিত প্রতিমার হয়ে আঁচলে সোনার গিনি,মোহর ছুঁড়ে দেন।
আগে নৈবেদ্যের জন্য এক মণ চাল,২৫ মণ মিঠাই ভোগ হতো। এখন অত না হলেও সে ঐতিহ্য আজও রয়েছে। প্রতিমা বিসর্জনের সময় জোড়া নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানো হত। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন মাটির তৈরি নীলকণ্ঠ পাখি গঙ্গায় ভাসানো হয়। কুলির কাঁধে চেপে দশমীতে গঙ্গায় বিসর্জন হয়। সাত পুরুষ ধরে চলে আসা পুজোর বিসর্জনে বাড়ির সকলে অংশগ্রহন করেন, দশমীর দিন মনকেমন থইথই করে দুর্গাদালানে।