পুজোতেও খালি হাতে ফেরাবে না শান্তিনিকেতন! আপনার অপেক্ষায় সুরুল, হেতমপুর

Durgapuja 2022: সুযোগ পেলে এবারের পুজোতে আপনি ঘুরে দেখে আসতেই পারেন সুরুল, হেতমপুর বা রাজনগরের পুজো।

আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা। তারপরেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। শুধু কলকাতাই নয়, পশ্চিমবঙ্গজুড়েই বিভিন্ন জায়গায় মহাসমারোহে দুর্গাপুজো হয়। বীরভূম জেলার পুজোর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুরুল জমিদারবাড়ি এবং হেতমপুর রাজবাড়ির পুজো।

বাঙালির অতি প্রিয় গন্তব্য বোলপুর বা শান্তিনিকেতন থেকে মাত্র ৬ কিমি দূরেই রয়েছে সুরুল জমিদারবাড়ি। ২৮৮ বছর ধরে এখনও জমকের সঙ্গে এখানে পালিত হয় দুর্গাপুজো। বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত 'সুরুল নথি সংকলন'-এর প্রথম খণ্ড থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বর্ধমানের নীলপুরের ঘোষবাড়ির ছেলে ভরতচন্দ্র সস্ত্রীক চলে আসেন সুরুলে তাঁর গুরু বাসুদেব ভট্টাচার্যর বাড়িতে। সুরুল তখন ছিল এই বৈষ্ণব ধর্মগুরুর শ্রীপাট। ভরতচন্দ্র তারপর আর ফিরে যাননি বর্ধমানে। পরবর্তীকালে তাঁর ছেলে কৃষ্ণহরি ও তাঁর ছেলেরা ফরাসি ও ইংরেজ কুঠিয়ালদের সঙ্গে ব্যবসা করে পারিবারিক ব্যবসা আরও বাড়ান। কৃষ্ণহরি সরকারের নাতি শ্রীনিবাস সরকার সুরুল জমিদারবাড়ির ব্যবসা আরও বাড়িয়ে তোলেন। পাঁচ খিলানের ঠাকুরদালান, যেখানে আজও সুরুলের সরকারবাড়ির পুজো হয়, সেই ঠাকুরদালান সেই সময়ে ১৮ হাজার টাকা খরচ করে তৈরি করেছিলেন শ্রীনিবাস সরকার।

সরকারবাড়িরই ছেলে বিপিনবিহারী সরকার পারিবারিক ইতিহাস লিখতে গিয়ে জানিয়েছেন, এখন যাঁর নামে বল্লভপুরের কাছে চিপকুঠির জঙ্গল, সেই জন চিপ সাহেবের সঙ্গে ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে ওঠে সরকারবাড়ির ধনসম্পদ। জাহাজের পাল তৈরি হতো যে কাপড় দিয়ে, সেই গড়া কাপড়, নীল, চিনি ইত্যাদির ব্যবসা ছিল সরকারদের। সেই সময় সরকারবাড়ির অধীনে কাজ করতেন প্রায় ২২০০ ধোপা।

আরও পড়ুন: সারা কালনা অন্ধকারে ডুবিয়ে নিরঞ্জন হয় প্রতিমার! অবাক করবে মহিষমর্দিনীর ঐতিহ্য

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জমিদারবাড়ির পুজোর জমক কমে এলেও ব্যতিক্রম সুরুল জমিদারবাড়ি। প্রত্যেক বছরই নিয়ম মেনে পুজো হয় সুরুলে। শরিকি সমস্যা যে একেবারে হয়নি, তা নয়। কৃষ্ণহরির মৃত্যুর পরে তাঁর তিন ছেলে যাদবেন্দ্র ও কালিচরণ একসঙ্গে থাকেন আদি বাড়িতে। স্থানীয়দের কাছে তাঁরাই বড় তরফ বলে পরিচিত। পাশেই বাড়ি করে আলাদা হয়ে যান মাধবেন্দ্র। তিনিই হলেন ছোট তরফের প্রতিষ্ঠাতা। বড় বাড়ির মতোই মাধবেন্দ্রও পুজো শুরু করেন। দুই বাড়ির পুজোর নিয়মই এক। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় আর অষ্টমীর দিন হয় ছাগবলি। আগে বলির পরে বন্দুক ছোড়া হতো। সরকারবাড়ির বলি শেষ হলে সুরুলের অন্যান্য বাড়িতে পুজোর বলি হতো। জমিদারির শুরুর দিকে একসময় ষষ্ঠীর দিন বড় বাড়ির কোনও এক বয়স্ক মহিলা গ্রামের অন্য পুজোবাড়ির কর্তাদের ডেকে একটি করে ঘট ও ডাব দিতেন। পুজোয় সেই ঘট তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতেন। বড় বাড়ির থেকে আলাদা হয়ে পুজো শুরু করলেও আদি পুজোর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ জ্ঞাপন করে নিয়ম করেছিলেন, বলি, বিসর্জন, অঞ্জলি- সব ক্ষেত্রেই বড় বাড়ির থেকে পিছিয়ে থাকবে ছোট বাড়ি। তাই এখনও সেই প্রথা মেনেই পুজোর এক মাস আগেই দুই বাড়ির নির্ঘণ্ট তৈরি করে ফেলা হয়।

