অর্থনীতির মরা গাঙে বান আনছে দুর্গাপুজো, ছোট ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফুটবে?
Durgapuja 2022: দুর্গাপুজো, ধর্মীয় আচার, উৎসবে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কীভাবে অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ক্রমশ সেরা?
আশ্বিনের শারদপ্রাতে...। বঙ্গ তথা সমগ্র বিশ্বের বাঙালির কাছে এই শব্দবন্ধর মর্মার্থ বলে দিতে হয় না আর। দুর্গা আবাহনের শব্দেই আন্দোলিত হয় আকাশ-বাতাস, মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের অনুভূতি। প্রতিবারই নতুন করে এগিয়ে যায় সবটা। যদিও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে দুর্গাপুজো আজও উৎসব। প্রত্যেক ধর্মের-জাতির-বর্ণের ভালো থাকার রসদ। প্রত্যেক দিন নতুন করে ভাবতে থাকার উপমা। উৎসবের আঁচলে বছরভরের লক্ষ্মী ঘরে তোলার সূত্র। অর্থাৎ, এক পুজোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় একাধিকের ভবিষ্যৎ। সুরক্ষিত থাকে পেট। ক্ষুধা নিবারণের মন্ত্রলাভ হয় দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে। শুধুই ধর্মীয় আচার পালন নয়, এই পুজো হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার, আগলে রাখার এক দৈনন্দিন চাবিকাঠি। যা ভালো রাখে ওঁদের। ভালো থাকেন ওঁরা।
যে লোকটি রোজ দুপুরে লোকাল ট্রেনে ফেরি করেন, যে মেয়েটি খেলনা নিয়ে মেলায় বসেন, যে বৃদ্ধটি বেলুন বেচেন রোজ, এই উৎসব হাসি ফোটায় ওঁদের মুখে। প্রত্যেক মুহূর্তে এক উৎসব চালিত করে সারাবছরব্যাপী আনন্দে থাকার উপাদান। সরবরাহ করে মৃৎশিল্পী থেকে বাঁশ বাঁধার শ্রমিক, আলোকশিল্পী থেকে সাউন্ড অপারেটর, খ্যাতনামা অঙ্কনশিল্পী থেকে অখ্যাত ভাস্কর অথবা গ্রামে গ্রামে মাচায় ছড়িয়ে থাকা প্রতিভাদের। বিকশিত হন সকলে। দুর্গাপুজোর আবহে লক্ষ্মীলাভ হয় অর্থনীতির।
কেন? এই বিষয়ে কী বলছেন অর্থনীতিবিদেরা? উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান (ইউজিসি) এবং অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অঞ্জন চক্রবর্তী বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি এই প্রসঙ্গে আমাদের জানান, মূলত এই সংক্রান্ত আলোচনায়, তিনটি দিকে নজর দিতে হবে। প্রথমত, কৃষি। কৃষিনির্ভর প্রাচীন সমাজব্যবস্থায়, কৃষিজ আয়, নতুন ফসল। এবং দুর্গাপুজোয় উৎসবের অংশীদার হওয়া। অর্থাৎ, উৎসব পালন। পুজোর সঙ্গে এই উৎসব পালনের বা উৎসবের বিষয়টি কিন্তু আজ আসেনি। বহুকাল থেকেই রয়েছে। যদিও সময়ের সঙ্গে নতুন ধরনের জীবিকা, পেশার পরিবর্তন, উৎসবের আবহে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তাই, প্রায় সব পুজো, আচার এবং একাধিক পুজো-উৎসবে আমাদের জীবিকার প্রাধান্য থাকে আজও।
আরও পড়ুন: দশভূজা কুমোরটুলির মেয়েরাও! থিম থেকে সাবেকি, কলকাতা থেকে বিদেশ কাঁপাচ্ছেন মহিলা শিল্পীরাই
