কোথাও বরাভয়দাত্রী কোথাও উগ্রচণ্ডা! অবাক করবে দশভুজার দশটি অজানা কাহিনি
Durgapuja 2022: দেবী চামুণ্ডা সপ্ত মাতৃকার অন্যতম। এরা হলেন: ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী, কৌমারী, বারাহী এবং চামুণ্ডা। চামুণ্ডাকে কালীর অপর রূপ মনে করা হয়।
ভাগবত পুরাণ অনুসারে, দেবী দুর্গা দেবী ভুবনেশ্বরীর পাঁচটি রূপের একজন। বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম দুর্গাপুজো। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিন এই দুর্গোৎসব হয়। নানা সময় দুর্গাপুজো প্রচলনের নানা কাহিনি শোনা যায়। কালিকা পুরাণ অনুযায়ী, মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে স্বর্গরাজ্য দখল করে। ব্রহ্মার বরে সে তখন অবধ্য। বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাদের সমবেত তেজ থেকে যে ‘দুর্গা’ নামক নারীমূর্তি আবির্ভূত হয় সেই শক্তিই বিনাশ করেন অসুরকে। বাঙালিরা নিজেদের কল্পনা ও সৃজনশীলতা দিয়ে দুর্গাকে নতুন করে গড়ে নিয়েছে। দুর্গার সঙ্গে ‘আত্মীয়ের’ মতো আরও যেসব দেবদেবী দেখা যায় তারা হলেন- লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। উপরের দিকে কখনও কখনও ছোট্ট করে শিবের মূর্তিও থাকে।
দুর্গা ও তার সহযোগী দেব-দেবীদের নিয়ে গল্প-কাহিনির শেষ নেই। এর উৎপত্তি-বিকাশ নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। গবেষক-পণ্ডিতগণ প্রত্যেকেই নিজের মতো করে বয়ান দিয়েছেন, নিজেদের মতের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন।
দুর্গার জন্ম কাহিনি
দুর্গা আদিশক্তি, পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, অসুরদের বিনাশ করার জন্যই দেবীর জন্ম হয়েছিল। কিন্তু জন্ম কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। শোনা যায়, একসময় সমস্ত দেবতারা অসুরদের অত্যাচারে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। ব্রহ্মা মহিষাসুরকে বর দেন যে, তাকে কোনও পুরুষ হত্যা করতে পারবে না। অর্থাৎ এক নারীর হাতেই লিখিত রয়েছে মহিষাসুরের মৃত্যু। তাই দেবতারা একসঙ্গে নিজ নিজ শক্তিকে সম্মিলিত করে দেবী মহামায়ার সৃষ্টি করেন।
দেবীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিভিন্ন দেবতার দেহ থেকে নির্গত দীপ্তি দ্বারা গঠিত হয়েছিল। দুর্গার মুখমণ্ডল শঙ্করের মহিমা দ্বারা, যমরাজের দীপ্তি থেকে মস্তক ও চুল, বিষ্ণুর মহিমা সহ বাহু, চন্দ্রের মহিমা সহ স্তন, ইন্দ্রের মহিমা সহ কোমর, উরু সৃষ্টি হয়েছিল। বরুণের মহিমা থেকে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে চরণ, উভয় পায়ের আঙুল সূর্যের তেজে, প্রজাপতির তেজে সমস্ত দাঁত, পৃথিবীর তেজে উভয় চক্ষু আগুনের, সন্ধ্যার দীপ্তি সহ ভ্রু, বাতাসের তেজ সহ কান সৃষ্টি হয়েছিল। দেবতারাই দিয়েছিলেন অস্ত্র। সেই অস্ত্র দিয়েই দুর্গা বধ করেন মহিষাসুরকে।
দেবী অম্বিকার সঙ্গে শুম্ভের যুদ্ধ
শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুরভ্রাতা স্বর্গরাজ্য অধিকার করে নিল। তখন দেবতাগণ হিমালয়ে গমন করে বিষ্ণুশক্তি দুর্গার স্তব করতে লাগলেন। এসময় সেখানে দেবী পার্বতী গঙ্গাস্নানের জন্য উপনীত হলেন। তখন অপর এক দেবী ইন্দ্রাদি দেবতাগণের স্তবে প্রসন্ন হয়ে তার দেহকোষ থেকে উৎপন্ন হলেন। অম্বিকা নামে আখ্যাত সেই দেবীই শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেছিলেন।
শুম্ভ-নিশুম্ভের চর চণ্ড ও মুণ্ড দেবীর মনোহর রূপ দেখে শুম্ভের নিকট গিয়ে বললেন, মহারাজ, পরমা সুন্দরী এক রমণী হিমালয় আলোকিত করে আছেন। এমন স্ত্রীরত্ন আপনারা কেন গ্রহণ করছেন না। চণ্ড-মুণ্ডের বাক্য শ্রবণ করে শুম্ভ-নিশুম্ভ মহাসুর সুগ্রীবকে দূত হিসেবে নিযুক্ত করে দেবীর নিকট প্রেরণ করল। সুগ্রীব দেবীর নিকট শুম্ভ-নিশুম্ভের নির্দেশিত অসৎ প্রস্তাব সুন্দরভাবে ব্যক্ত করল। দেবী মনে মনে হাসতে লাগলেন, তথাপি গম্ভীরস্বরে বললেন, “তুমি যথার্থই বলেছ। শুম্ভ-নিশুম্ভ ত্রিভুবনের অধিপতি ও মহাবীর। তবে, আমি পূর্বে অল্পবুদ্ধিবশত প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে আমাকে যুদ্ধে পরাভূত করতে পারবে, কেবল তিনিই আমার পতি হবেন। এখন আমি সে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি কীভাবে! তাই তুমি মহাসুর শুম্ভ বা নিশুম্ভকে বলো, তারা যেন এখানে এসে আমাকে যুদ্ধে পরাজিত করে শীঘ্র আমার পাণিগ্রহণ করেন”। দেবীর বাক্য শুনে সুগ্রীব ক্রুদ্ধ হয়ে দেবীকে নিরস্ত হতে পরামর্শ দেয়। কিন্তু দেবী নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে তাকে শুভ-নিশুম্ভের কাছে প্রেরণ করলেন।
আরও পড়ুন- প্রণবহীন পুজোয় কেমন আছে মিরাটির ‘মুখার্জি ভবন’, স্মৃতিচারণে পুত্র অভিজিৎ
সুগ্রীবের মুখে দেবীর কথা শুনে অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে অসুররাজ শুম্ভ দৈত্যসেনাপতি ধূম্রলোচনকে প্রেরণ করলেন। ধূম্রলোচনের সঙ্গে দেবীর তুমুল যুদ্ধ হল এবং সেই যুদ্ধে ধূম্রলোচন পরাজিত ও নিহত হল। এমন দুঃসংবাদ পেয়ে শুম্ভ চণ্ড-মুণ্ড ও অন্যান্য অসুরসেনাদের যুদ্ধে প্রেরণ করল। দেবী অম্বিকা তাদের প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তখন তার ললাটদেশ থেকে ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা দেবী কালী প্রকটিত হয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন।
শুম্ভের সৈন্যদের সঙ্গে দেবী চণ্ডিকার যুদ্ধ
মার্কণ্ডেয় পুরাণ মতে, শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে এসে দুর্গার আরাধনা করেন। অন্যদিকে, শুম্ভ-নিশুম্ভ দেবীকে ধরে আনার জন্য চণ্ড-মুণ্ডকে পাঠান। দেবী চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলে, তার শরীর থেকে চণ্ডিকা শক্তি বের হতে থাকে। হিমালয়ের শিখরে তারা দেবীকে আক্রমণ করলে দেবীর কপাল থেকে অপর একটি ভয়ঙ্কর দেবীর সৃষ্টি হয়। এই দেবী কালী নামে পরিচিত। এই সময় তিনিই কালীরূপসহ দশটি রূপ ধরে যুদ্ধ করেছিলেন। এই নামগুলি হলো- দিগম্বরী, আকর্ণনয়না, পূর্ণযৌবনা, মুক্তকেশী, লোলজিহ্বা, মুণ্ডমালাবিভূষিতা, চতুর্ভুজা, শ্যামবর্ণ এবং কালী।
