ডক এলাকার সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ও আটের দশকের দুর্গাপুজো
DC Vinod Mehta: অনেকের অস্ত্র মিলে-মিশে দুর্গা শক্তিময়ী, অসুর মারা পড়ল। ডিসি মেহতাকে কি তাহলে সবাই মিলে অস্ত্র দেয়নি?
ফকির মাস্টার থেকে এ ওয়ান টেলরে। এ যেন একেবারে মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গলে কিংবা ইস্টবেঙ্গল থেকে মোহনবাগানে। যাওয়াটা যে এভাবে দ্রুত ও নিশ্চিত গতিতে হবে, সে ভাবতেও পারেনি, কিন্তু হলো। বাবার সাইকেলের রডে বসে ফকির মাস্টারকে পিছনে ফেলে আরও তিনটে দোকান এগিয়ে সে এসে থামল সদ্য গজিয়ে ওঠা এ ওয়ান টেলরের সামনে। ফকির মাস্টার কিছু বলেনি, তবে দেখেছিল। তার আর বাবার ক্ষেত্রে টেলর বদল হলেও মায়ের ক্ষেত্রে দোকান বদল হয়নি। যদিও নিউ রঞ্জিত স্টোর্স দোকানটা বড়, ঝকঝকে ও জেনারেটর-শোভিত- তবু মা গিয়ে বসেছিল ওল্ড রঞ্জিত স্টোর্সের কাঠের বেঞ্চিতে। রাস্তার ধারে নালি বাঁচিয়ে কাঠের বেঞ্চিগুলো এমনভাবে রাখা, যাতে নালি ঢেকে যায়, অথচ বেঞ্চিও নালিতে না পড়ে, চার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এ ওয়ানে যাওয়ার যুক্তি এই, ফকির মাস্টার বুড়ো হয়েছে, নিজে কাজ করতে পারছে না, জামা-কাপড় ঢিলে-ঢালা হচ্ছে। নতুনদের এবার সুযোগ দিতে হবে– তাই পুজোয় চাই নতুন টেলর, নাম তার এ ওয়ান। আর নিউ রঞ্জিতে না যাওয়ার কারণ টাকা। সাবেকি রঞ্জিতে যে দামে যা পাওয়া যায়, নতুন রঞ্জিতে সে দামে তা পাওয়া যাবে না। জামা-কাপড়ের দামের মধ্যে দোকানের চাকচিক্য আর জেনারেটরের খরচ মিশে যাবেই যাবে। সুতরাং, এই যুক্তিতেই আয়তকার পুরনো রঞ্জিত স্টোর্সের বেঞ্চিতে বসে মা রুবিয়া ভয়েলের ব্লাউজ আর ছাপা শাড়ি কিনল।
সন্তোষী মায়ের বড়লোকি মন্দিরের পাশে রাজগ্রাম– সেখান থেকে গামছা কেনার কথা। সে গামছা যাবে কলকাতা, দিদিমার কাছে। পুরুলিয়া থেকে কলকাতা তখন অনেক দূর। সে দূরত্ব মোছার জন্য একখানা ট্রেন– হাওড়া চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার, আর একখানা লাল বাস। সেই লাল বাস কলকাতার সকালবেলার কাগজ বিকেল-সন্ধের পুরুলিয়ায় বয়ে নিয়ে আসে । ১৯৮৪ সাল, মার্চ মাস। ডিসি মেহতা, পঁয়ত্রিশ বছরের সৎ পুলিশ অফিসার ডিসি মেহতা, খুন হলেন কলকাতার ডক এলাকায়। কুপিয়ে হত্যা করা হলো তাঁকে। নিহত হলেন তাঁর সহযোগী ইদ্রিস আলি। খবরের কাগজের পাতায় ছবি এঁকে খুনের পথ-পদ্ধতি বুঝিয়ে বুঝিয়ে ছাপা হয় সেই মর্মান্তিক