দ্বিতীয়ত, দুর্গাপুজোর সঙ্গে বরাবর সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর সম্পর্ক ছিল। আভিজাত্য এবং জমিদারি প্রথা। অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছলের বাড়িতে পুজো। অর্থাৎ উৎসবে আনন্দ থাকলেও সেটি সর্বজনীন পুজো হবে, এমন তখন ছিল না। ক্রমান্বয়ে সেই কাঠামোয় ফাটল দেখা দিল। পুজো সর্বজনীন হল। অর্থাৎ সবার হল পুজো। সমাজের প্রায় সকলের সাহায্যে জমিদারি কাঠামো ছাড়ল পুজো। যেখানে যদি এই প্রসঙ্গে দেখা যায়, বর্তমানের পুজো আবহ, উৎসব এবং রাজ্য সরকারের সাহায্য আসলে,পুজোর সর্বজনীনতাকে প্রত্যক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য করা।
তৃতীয়ত, আর এই সর্বজনীন পুজোর সঙ্গেই জড়িত রয়েছে সমসাময়িক অর্থনীতি। যেখানে জড়িয়ে আছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা। যে লোকটি প্রতিমা গড়েন, যিনি মাটির প্রদীপ বানান, যিনি পদ্মফুল বিক্রি করেন, মণ্ডপ তৈরি করেন, আলোকসজ্জার কাজ করেন; এই সমস্ত নানাবিধ অসংগঠিত ক্ষেত্রের পেশার মানুষের সারা বছরের আয়ে পুজো এবং তার সর্বজনীন উৎসবের বহর গুরুত্ব আরোপ করল ক্রমশ। অর্থাৎ যে লোকটি ঢাক বাজান, তার আর্থিক সচ্ছলতা পুজোর জন্য খানিকটা বাড়ল। এর সঙ্গেই সংগঠিত ক্ষেত্রের যাঁরা। ধরা যাক, একজন দর্জি, রেডিমেড সেন্টারের কাছে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে হেরে গেলেন, এইরকম ক্ষেত্রে আবার অসুবিধা বাড়ল। আর এখানেই মানুষের সামগ্রিক অভ্যাস। খাদ্য, পোশাকের অভ্যাসের সুযোগে সংগঠিত ক্ষেত্রের আর একটি অংশের উন্নতি ঘটল। যা বহুজাতিক। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে কারা এর ফলে বেশি লাভবান হলেন, বহুজাতিক সংস্থা না বাকিরা! কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতি মূলত আবর্তিত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য। সেখানে দাঁড়িয়ে পুজোয় সেই অংশের উন্নতি হলে, অর্থনীতির যে সার্বিক উন্নতি হবে একথা বলাই যায়।''
সম্প্রতি ইউনেসকো-র তরফে কলকাতার দুর্গাপুজো বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বের দরবারে বিরাট আতিশয্যে সেরা হয়েছে এই উৎসব। যার উদযাপন হয়েছে বিশাল আড়ম্বরে। অধ্যাপক তপতী গুহঠাকুরতা, রাজ্য সরকার, কেন্দ্র সরকারের মিলিত প্রয়াস এবং হাজার হাজার পুজো উদ্যোক্তার নিরলস পরিশ্রম এনেছে এই স্বীকৃতি। কিন্তু গত দু'বছরের অবস্থা, করোনাকাল এবং পুজোকেন্দ্রিক অর্থনীতির সামগ্রিক অবনমনে বিশ্লেষণ হয়েছে বারবার। কিছু দিন আগেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পুজোয় কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। আর এখানেই উঠেছে প্রশ্ন। সত্যিই কি তাই! একটি পুজো, ধর্মীয় আচার, উৎসবে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেন অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ক্রমশ সেরা?
ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাম্প্রতিক একটি পর্যবেক্ষণ বলছে, গড়ে ৩২,৩৭৭ কোটি টাকার অর্থনীতি আবর্তিত হয় দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে। ২০১৯-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজ্যের ২.৫৮ শতাংশ জিডিপি নির্ধারিত হয় দুর্গা-উৎসবকে ঘিরে। শুধু এই তথ্যই নয়, রয়েছে আরও। অ্যাসোচেম-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৩ সালে ২৫,০০০ কোটির অর্থনীতিক আদানপ্রদান হয়েছে দুর্গাপুজোয়। রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় এই ক্ষেত্রে, 'কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট' অথবা সিএজিআর ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ। ২০২১, অর্থাৎ করোনাকালেও খুব একটা হেরফের হয়নি তার। শুধুমাত্র অসুবিধায় পড়েছেন তৃণমূল স্তরের শ্রমিকরা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। যদিও বিগত কয়েক বছরেই দুর্গা পুজোয় প্রায় ২.৭৫ লক্ষ কোটির অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে বলা হয়।
এই অর্থের সূত্র? বলা হচ্ছে, প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা এবং এই সংক্রান্ত নানা ক্ষেত্র থেকে আসে। অর্থাৎ, জনপ্রিয়তা অনুযায়ী ওঠানামা করে বিজ্ঞাপনের ধরন। প্রতি মুহূর্তে লেনদেনের ক্ষেত্রে তারতম্য দেখা যায় পুজোর বহর অনুযায়ী। যেখানে দুর্গাপুজো এবং উৎসবের মাধ্যমে অর্থনীতির একটা ভূমিকা আবর্তিত হয়। শুধু বহুজাতিক সংস্থা নয়, স্যুট-বুট পরিহিত একটা বড় অংশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর চাকরি-ভাগ্য এবং ভালো-মন্দের পুরো বছর নির্ভর করে, রাস্তার পাশের ঘুগনি-ওয়ালার ঘুগনি বিক্রির অবস্থানের মতোই! যেখানে একাকার হয়ে যায় ওই বহুজাতিকের বিজ্ঞাপন আর নাগরদোলার কর্মচারীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা।
কলকাতার দুর্গাপুজো মানেই জনসমাগম
এই প্রসঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম পুজো, 'যোধপুর পার্ক শারদীয়া উৎসব কমিটি'-র সম্পাদক সুমন্ত রায় আমাদের জানান, ''লাভবান ঠিক নয়, আসলে থিম পুজো এবং বহুজাতিক সংস্থার সহযোগিতা, বিজ্ঞাপন সার্বিক সাহায্য করছে সব অংশকে। যে লোকটা বাঁশ বাঁধছেন, যে শিল্পী ছবি আঁকছেন সকলে উপকৃত হচ্ছেন এর কারণে। প্রত্যেককে ভালো থাকার রসদ দিচ্ছে এই উৎসব, এই দুর্গাপুজো। আর্থিকভাবে বেঁচে থাকার খানিকটা উপকরণ পাচ্ছেন সকলেই।''
জেলার পুজোর ক্ষেত্রেও একই সূত্রে বাঁধা থাকছে সবটা। ভিড় আর সৃষ্টিশীলতা সার্বিকভাবে বাঁচাচ্ছে অর্থনীতি। বিজ্ঞাপন আবর্তিত হচ্ছে পুজো কমিটির প্রভাবশালী যোগ অথবা বিরাট প্রচারে। যেখানে অনেকেই বলেন, দেশপ্রিয় পার্কের 'সবচেয়ে বড় দুর্গা'র বিরাট বিজ্ঞাপন! একটি সিমেন্ট কোম্পানির মারাত্বক প্রচার যেমন ওই পুজোকে কেন্দ্র করে হয়েছিল, ঠিক তেমনই ওই পুজোর পাশে থাকা ছোট্ট দোকানের মালিকও হেসেছিলেন। সেবার ভাগ্য সহায় হয়নি যদিও। মাঝপথে বন্ধ হয় প্যান্ডেল, প্রতিমা দর্শন।