দেবী কালীর ছিল চারটি হাত। এর মধ্যে দুই ডান হাতে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস, বাম দুই হাতে চর্ম ও পাশ, গলায় ছিলে নরমুণ্ডু এবং বসন হিসাবে ছিল বাঘের ছাল, রক্তচক্ষু, বীভৎস মুখ। যুদ্ধক্ষেত্রে আবির্ভুতা হয়েই চণ্ড ও মুণ্ডকে হত্যা করলেন। কালী চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করে দুর্গার কাছে গেলে, দুর্গা তাঁকে চামুণ্ডা নামে অভিহিত করেন।
দেবী চামুণ্ডির কাহিনি
দেবী চামুণ্ডা সপ্ত মাতৃকার অন্যতম। এরা হলেন: ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী, কৌমারী, বারাহী এবং চামুণ্ডা। চামুণ্ডাকে কালীর অপর রূপ মনে করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে পশুবলি দিয়ে ও মদ নিবেদন করে এই দেবীর পূজা করা হয়। প্রাচীনকালে চামুণ্ডার পুজোয় নরবলিও দেওয়া হত। জৈনধর্মেও চামুণ্ডার পুজো প্রচলিত আছে। কয়েকটি জৈন গ্রন্থে সন্ন্যাসী জিনদত্ত এবং জিনপ্রভসুরির হাতে চামুণ্ডার পরাজয়ের কাহিনি রয়েছে। তবে জৈনরা মদ ও মাংসের পরিবর্তে নিরামিষ নৈবেদ্য নিবেদন করে তার পুজো করেন। জৈনরা তার সম্মানে ওসিয়ানে সচিয়া মাতা মন্দির নির্মাণ করেন।
ভারতীয় গবেষক, প্রাচ্যবিদ ও সমাজ সংস্কারক রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের মতে, চামুণ্ডা প্রকৃতপক্ষে মধ্যভারতের বিন্ধ্য অঞ্চলের উপজাতি সমাজের পূজিত দেবী। চামুণ্ডাকালী সাধকদের কাছে কালীর একটি রূপ। বহু শ্মশানে চামুণ্ডাকে পুজো করা হয়। তার গায়ের রং নীল, পরিধানে বাঘছাল। দুর্গাপুজোয় মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে আয়োজিত সন্ধিপূজার সময় দেবী চামুণ্ডার পুজো হয়। অগ্নিপুরাণে আট প্রকার চামুণ্ডার কথা বলা হয়েছে। দেবী চামুণ্ডার বর্ণ হয় গাঢ় লাল অথবা কৃষ্ণকায়। গলায় মুণ্ডমালা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে চার, আট, দশ বা বারোটি হাতের অধিকারিণী। ডমরু, ত্রিশূল, খড়্গ, সর্প, খট্বাঙ্গ, বজ্র, ছিন্নমুণ্ড ও রক্তপূর্ণ পাত্র, শব অথবা প্রেতাসনে স্থিতা; ত্রিনয়না, ভয়াল মুখমণ্ডল। ভূত তাঁর সঙ্গী। বিভিন্ন বর্ণনায় নরকঙ্কাল ও শৃগালাদি পশুও তাকে বেষ্টন করে থাকে।
দুর্গা এবং মহিষাসুর বধ
দুর্গাপুজো নিয়ে পৌরাণিক গল্পও রয়েছে অসংখ্য। লোকমুখেও ঘোরে বহু গল্প। মহিষাসুর বধ হওয়ার আগে দুর্গাকে কী কী ভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল সেই গল্পও রয়েছে পুরাণে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী, ১০০ বছর ধরে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ চলার পরে দেবতারা এক দেবীমূর্তি তৈরি করেন, যিনি হলেন মহামায়া মহিষাসুরমর্দিনী।
