নবাব সিরাজের হাতিশাল থেকে শতাব্দী প্রাচীন বাজার, পুজোর মুখে কতটা বদলেছে সাধের হাতিবাগান?

Durga Puja 2023 Shopping Haatibagan Market: আজকের এই হাতিবাগান 'হাতিবাগান' হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়েছে প্রায় তিনশো বছর আগে। আর সেই এলাকায় গড়ে ওঠা বাজারের বয়স প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশী। সেই সময় থেকেই কলকাতার বিভিন্ন রূপ দেখে চ...

শোনা যায়, তৎকালীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা নাকি কলকাতায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে তার সৈন্যবাহিনীকে হাতি রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন উত্তর কলকাতার এই জায়গায়। সেখান থেকেই তার নাম হয়ে যায় হাতিবাগান। পরবর্তীকালে নবাবের হাতিদের বিশ্রাম নেওয়ার সেই এলাকাতেই গড়ে ওঠে প্রকান্ড এক বাজার। আজকের এই হাতিবাগান 'হাতিবাগান' হিসেবে প্রসিদ্ধি পেয়েছে প্রায় তিনশো বছর আগে। আর সেই এলাকায় গড়ে ওঠা বাজারের বয়স প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশী। সেই সময় থেকেই কলকাতার বিভিন্ন রূপ দেখে চলেছে এই বাজার। স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি যুদ্ধবিমানের থেকে নেমে আসা বোমা, নকশাল আন্দোলন থেকে বারবার অগ্নিকাণ্ড, করোনা ভাইরাস থেকে বিশ্বায়নের ছোঁয়া, কী দেখেনি সে। হাজার বছর ধরে এই পথে হেঁটে চলা মানুষের জীবনের গল্প যেমন সে জমা করেছে তার সিন্দুকে, ঠিক তেমন ভাবেই দুর্গা পুজোর প্রাক্কালে মানুষের সাধ, আহ্লাদ মেটানোর নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে এই বাজার। কিন্তু সে নিজে কেমন আছে বর্তমানে? সেই বাজারে পণ্য বিক্রেতা থেকে অগণিত ক্রেতাদের মনে তার জায়গা কোথায়? আর সেই গল্প বলতে পারে বোধহয় শুঘু সেই বাজার ঘিরে জড়ো হওয়া অগণিত ক্রেতা-বিক্রেতাই।

গোটা হাতিবাগান জুড়ে অজস্র জিনিসের মেলা। বিভিন্ন কস্টিউম জুয়েলারি থেকে শাড়ি, জামা, জুতো, কুর্তি- কী নেই। তেমনই হাতিবাগানের অলিগলি জুড়ে বিরাট ভিড় প্রসাধনী বিক্রেতাদের। বহু দিন পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সাজগোজের জিনিসপত্র বা প্রসাধনী জিনিসের জন্য উত্তর কলকাতার বড় ভরসা ছিল এই হাতিবাগান বাজার। পুজো মানে সুন্দর করে সাজগোজ, মেকআপ। আর তার জন্য পুজোর সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই ফুলেফেঁপে উঠত এই সব ব্যবসায়ীদের পকেট। দোকানের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতেন কর্মীরা। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে সেই বাজারের চাহিদা অনেকটাই কমেছে। মানুষ অভ্যস্ত হতে শুরু করে অনলাইন কেনাকাটার মতো নিউ নর্মালে। আর তার ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছেন অজস্র প্রসাধনী ব্যবসায়ী।

আরও পড়ুন: পুজোর বাজার মাটি, ছোট ব্যবসায়ীদের চরম দুর্ভোগ, কবে থামবে বৃষ্টি?

হাতিবাগানের এক সাধারণ প্রসাধনী বিক্রেতা জানালেন, বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বিক্রি বাড়লেও তা পুজোর আন্দাজে কমই। অন্তত আগের কয়েক বছরের পুজোর তুলনায় তো বটেই। একসঙ্গে আক্ষেপ ও আশা, দুই সুরই ঝরে পড়ে তাঁর গলায়। ইদানীং তো বেশিরভাগ ক্রেতাই ঘরে বসেই ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন নামী-দামি সংস্থার প্রসাধনী সামগ্রী কিনে ফেলেন। একগুচ্ছ ছাড়, অফার সেখানে মিলতেই থাকে। মুশকিল হচ্ছে, তাঁর ব্যবসার পুঁজি কম। তাই প্রসাধনী সামগ্রীর দামের উপর লাভ রাখতে গেলে দাম খুব একটা কমাতে পারেন না। এছাড়া তাঁর পক্ষে তো আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিনিস পৌঁছে দেওয়াও সম্ভব নয়। অগত্যা তাঁর ক্রেতার সংখ্যা সময়ের সঙ্গে অল্প অল্প করে কমছেই। একটা সময় তাঁর ক্রেতাদের মধ্যে সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত ক্রেতাদের সংখ্যাই ছিল বেশি। কিন্তু দেখা গিয়েছে, নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছে এখম। উচ্চ মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চবিত্ত ক্রেতার সংখ্যা তিনি হয়তো হাতের আঙুলে গুনে বলে ফেলতে পারবেন। কারণটা অনুমান করা খুব একটা কঠিন নয়। বড়ো বড়ো দোকান, শপিং মল অথবা অনলাইনেই প্রসাধনী কিনতে পছন্দ করছেন তাঁরা এখন। গত দু'বছরে করোনা অতিমারির জেরে সব দোকানই একটা বড় অংশের ক্রেতা হারিয়েছিল প্রায় সব ছোটবড় দোকানই। আর সেই সময়টাই মানুষ আরও বেশি করে অনলাইন খরিদ্দারির দিকে ঝোঁকে।