Surul

সুরুলের সরকারবাড়ির ঠাকুরদালান

পুজোর কাজ থেকে প্রতিমা তৈরি ও বিসর্জন সব কাজই করেন কুলপুরোহিতের পরিবার ও আরও কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার। পুজোর ব্যয় পুরোটাই আসে 'মা দুগ্গা'-র ট্রাস্টি বোর্ড থেকে। দুই বাড়ির ঠাকুরের সাজেও পার্থক্য থাকে। বড় তরফে হয় প্রতিমার সাজ আর ছোট তরফে থাকে বেনারসির সাজ। এক সময় বড়বাড়ির ঠাকুরও বেনারসি পরতেন। সোনা ও রূপোর সুতো দিয়ে শাড়িতে কাজ হতো। একবার শাড়িতে খুঁত থাকায় শাড়ির বদলে মাকে সাজানো হলো ডাকের সাজে। সপ্তমীর সকালে দুই বাড়িতেই সানাই-ঢোল বাজিয়ে , রঙিন ছাতা মাথায় দিয়ে নবপত্রিকাকে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয় শোভাযাত্রা করে।

নারায়ণের জন্য লুচি ভোগ হলেও দুর্গার জন্য অন্ন ভোগ হয় না। পুজোয় সরকারবাড়িতে ঢাকের পরিবর্তে বাজে ঢোল। সঙ্গে বাজে কাঁসর ও সানাই। ঠাকুরদালান সাজানো হয় বনেদি বেলজিয়ান গ্লাসের ফানুস ও ঝাড়বাতি দিয়ে। সপ্তমী থেকে নবমী সন্ধেবেলা বড়বাড়ির দালানে যাত্রা হয়। দশমীতে ছোটবাড়ির ঠাকুর বিসর্জন হয় আগে। বড়বাড়ির ছেলেরা নাটমন্দির থেকে মাকে কাঁধে করে নামানোর পরে চতুর্দোলা করে নিয়ে যাওয়ার রীতি ছিল। এখন রথে করে বিসর্জন দেওয়া হয়। সরকারবাড়িতে পুজোয় হয় না ধুনুচি নাচ বা বিজয়ার সিঁদুর খেলা। বিসর্জনের পরে বাড়ির বড় মেয়ে ছেলেদের চোখে কাজল পরিয়ে দেন, হাতে বেঁধে দেন অপরাজিতা ফুলের বলয়।

সুরুল ছাড়াও বীরভূমের আরেক বিখ্যাত রাজবাড়ির পুজো হলো হেতমপুর রাজবাড়ির পুজো। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, লোকলশকর। ছয়ের দশকের আগে পর্যন্ত বীরভূমের হেতমপুরের রাজবাড়ি ছিল বিলাস-বৈভবে ভরা। হেতমপুরের রাজা তখন গঙ্গানারায়ণ চক্রবর্তী। তিনি ঠিক করেন দুর্গাপুজো করবেন। সেই বছরই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি মারা গেলে বাবার ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে ১২৪০ বঙ্গাব্দে মেয়ে রুক্মিনী দেবী হেতমপুরে পুজো শুরু করেন। রুক্মিনীর দেবী স্বামী ছিলেন তৎকালীন মুনসেফ। তাই এই পুজো লোকমুখে মুনসেফ ঠাকুরানীর পুজো বলেও পরিচিত। বংশের তৃতীয় পুরুষ রাধানাথ চক্রবর্তী রাজপ্রাসাদের কাছেই দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আগে রাজবাড়ির পুজো মানেই ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হেতমপুরের রাজবাড়িতে আরাধনা হয় বৈষ্ণব মতে। মা দুর্গা এখানে পূজিত হন সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর দিন। পুজোর তিন দিন এক কেজি করে মণ্ডা বলি দেওয়া হয়। পুজোর তিনদিন আলাদা রকমের অন্নভোগের আয়োজন করা হয়। তিনরকম অন্নের চল রয়েছে এখানে। ঘি অন্ন, বাসন্তী পোলাও, যুগল অন্ন, পাঁচ ভাজা, তরকারি, পায়েস দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। এই বছর ১৮৮ বছরে পা দেবে এই পুজো। ২০১৫ সাল থেকে কিছু বছর অর্থের অভাবে দুর্গাপুজো বন্ধ থাকলেও বর্তমান প্রজন্মের বংশধর বৈশাখী চক্রবর্তীর হাত দিয়ে আবার শুরু হয়েছে এই শতাব্দীপ্রাচীন পুজো।