মহিষাসুরের সঙ্গে লড়াইয়ের সময়ে দেবতারাই তাকে রণসাজে ভূষিত করেছিলেন। মহিষাসুরের সঙ্গে লড়ার আগে বহু অসুরকে পরাস্ত করেন দেবী। তখন রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন স্বয়ং মহিষাসুর। অন্যদিকে দেবীর বাহন সিংহও তখন সমান তালে লড়াই করছে। সেই দেখে মহিষাসুর সিংহকে মারতে উদ্যত হয়। তাই দেখে দেবী রেগে গিয়ে মহাপাশ ছুড়ে মারেন মহিষাসুরকে। তখন দেবীকে বিভ্রান্ত করার জন্য মহিষাসুর সিংহের রূপ নেন। তবে দেবী তাকে খড়্গ দিয়ে কেটে ফেলেন। এর পরে আবার এক হাতির রূপ নেন মহিষাসুর। সঙ্গে সঙ্গে সেই হাতির শুঁড়কে কেটে ফেলেন দেবী। তারপরে ফের মহিষাসুর মহিষ রূপে ফিরে গিয়ে দেবীর সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবী মহিষাসুরকে পরাস্ত করতে উদ্যত হলে প্রথমে মহিষের মুখ কেটে ফেলেন। কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি অসুরের বুকে বিঁধিয়ে দেন ত্রিশূল।
মা শৈলপুত্রীর কাহিনি
বাংলার দুর্গাপুজোর পাশাপাশি একই সময়ে সারা দেশ জুড়ে পালিত হয় নবরাত্রি উৎসব। মূলত দেবী দুর্গার নয়টি ভিন্ন রূপের পুজো হয় নয় দিন ধরে। বাংলার অনেক দুর্গাপুজোতেও নবদুর্গার আরাধনা হয়। এই রূপগুলির নিজস্ব শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্য রয়েছে। দুর্গার প্রথম রূপ শৈলপুত্রী। একবার প্রজাপতি দক্ষ বিরাট যজ্ঞ করেন। এই যজ্ঞে সতীকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। সতী পিতৃগৃহে যাবার জন্য অস্থির, কিন্তু শঙ্কর সাবধান করলেন যে, কোনও কারণে হয়তো প্রজাপতি দক্ষ উমার উপর রেগে আছেন। কিন্তু সতীর মন মানল না। তখন মহাদেব অনুমতি দিলেন যাওয়ার। কিন্তু পিতৃগৃহে গিয়ে পৌঁছে দেখলেন কেউ তাকে সেরকম স্নেহ ভরে কাছে ডাকছে না। একমাত্র মা জড়িয়ে ধরলেন। স্বয়ং দক্ষ তাকে নানা খারাপ কথা বললেন এবং তার স্বামীকে অপমান করলেন। তখন রাগে দুঃখে যজ্ঞাগ্নির আগুনে নিজেকে ভস্মীভূত করলেন সতী। এই সংবাদ শুনে শিব ও তার অনুগামীরা দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস করলেন। পরজন্মে দেবী সতীই শৈলরাজ হিমালয়ের কন্যা রূপে জন্ম নিলেন। এই জন্মে তিনি শিবের অর্ধাঙ্গিনী রূপে ছিলেন।
নবদুর্গার প্রথম রূপটি হল শৈলপুত্রী। নবরাত্রি উত্সবের প্রথমদিনে পুজো হয় দেবী শৈলপুত্রীর। শৈলপুত্রী আসলে প্রকৃতির দেবী। শৈলপুত্রীর বাহন বৃষ। তার দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল আর বাম হস্তে কমল আছে তাই দেবীর অপর নাম শুলধারিনী। দেবী পার্বতী রূপে জন্ম নেন ও শিবকে বিবাহ করেন। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী ব্রহ্মার শক্তির প্রতীক হলেন দেবী শৈলপুত্রী। শৈলরাজ হিমালয়ের কন্যা হওয়ার জন্য দেবীর এক নাম হয় শৈলপুত্রী। শাস্ত্রমতে, এই রূপের আরাধনায় বৃদ্ধি পায় মনোবল। মানসিক অস্থিরতা ও অবসাদ মুক্তি পাওয়া যায় দেবী শৈলপুত্রীর আরাধনায়।
দেবী ব্রহ্মচারিণী
নবদুর্গার দ্বিতীয় রূপ ব্রহ্মচারিণী। নবরাত্রি উৎসবের দ্বিতীয় দিনে তার পুজো করা হয়। ‘ব্রহ্মচারিণী’ নামের অর্থ ‘ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বনকারিণী’। তিনিই উমা। দেবী ব্রহ্মচারিণী দ্বিভুজা; একহাতে তার জপমালা, অপর হাতে কমণ্ডলু। দেবী জ্যোতির্ময়ী মূর্তিতে আবির্ভূতা; তার ভৈরব চন্দ্রমৌলীশ্বর।