দক্ষিণ কলকাতার একাধিক মন্ত্রীর পুজোর জাঁকজমক। চোখজুড়োনো থিম। আবার ম্যাডক্স স্কোয়ারের নিখাদ আড্ডা। সবক্ষেত্রেই দর্শক টানার সঙ্গেই বাড়ে অর্থনীতির পারদ। একসূত্রে বাঁধা পড়ে উৎসব, অর্থনীতি এবং আগামীর ভালোথাকা। কলকাতার দুর্গাপুজো, যার বহর বেড়েছে ২০১১ সালের পর থেকে। আর এই লোকটানা যেমন ছোট ব্যবসায়ী, মরশুমে ব্যবসা করা ব্যবসায়ী অথবা বহুজাতিক সংস্থা; সবার ক্ষেত্রেই সুবিধা প্রদান করেছে। আবার খানিকটা বিলুপ্ত করেছে সংগঠিত ক্ষেত্রের একাধিক সত্তাকে।
সামগ্রিক এই অর্থনৈতিক বিকাশে ভিড়ের প্রসঙ্গ উঠেছে বারবার। কেউ প্রাসঙ্গিকভাবেই দুর্গাপুজো, কার্নিভাল এবং অর্থনীতিতে ভিড়ের প্রভাবের কথাও বলেন। যেখানে দেখা যায়, মিউনিখে অক্টোফেস্ট-কে কেন্দ্র করে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। মাত্র কয়েক দিনের এই অনুষ্ঠানে ঢল নামে দর্শকের। আবার রিও-দি-জেনেইরো-র একটি মরশুম উৎসবে ১৫ লক্ষ মানুষ উপস্থিত হন। বলা হচ্ছে, শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই এই উৎসব দেখতে হাজির হয়েছিলেন কয়েক লক্ষ বিদেশি পর্যটক। জাপানের হানামি-তে বসন্তের চেরি উৎসবে হাজির হন প্রায় ৬.৩০ কোটি মানুষ!
অর্থাৎ, উৎসব এবং তার প্রচার আবহে, তার বহরে দর্শকের উপস্থিতি নজর কাড়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও। দুর্গাপুজো উৎসবেও বিদেশি অতিথিদের প্যাকেজ-ট্যুর এবং বিশ্বজনীন পুজোর প্রচার অচিরেই বাড়িয়েছে এই আবহ। ব্যবসা বেড়েছে। অর্থনৈতিক লাভ ঘরে তুলেছে রাজ্য।
অধ্যাপক তপতী গুহঠাকুরতার ২০১৫ সালে প্রকাশিত বই, 'দ্য দুর্গাপূজা কন্টেম্পোরারি, কলকাতা'-তে উল্লেখ করা হয়; দুর্গাপুজোর বিশালতা, বহর রাস্তাজোড়া উৎসবের কথা। যা প্রতি মুহূর্তে উৎসবের আদলে আসলে বাঁচিয়ে রেখেছে একটি সংস্কৃতি, একাধিক উপজীব্যকে। যেখানে মহাসমারোহে ঢাকের বোলের সঙ্গেই অনুরণিত হয়েছে একটি বিরাট ক্ষেত্রের ব্যবসায়িক এবং তার প্রভাবে অর্থনৈতিক প্রচারক্ষেত্র। যেখানে সমস্ত রশিবিজ্ঞানকে অবাক করে পুজোর অর্থনীতি ব্যাপ্ত হয়েছে ক্রমশ। যা আগে মহারাষ্ট্র, বিশেষত মুম্বইয়ের গণেশপুজোকেন্দ্রিক ছিল। তা বিগত দুই দশকের বেশি সময় ধরে 'হাইজ্যাক' করেছে দুর্গাপুজো। খেলনা বেঁচে হাসিমুখে বাড়ি ফেরা লোকটার সঙ্গেই বহুজাতিকের প্রচার-আলোকে সর্বোপরি সুরক্ষিত হয়েছে একাধিক পেট-জীবন-জীবিকা। দুর্নীতি আর কালো টাকা সাদা করার অজুহাত বা অভিযোগের মধ্যেও দুর্গা পূজার, দুর্গোৎসবের কঠিন অর্থনৈতিক দুর্গ যে খুব একটা ক্ষতির মুখে পড়ছে না, কিছু খারাপের আবহেও আসলে উৎসব আর অর্থনীতির সুস্থ মেলবন্ধন ঘটছে বারবার। একথাও বলেন অর্থনীতি-বিশারদরা।