Hetampur Rajbari

হেতমপুর রাজবাড়ির প্রতিমা

বীরভূমের আরেক ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজোগুলির মধ্যে অন্যতম বীরভূমের রাজনগর ব্লকের অন্তর্গত বেলেড়া গ্রামের দুর্গাপুজো। এই দুর্গাপুজোর উৎপত্তি রাজনগরের বীর রাজার আমলে ১০০১ বঙ্গাব্দ। এই পুজোর উৎপত্তির পিছনে রয়েছে ঐতিহ্যমণ্ডিত কাহিনি। বছরের পর বছর ধরে সেই ঐতিহ্য বহন করে এই দুর্গামন্দিরে দেবী দুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে। এই পুজোর শুভারম্ভ করেছিলেন শ্রীধর বক্সি। তারা ছিলেন তিন ভাই। তিন ভাইয়ের মধ্যে শ্রীধর বক্সি ছিলেন বড় ভাই। তিনি একটি রঘুনাথ ঠাকুরের সালেগ্রাম পেয়েছিলেন। তারপর স্বপ্নাদেশে এই দুর্গাপুজোর দায়িত্ব সঁপে দেন মেজ ভাই কীর্তি শিকদারের হাতে। এই শ্রীধর বক্সি অথবা কীর্তি শিকদারদের আসল পদবি হলো মুখার্জি। কিন্তু তারা বীর রাজার প্রদত্ত পদবি পেয়েছিলেন। বড় ভাই শ্রীধর বীর রাজার খাজনা আদায় করতেন, যে কারণে তিনি পদবি পেয়েছিলেন বক্সি। মেজ ভাই কীর্তি রাজবাড়ির সমস্ত কিছু দেখাশোনা করতেন। যে কারণে তিনি পদবি পেয়েছিলেন শিকদার। ছোট ভাই চণ্ডীপাঠ করতেন বলে তিনি পদবি পেয়েছিলেন পাঠক। তাঁর পুরো নাম বদনচন্দ্র পাঠক।

এই দুর্গাপুজোর স্থায়ী মন্দির রয়েছে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর আগে মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরি করা হয়। মহাসপ্তমীতে দুর্গাপুজোর ঘট আনা হয় স্থানীয় বেলেড়া নদী থেকে। প্রতি বছর মহাসপ্তমীর দিন এই ঘট আনার সময় বহু মানুষকে এই দীর্ঘ রাস্তা দন্ডি কেটে আসতে দেখা যায়। পুজোর চারদিন ছাড়াও সারা বছর ধরেই মন্দিরে নিত্যপুজো হয়ে থাকে। পুজোর পর মৃন্ময়ী প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।

তবে আবার পুজোকে কেন্দ্র করেও রয়েছে ঐতিহ্য। এখানকার দেবীর আরাধনা করা হয়ে থাকে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ অনুযায়ী। সাধক বলরাম বাচস্পতি রচিত পুজোর এই পুঁথি এখনও রয়েছে তালপাতায়। সেই পুঁথির মন্ত্র অনুসারেই এখানে দেবীর আরাধনা করা হয়ে থাকে। মহাসপ্তমীতে এখানে চালকুমড়ো বলিদানের নিয়ম রয়েছে। মহাষ্টমীতে সাতটি ছাগবলির প্রথা রয়েছে।

জেলার পুজোর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমনই সব মজার গল্প। সুযোগ পেলে এবারের পুজোতে আপনি ঘুরে দেখে আসতেই পারেন সুরুল, হেতমপুর বা রাজনগরের পুজো।

More Articles