দেবী ব্রহ্মচারিণীর সম্পর্কে যে পৌরাণিক উপাখ্যানটি প্রচলিত, সেটি গিরিরাজ হিমালয়ের গৃহে জাত দেবী পার্বতীর শিবকে পতিরূপে লাভ করার নেপথ্য-কাহিনি। সতীর দেহত্যাগের পর শিব ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন। তাই সতী যে পুনরায় পার্বতীরূপে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেদিকে খেয়াল ছিল না তার। এদিকে তারকাসুরের অত্যাচারে দেবতারা জর্জরিত। তারকাসুর বর পেয়েছিলেন, শিবের পুত্র ভিন্ন অপর কেউই তাকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারবে না। কিন্তু শিব বিবাহের নামটিও করছিলেন না। তখন উপায়? অগত্যা নারদ পার্বতীকে তপস্যা করার পরামর্শ দিলেন। নারদের উপদেশ মতো প্রথমে এক হাজার বছর শুধুমাত্র ফলমূল খেয়ে, তারপর একশো বছর শুধু শাক খেয়ে, তারপর কিছুকাল উপবাস করে, তারপর তিন হাজার বছর শুধুমাত্র একটি করে বেলপাতা খেয়ে এবং শেষে কয়েক হাজার বছর নির্জলা উপবাস করে পার্বতী করলেন কঠোর তপস্যা। মা মেনকা দুর্গার তপস্যাক্লিষ্ট শরীর দেখে দুঃখিত হয়ে কন্যাকে নিরস্ত করার জন্য বললেন, “উ মা” (আর না!) সেই থেকে দেবী ব্রহ্মচারিণীর অপর নাম হল ‘উমা’। তার কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা এসে বর দিলেন, “যাকে তুমি কামনা করো, সেই শিবকেই পতিরূপে পাবে”। মহামায়া দুর্গার সেই তপস্বিনী রূপই দেবী ব্রহ্মচারিণী। দেবীপুরাণ মতে, সর্ববেদে বিচরণ করেন বলে দেবী পার্বতীর অপর নাম ‘ব্রহ্মচারিণী’।
দেবী ব্রহ্মচারিণী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন। তার পুজো করলে শুধু সংযম ও মানসিক শক্তিই বৃদ্ধি পায় না, সাধক অনন্ত পুণ্যফলও লাভ করেন এবং তিনি সর্বদা সিদ্ধি ও বিজয়ও লাভ করেন। নবরাত্রির দ্বিতীয় দিনে সাধক নিজের মনকে স্বাধিষ্ঠান চক্রে স্থিত করে ব্রহ্মচারিণীর পুজো করেন।
আরও পড়ুন- কায়েত কণ্ঠে চণ্ডীপাঠে গোঁড়া হিন্দুদের আপত্তি, তবু অমর হয়ে রইলেন বীরেন ভদ্র
দেবী স্কন্দমাতা
নবদুর্গার পঞ্চম রূপ স্কন্দমাতা। নবরাত্রি উৎসবের পঞ্চম দিনে তার পুজো হয়। দেবসেনাপতি কার্তিকের অপর নাম স্কন্দ। দুর্গা কার্তিকের মা। তাই তিনি পরিচিতা ‘স্কন্দমাতা’ নামে। কার্তিক-জননী বেশে দুর্গার রূপটি একটু আলাদা। এই রূপে তিনি চতুর্ভুজা; উপরের দুই হাতে দু’টি পদ্মফুল; নিচের এক হাতে ধরে থাকেন স্কন্দ অর্থাৎ কার্তিককে, অপর হাতে দেখান বরমুদ্রা। দেবী পদ্মাসনা, তবে দেবীর বাহন সিংহ। দেবীর কোলে স্কন্দের যে মূর্তিটি দেখা যায়, সেটি আমাদের বাংলায় সচরাচর দেখা কার্তিক মূর্তির চেয়ে একটু আলাদা। এই কার্তিকের হাতে তীর-ধনুক থাকে বটে, কিন্তু এর ছয়টি মস্তক। ষড়ানন কার্তিকের এই শিশুমূর্তিটিই শোভা পায় দেবী স্কন্দমাতার কোলে।
দেবী স্কন্দমাতার কথা জানা যায় স্কন্দপুরাণ থেকে। অসুররাজ তারক বরলাভ করেছিলেন, কেবল শিব ও দুর্গার পুত্রই তার প্রাণ বধে সক্ষম হবে। তাই দেবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তিনি সহজেই দেবতাদের কাছ থেকে স্বর্গরাজ্য কেড়ে নিতে পেরেছিলেন। এই ঘটনার ঠিক আগেই সতী দেহত্যাগ করেছিলেন, শিবও হয়েছিলেন ধ্যানমগ্ন। তাই দেবতারা দুর্গাকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করার অনুরোধ করলেন। দুর্গা শৈলপুত্রী রূপে গিরিরাজ হিমালয়ের গৃহে জন্ম নিলেন। তার ব্রহ্মচারিণী রূপের পুত্র কার্তিক। কার্তিকের ছিল ছয়টি মাথা। তাই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন ষড়ানন নামে। এই ষড়ানন স্কন্দই তারককে যুদ্ধে পরাজিত করে দেবতাদের স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। স্কন্দ ও স্কন্দমাতা উভয়েই তারকাসুর বধে দেবতাদের সাহায্য করেছিলেন বলে, মাতা-পুত্রের পুজো একসঙ্গে করাই নিয়ম।