খবর। সন্ধেবেলায় সাঁওতালডিহির চুল্লি বসে যায়। পুরুলিয়ায় আলো নেই, লোডশেডিং। হ্যারিকেনের আলোয় মা লাল বাসে করে আসা খবরের কাগজ থেকে ডিসি মেহতার হত্যা-ঘটনা পড়ে শোনায়। পড়তে পড়তে কেঁদে ফেলে। "মানুষটাকে এভাবে খুন করল। ছেলেটার কী হবে? আর বউটার? কী সুন্দর দেখতে। কত আর বয়স!" সে হাঁ করে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। রেশনের কেরোসিনে ময়লা ছিল, লণ্ঠনের শিখা কেঁপে কেঁপে ওঠে।
সেই বছরই পুজোর সময় এসেছিল বাংলা সিনেমা ‘শত্রু’। পুরুলিয়ার কমলা টকিজে রিলিজ করেছিল। হিট ছবি, অনেকদিন চলেছিল। তারা পুজোর পর ‘শত্রু’ দেখেছিল– ডিসি মেহতা হেরে গিয়েছিলেন, সিনেমার সৎ পুলিশ অফিসার হেরে যাননি। মা খুব খুশি, সেও। এ ওয়ান টেলরের প্যান্ট খুব ফিট করেছিল, তাই পরেই সে গিয়েছিল কমলা টকিজে।
আরও পড়ুন: অভাবের সংসারে রবি ঠাকুরের জন্য চাদর আর পার্থ-গৌরী ঘোষের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ
রুবিয়া ভয়েলের ব্লাউজ দুটো, আর ছাপা শাড়ি একটা। এই ছিল মায়ের পুজোর সাজ। পুরনো রঞ্জিত স্টোর্স দোকানখানি আয়তকার। সে-দোকানের মেঝেতে তিনজন বসে। আর দু'জন তাকে তাকে পা-দিয়ে খানিকটা উঠে দাঁড়িয়ে ঝুলছে। নিচ থেকে অর্ডার যাচ্ছে। ঝুলন্ত অবস্থায় ওপর থেকে নিচে অর্ডার-মাফিক জিনিস পড়ছে। এরই মধ্যে রাস্তায় একটা বাস ঢুকে পড়ল। বাস ঢুকে পড়লে বেঞ্চিতে বসে থাকা কাস্টমারদের উঠে পড়তে হয়। দোকান থেকে একটা ছেলে লাফ দিয়ে নামে, খালি বেঞ্চি বগলে তুলে দোকানের পাশে নালি ডিঙিয়ে এক-চিলতে জায়গায় আশ্চর্য কায়দায় দাঁড়িয়ে পড়ে। সেই ফাঁকে খালাসি বাস থেকে নেমে দোকানের গায়ে কতটা জায়গা আছে পরীক্ষা করে। তারপর ‘যাও যাও’ বলে বাসের কোলে-পিঠে হাত দিয়ে সশব্দ চড় মারতে থাকে। দু'-বার পর পর মারলে বাস যাবে। একবার মারলে বাস থামবে। এই কায়দায় একসময় বাস এগিয়ে যায়। তখনই বেঞ্চি বগলে ছেলেটি বাইরে এসে আবার নালি বাঁচিয়ে কায়দা করে বেঞ্চি বসিয়ে দেয়। কাস্টমাররা বিনা বাক্যব্যয়ে বসে পড়ে। পুনরায় ওপরের মাল নিচে, নিচের মাল খদ্দেরের ব্যাগে চলে যেতে থাকে।