তার পর এ বছর গোটা সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে চোখ রাঙিয়েছে নিম্নচাপ। বর্ষা চলে যাওয়ার পরেও বিরাম ছিল না বৃষ্টির। যার ফলে অনেকাংশেই মার খেয়েছিল ব্যবসাপত্তর। তবে মেঘ সরতেই রাস্তায় নেমেছিল ক্রেতাদের ঢল। বাড়ে বিক্রিও। তবে পুজোর আগে ঠিক যতটা বিক্রিবাটার আশা ছিল, ততটা বোধহয় পূরণ হল না এ বছর।

North Kolkata's Hatibagan market and its Current situation

তার ক্রেতার সংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে গত কয়েক বছর যুক্ত হয়েছিল করোনা মহামারীর প্রকোপ। এই বছরেও সেপ্টেম্বর মাসের শেষে নিম্নচাপের ফলে ঘটে চলা অবিরাম বৃষ্টিতে তিনি আবার সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন। যদিও একটু খুশি খুশি ভাব নিয়েই তিনি বলেছেন যে বৃষ্টি কমতেই রাস্তায় আবার ক্রেতাদের ঢল নেমেছে। বিক্রি হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। তার আশা যে পুজোর আগে হয়তো আর বৃষ্টি হবে না এবং বেশ কিছু বছর পরে তিনি হয়তো আবার ভালোমতো লাভের মুখ দেখতে পাবেন।

সেই আক্ষেপের সুর শোনা গেল হাতিবাগান এলাকার আরেকটি প্রসাধনী বিপণীর কর্মীও। তাঁদের দোকানেও উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, নেট মাধ্যমে জিনিস কিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে তাদের বিভিন্ন ধরণের নতুন নতুন প্রসাধনী সামগ্রীর চাহিদা বেড়েছে। যা সব সময় হয়তো ছোটখাটো দোকানে পাওয়া যায় না। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের উপর যে পরিমাণ ছাড় তাঁরা দিতে তাতে অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতাকে খুশি করা যায় না। তাঁরা যাচাই করে নেন, কোথায় কোন জিনিস বেশি সস্তা। পাঁচ বছর আগেও যেই পরিমান প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রি হতে দেখা যেত, তার অর্ধেকের কম করোনাকালে বিক্রি হয়েছে। সেই দুর্দশার দিন ঘুচেছে কিছুটা। এই বছর ক্রেতা এবং বিক্রয় হওয়া পণ্য, দুটোই কিছুটা বেড়েছে বটে, তবে তা কিন্তু পাঁচ বছরের আগের অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি আদৌ। তা সত্ত্বেও তাঁরা আশা করতে থামছেন না যে এই বছর হয়তো কিছুটা লাভের অঙ্ক ঘরে তুলতে পারবেন তাঁরা। আর সেই আশা নিয়েই সপ্তমীর পর্যন্ত দোকান খুলে রাখছেন হাতিবাগান মার্কেটের অধিকাংশ ব্যবসায়ী।

তা সত্ত্বেও এখনও কেউ কেউ অনলাইনের থেকে দোকান থেকে হাতে দেখে শুনে যাচাই করেই জিনিস কিনতে পছন্দ করেন আজও। ঠিক তেমন ভাবেই অনলাইনের পক্ষেও ঝুঁকে রয়েছেন আরও একটি পক্ষ। প্রসাধনী দ্রব্যের এক ক্রেতা যেমন জানাচ্ছেন, তাঁর বান্ধবীদের মধ্যে অনেকেই কর্মসূত্রে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে বসবাস করেন। তাঁদের কাছে পুজোর ছুটি মানে দুর্গা পুজোর দিনগুলিতেই হাতে গোনা ছুটি। পুজোর আগে এই রাজ্যে ফেরার উপায় তাঁদের কাছে নেই। তাই বিভিন্ন প্রসাধনী দ্রব্য কেনার জন্যে ই-কমার্স সাইটগুলোর উপরেই ভরসা করতে বাধ্য হন। তাছাড়া একটু বয়স্ক যাঁরা, তাঁরা অনেকেই বয়সজনীত কারণে হাতিবাগানের মতো ভিড়ভাট্টার বাজারে যেতে চান না। কেউ বা আসেন না দূরত্বের কারণে। তবে অনেকেই এমনও রয়েছেন, যাঁরা হাতিবাগান বাজারের যে নস্টালজিয়া, তা পুজোর আগে মিস করতে চান না কোনও মতে। তাই তাঁরা এখনও আসেন প্রাচীন এই বাজারে। ঘুরে, দেখে, পরখ করে পছন্দসই জিনিসটি ঘরে নিয়ে যান।

