জামিন কলতানের, কী জবাব দেবেন কুণাল? কী বলবে রাজ্য পুলিশ?
Kalatan Dasgupta: আপাতত এই মামলায় আদালতের অনুমতি ছাড়া কলতানের বিরুদ্ধে পুলিশের তদন্ত করারও প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে হাইকোর্ট।
তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে হামলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছিলেন খোদ তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। শেষমেশ কলকাতা হাইকোর্টে মিলল ধাক্কা। পাঁচ দিন জেল খাটার পর জামিন পেলেন বাম যুবনেতা কলতান দাশগুপ্ত ৷ ৫০০ টাকার বন্ডে তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে। জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে হামলার ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। সেই মামলা ঘিরে হাইকোর্টে কড়া প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল রাজ্যকে। এবার সেই মামলায় বামনেতাকে মুক্তি দিল হাইকোর্ট। আদালত সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আদালতের অনুমতি ছাড়া এই সংক্রান্ত মামলায় কলতানকে গ্রেফতার করা যাবে না। আদালতের অনুমতি ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তও করতে পারবে না পুলিশ। এই মামলায় চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। পাল্টা চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দিতে পারবেন কলতানও। আগামী ১৮ নভেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানি।
আরজি কর কাণ্ডে তোলপাড় গোটা রাজ্য। প্রায় ৪১ দিন ধরে কর্মবিরতি ও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে সল্টলেকে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ধর্নায় বসেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। এর আগে লালবাজার অভিযানেরও আয়োজন করা হয়েছিল। এই আবহে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ একটি অডিয়ো প্রকাশ করেন। তাতে শোনা গিয়েছিল, কেউ বা কারা সল্টলেকে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নাস্থলে হামলার ছক কষছেন। কুণালের অভিযোগ ছিল, ধর্নাস্থলে হামলা চালিয়ে তৃণমূলের ঘাড়ে তার দায় চাপানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। (এই অডিয়োর সত্যতা যাচাই করা যায়নি অবশ্য)। ওই অডিয়ো প্রকাশের পরেই পুলিশ তার ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে। তার পরেই রাতারাতি গ্রেফতার করা হয়েছিল বাম নেতা কলতান দাশগুপ্তকে।
আরও পড়ুন: ‘অর্ডার হলে করে দে…’ ! কলতনের ভাইরাল অডিও কি সত্য?
কুণালের অডিয়ো মামলায় সঞ্জীব দাস নামের আরও এক যুবককে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট নয়। পুলিশ জানিয়েছিল, অডিয়োর সত্যতা তারা যাচাই করে দেখেছে। তাতে যে গলা শোনা যাচ্ছে, তার একটি কলতানের। তবে আইনানুগ পদ্ধতিতে কলতানের গলার স্বর পরীক্ষা করে এ বিষয়ে প্রমাণ নির্দিষ্ট করা হবে, জানিয়েছিল পুলিশ। কলতান নিজে অবশ্য গ্রেফতারির পরেই দাবি করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। এর পরেই তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে মঙ্গলবার মামলা দায়ের হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টে। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের এজলাসে প্রথমে মামলা দায়েরের আবেদন করা হয় ৷ সেই আবেদনের ভিত্তিতে মামলা দায়েরের অনুমতি দেন বিচারপতি ৷
বৃহস্পতিবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের একক বেঞ্চে কলতানের মামলার শুনানি ছিল। বৃহস্পতিবার দুপুরে মামলার শুনানি শেষ হয়। সন্ধেয় রায় দেয় হাইকোর্ট। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের উপর হামলার চক্রান্ত সংক্রান্ত একটি ফোনালাপের অডিয়ো ক্লিপ সম্প্রতি প্রকাশ্যে এনেছিলেন কুণাল ঘোষ। প্রশ্ন ওঠে, অডিয়ো ক্লিপ-কাণ্ডে গ্রেফতারির আগেই কীভাবে তা একজন রাজনৈতিক নেতার কাছে চলে গেল? এই মামলার শুনানিতে কলতানের হয়ে সওয়াল করেন আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। কলতানের বিরুদ্ধে বিএনএসের ২২৪, ৩৫২, ৩৫৩(এ)(বি)(২), ১৯৬ ও ৬১ ধারা দেওয়া হয়েছিল। আদালত জানায়, গ্রেফতারির পর কলতানের বয়ান রেকর্ড করেছে পুলিশ। তাঁর মোবাইল ফোনও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
কলতানের মামলায় এর আগে রাজ্যের কাছে রিপোর্ট তলব করেছিল আদালত। কিসের ভিত্তিতে কলতানকে গ্রেফতার করা হয়েছে, আদালত জানতে চেয়েছিল। বৃহস্পতিবারও এই সংক্রান্ত শুনানিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে আদালত। বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, পেনড্রাইভটি যে ভাবে পাওয়া গিয়েছে তা নিয়েও ধন্দ রয়েছে। সেটি যাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল না কেন? বিচারপতি ভরদ্বাজ বলেন, ‘‘যদি হামলার ছক কষা হয়েই থাকে, তবে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? পুলিশ কেন কোনও পদক্ষেপ করল না? ১৮-১৯ বছরের ছেলেমেয়েদের তুলে আনা হচ্ছে। ওদেরও ভবিষ্যৎ রয়েছে!’’ গ্রেফতারির আগে অডিয়ো ক্লিপ কী ভাবে রাজনৈতিক ব্যক্তি হাতে পেলেন, সে প্রশ্নও তোলে আদালত। প্রশ্ন ওঠে, সঞ্জীবের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য ধারা দেওয়া হলেও কলতানের বিরুদ্ধে কেন জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করা হল?