এ ওয়ান টেলর, পুরনো রঞ্জিত স্টোর্স এ-সব নয়– তার আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে আরেকটি দোকান। সে দোকানটির কোনও নাম নেই, তবে ধাম আছে। শ্মশানকালীর মন্দির থেকে রথতলার দিকে যেতে পর পর দুটো দোকান। দোকান আলো করে বসে থাকে কতরকমের বাজি। দুটোর একটার সামনে দাঁড়ায় তারা। কালী-পটকা, চকোলেট, রকেট, সাপ, রংমশাল, ক্যাপ– আরও কত কী! সবকিছু কেনার উপায় নেই। পয়সায় কুলোবে না। তবে কিছু কিছু তো কেনা যাবে। বন্দুক তো প্রত্যেক বছর কিনতে হয় না, কিনতে হয় ক্যাপ। কালী-পটকাও কেনা হয় আর কেনা হয় প্যাকেট ভেঙে খানপাঁচেক রকেট। অল্প পুঁজির সেই বাজি রোজ একবার করে রোদে দিতে হয়, তাহলে বিকেলে ভালো ফাটে। রকেট ওড়ানোর জন্য মায়ের কাছ থেকে নিতে হয় লম্বাটে ছোটো-মুখ শিশি। শিশিতে রকেট বসিয়ে তারপর আগুন দিতে হয়– হুশ করে সে রকেট শিশিকে শুইয়ে দিয়ে উড়ে যায় আকাশপথে। খুব দূর আকাশে যাওয়ার শক্তি অবশ্য তার নেই। শক্তি কারই বা আছে?
সেবার পুজোর পর ‘শত্রু’ দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল, তার শক্তি থাকে না, শক্তি আছে মনে মনে তা ভাবতে হয়। শক্তি ভাবলেই শক্তি! দুর্গাঠাকুরের পায়ের কাছের অসুরটির মুখে দশমীর দিন সন্দেশ দেয় মা। তখন বেশ হাসি হাসি মুখ হয়ে যায় তার। অসুরও যে হাসে, হাসতে পারে- একথা সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী কোনওদিনই মনে হয়নি তার। অথচ দশমীর দিন মুখে সন্দেশ পড়তেই মনে হলো, অসুর যেন হাসছে। অসুরের মুখে যেমন হাসি খুলে গেল, তেমনই হঠাৎ করে কোনও মানুষের মনে ভর করতে পারে সাহস। ডিসি মেহতারও কী মনে সাহস ভর করেছিল? কিন্তু সেই সাহস কি শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি? পারেনিই তো! পারলে তো এভাবে খুন হতেন না তিনি। যখন মহালয়া বাজে রেডিওতে, তখন শুনেছে সে, অনেকে মিলে দুর্গাকে অস্ত্র দিলেন। তাঁদের অস্ত্র মিলে-মিশে দুর্গা শক্তিময়ী, অসুর মারা পড়ল। ডিসি মেহতাকে কি তাহলে সবাই মিলে অস্ত্র দেয়নি? সবাই কি চায়নি তবে, চোরা-কারবারিরা হেরে যাক! সব তালগোল পাকিয়ে যায়।
পুজোর পর অনেক দিন অবধি পাড়ার এদিক-ওদিক চোখে পড়ে পুড়ে যাওয়া বাজির দেহাবশেষ। রোদের তেজ আর বারুদের শক্তি তাদের কয়েক মুহূর্তের জন্য শক্তিশালী করে তুলেছিল। বেঁচে থাকা কয়েকটা ক্যাপ তার শেষ সম্পদ। যখন ইচ্ছে হবে, তখন ফাটাবে। খেলনা বন্দুক আর সশব্দ ক্যাপ- এই দুয়ের তালমিল একসময় শেষ হবে। ক্যাপহারা বন্দুক অপেক্ষা করবে আরেকটা পুজোর জন্য।
শক্তি একার নয়, শক্তি অনেকের তাল-মিলের ভাবনা। শক্তি চিরকালের নয়, শক্তি মুহূর্তের।
ভাসানের পর জলের ওপরে ভেসে ওঠে দুর্গার মূর্তিহারা সাজের ভগ্নাবশেষ– তাদের মুহূর্তরা আসে, তাদের মুহূর্তরা চলেও যায়।