North Kolkata's Hatibagan market and its Current situation

শুধু যে প্রসাধনীর ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটছে তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন শ্রেণীর বস্ত্রবিক্রেতাদের থেকে পাওয়া তথ্যগুলিকে এক জায়গায় করলে যা দাঁড়ায়, তার সারবত্তাটা কিন্তু এর চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়। দুর্গাপুজো উপলক্ষে এখনও আত্মীয়স্বজনদের পোশাক উপহার দেওয়ার রীতি রয়েছে বহু বাড়িতেই। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই পুজোর আগে শাড়ির দোকানগুলি বেশ ভিড় হতে শুরু করে। তবে দোকানদারেরা কিন্তু বলছেন, ইদানীং আত্মীয়দের জন্যে তাঁত অথবা ছাপা শাড়ির কেনার প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। এদিকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য পূর্বের তুলনায় দামী শাড়ি কিনছেন অনেক ক্রেতাই। তবে সেই সংখ্যাটা নিতান্তই কম। শাড়ির তুলনায় উচ্চ মধ্যবিত্ত মহিলা ক্রেতারা অনেক ক্ষেত্রেই কুর্তি কেনার দিকে মন দিয়েছেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে জামা বা প্যান্টের পিসের তুলনায় রেডিমেড জামা কেনার চল বেড়েছে বহু বছর থেকেই। করোনার ফাঁড়া কাটিয়ে বিক্রি বাড়লেও পুজোর আগে ঠিক ততটাও লাভের মুখ দেখেননি শাড়ি ব্যবসায়ীরা।

হাতিবাগান বাজারের এক ক্রেতা জানালেন যে তিনি একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। যেখানে কোনও ভাবেই পুজোর সব দিন ছুটি পাওয়া সম্ভব হয় না। এমনিতেই পুজোর আগে কাজের চাপে নিঃশ্বাস ফেলা দায়। সেই পরিস্থিতিতে দোকানে গিয়ে জামা এবং প্যান্টের পিস পছন্দ করে কেনা, তারপর সেই পিস দর্জির কাছে নিয়ে গিয়ে মাপ দিয়ে বানাতে দেওয়া এবং আবার পরে গিয়ে সেই জামা সংগ্রহ করে আনা। সেই ঝামেলা এড়াতেই পছন্দসই রেডিমেড জামা কেনার দিকে ঝোঁকেন তিনি। দোকানে কিছু পছন্দ হলে একরকম, নাহলে ই-কমার্স সাইট তো রইলই। আরেক ক্রেতা জানালেন যে তিনি আগে হাতিবাগান বাজারের বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে জিনিস কিনলেও এখন নির্দিষ্ট কয়েকজন বিক্রেতার কাছ থেকেই পছন্দের জিনিস কেনেন। কারণ এখন পরিবেশ পাল্টেছে অনেকটাই। জিনিস কিনতে এসে দরদাম করতে গেলে হাসিঠাট্টার শিকার হতে হয়, আবার কোনও বিক্রেতার কোনও পণ্য পছন্দ না হলেও প্রায়শই সহ্য করতে হয় বিদ্রূপ। তাই তিনি আর পুরো বাজার ঘুরে জিনিস কিনতে পছন্দ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তার পছন্দের জিনিস তার নির্দিষ্ট বিক্রেতার কাছে না পেলে তিনি শপিং মল অথবা অনলাইন থেকেই সেই জিনিসটি কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেন।

আরও পড়ুন:হাতিবাগান বা নিউমার্কেট কি এখনও বঙ্গ জীবনের কেনাকাটার অঙ্গ?

এ সমস্ত কিছু নিয়েই তবু দাঁড়িয়ে থাকে হাতিবাগান মার্কেট। শরীর থেকে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত সারিয়ে চেষ্টা করে নিজেকে মানুষের মনপসন্দ সামগ্রীতে ভরিয়ে তুলতে। আর সে কারণেই বোধহয় এতগুলো বছর ধরে টিকে থাকা এই বাজার আজও নতুন। প্রায় রোজই একগুচ্ছ নতুন-পুরনো ক্রেতা, বিক্রেতার আগমন ঘটে এখানে। দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে বহু মানুষই নিজের পছন্দের জিনিস দেখে বেছে কেনার আশায় ভিড় জমান। পাশাপাশি বিক্রেতারাও সারা বছর ধরে তাকিয়ে থাকেন এই সময়টার দিকে। আর একটু বেশী লাভ হবে সেই আশায় মন বাঁধেন। আর অজস্র ক্রেতা, বিক্রেতার সেই আশা, আক্ষেপের গল্প বুকে নিয়েই আলোয় সেজে দাঁড়িয়ে থাকে শতাব্দীপ্রাচীন এই হাতিবাগান বাজার।

More Articles