যার উত্তরে রাজ্যের আইনজীবী আদালতে জানান, সঞ্জীব এবং কলতানের মধ্যে গত ১০ মাসে ১৭১ বার ফোনে কথা হয়েছে। ফলে দু’জনে একে অপরকে চিনতেন। সল্টলেকের ধর্নাস্থলে হামলার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সঞ্জীব যদি অর্জুন হন, কলতান তবে কৃষ্ণের ভূমিকা পালন করেছেন। কলতানের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘উনি তো কোনও হামলার নির্দেশ দেননি। একটি অডিয়ো ক্লিপ প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে হামলার কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নির্দেশ মতো কাজ করতে। কিন্তু কোনও নির্দেশ তো দেওয়া হয়নি!’’ অডিয়োতে আদৌ কি কলতানের গলা শোনা গিয়েছে? সে প্রসঙ্গে অবশ্য তাঁর আইনজীবী কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
আরও পড়ুন:মমতা বনাম জুনিয়র ডাক্তার! বৈঠক বাতিলের পর স্নায়ুযুদ্ধে কে কোথায় দাঁড়িয়ে?
আপাতত এই মামলায় আদালতের অনুমতি ছাড়া কলতানের বিরুদ্ধে পুলিশের তদন্ত করারও প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে হাইকোর্ট। এই মামলায় চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। পাল্টা চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দিতে পারবেন কলতানও। আগামী ১৮ নভেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানি। কলতানের জামিনের পর তাঁর আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেন, ‘‘দু’জন ব্যক্তির মধ্যে কথোপকথনের ক্ষেত্রে তাঁদের কাছ থেকেই সেই রেকর্ডিং পেতে হবে। যদি তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া যায়, তবে ফোনে কেউ আড়ি পেতেছিল, এটা নিশ্চিত। ফোনের কথোপকথন ব্যক্তিগত। তার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। কেউ এক জন পেনড্রাইভ দিলেন, তার ভিত্তিতে এক জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিল যাচাই না করে, তা হতে পারে না। এ ভাবে তো যে কোনও ব্যক্তিকেই ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়। এই তদন্তভার এই রাজ্যের পুলিশের হাতে থাকা উচিত নয়। যিনি এই অডিয়ো প্রকাশ করেছিলেন, তিনি তা কোথা থেকে পেলেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। তাঁকেও তদন্তের আওতায় আনা উচিত।’’
কার্যত এদিন কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে আরও একবার মুখ পুড়ল রাজ্য সরকারের। এমনিতেই আরজি কর মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে নাস্তানাবুদ অবস্থায় রয়েছে রাজ্য। কপিল সিব্বলের মতো দুঁদে আইনজীবীকেও বারবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয়েছে। তার উপর জুনিয়র ডাক্তাদের আন্দোলন দমাতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে মমতা প্রশাসন। এরই মধ্যে ফের কলতান মামলায় বড়সড় ধাক্কা খেল রাজ্য ও তার পুলিশ। স্বাভাবিক ভাবে কলতানের জামিনে আরও একবার প্রশ্নের মুখে পড়েছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষও। অবশ্য এ প্রথম নয়। আরজি কর মামলায় বারবার আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এক টেলিভিশন অভিনেত্রীকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণ করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। কলতানের বিরুদ্ধে ভাইরাল অডিও বিতর্কে এবার মুখ পুড়ল তাঁরও।