স্কন্দমাতার পুজো করলে ভক্তের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়; জীবন সুখ ও শান্তিময় হয়ে ওঠে এবং মোক্ষের পথ সহজতর হয়।
দেবী কালরাত্রি
নবরাত্রির অর্থ নয় দিন দেবী দুর্গার নয়টি রূপের আরাধনা করা। নবরাত্রির সপ্তম দিন পুজো করা হয় দুর্গার ভীষণ রূপ দেবী কালরাত্রির। প্রচণ্ড ভীতিপ্রদ রূপের জন্য দেবীর এই নামকরণ। কাজলের মতো ঘোর কালো এই দেবীর গাত্রবর্ণ। পুরাণ অনুসারে, দুই রাক্ষস শুম্ভ ও নিশুম্ভ এবং তাদের দৈত্যসেনাকে দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন দুর্গা। তখন এই ভয়ানক রূপ ধারণ করেন তিনি।
দেবী কালরাত্রির চারটি হাত। ওপরের ডান হাতে আশীর্বাদ, নীচের ডান হাতে অভয় মুদ্রা। বাঁ দিকে ওপরের হাতে খড়্গ এবং নীচের বাম হাতে রয়েছে লোহার কাঁটা। দেবী ত্রিনয়নী এবং তার চোখগুলি ব্রহ্মাণ্ডের মতো গোলাকার। দেবী কালরাত্রির চুল খোলা এবং গলায় বজ্রের মালা। এই দেবী গাধার ওপর আসীন এবং তার নিশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে ভয়ংকর অগ্নিশিখা নির্গত হয়। কালরাত্রির রূপ ভয়ংকর হলেও তিনি শুভফলের দেবী। তাই তার অপর নাম শুভঙ্করী।
হিন্দু ধর্ম অনুসারে কালরাত্রি দুষ্টের দমন করেন, গ্রহের বাধা দূর করেন এবং ভক্তদের আগুন, জল, জন্তু জানোয়ার, শত্রু ও রাত্রির ভয় থেকে মুক্ত করেন। ভক্তেরা বিশ্বাস করেন যে, যিনি কালরাত্রির উপাসক তাকে স্মরণ করলেই দৈত্য, দানব, রাক্ষস, ভূত ও প্রেত পালিয়ে যায়।
মা মহাগৌরী
দুর্গাপুজোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হল অষ্টমী। দেবীর আরাধনায় এই দিনটিকে সবচেয়ে পবিত্র বলে ধরা হয়। শোনা যায়, এই দিনেই নাকি অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির আবির্ভাব হয়।
এছাড়াও অষ্টমী তিথির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও কাহিনি। নবরাত্রির অষ্টম দিনে পূজিতা হন দেবী মহাগৌরী। পুরাণ মতে, পার্বতী ছিলেন গৌরবর্ণ। কিন্তু দেবাদিদেব মহাদেবকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য প্রখর রোদে তপস্যা করেন পার্বতী, আর তাতেই কৃষ্ণবর্ণা হয়ে যান তিনি। এরপর সব স্বয়ং শিব গঙ্গাজলে স্নান করিয়েদেন পার্বতীকে আর তাতেই নিজের পুরনো বর্ণ ফিরে পান দেবী। দেবীর এই রূপই হল মহাগৌরী। এই রূপে দেবীর বাহন সাদা ষাঁড়।
দেবী চতুর্ভুজা, এক হাতে ত্রিশূল, এক হাতে ডমরু, এক হাতে বরাভয় মুদ্রা ও আরেক হাতে অভয় মুদ্রা। দেবীর এই রূপকে শিবানীও বলা হয়। কারণ এই রূপে তিনি সাক্ষাৎ পরম শিব। দেবীর এই স্বরূপ শান্তি, পবিত্রতা, আনন্দ করুণার প্রতীক। দেহচক্রের মধ্যে তিনি গুরুচক্র।