বিস্ফোরক লুকানো ছিল পেজারেই, লেবাননে বিধ্বংসী হামলার নেপথ্যে ‘ধুরন্ধর’ মোসাদ?

Pager Explosions in Lebanon: হিজবুল্লাহের তরফে স্বাভাবিক ভাবেই দাবি, এর নেপথ্যে রয়েছে মোসাদ। পৃথিবীর যত ক'টি দেশের কাছে গুপ্তচর সংস্থা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ইজরায়েলের মোসাদ।

আধুনিক এই অস্ত্রের যুগে শুধু গুলি, বোমা, বন্দুক, বারুদই নয়, সামান্য একটি পেজারও যে হয়ে উঠতে শক্তিশালী বিস্ফোরক, সে কথাই ফের মনে করিয়ে দিল লেবাননে ভয়াবহ পেজার হামলা। প্রতিটি পেজারে গোপনে লুকানো ছিল ৩ গ্রাম করে বিস্ফোরক। অপেক্ষা ছিল শুধু ডিটোনেটর প্রেসের। তার পরেই একের পর এক বিস্ফোরণে কাঁপতে থাকে গোটা লেবানন। কারওর পা, কারওর হাত তো কারওর মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। সাম্প্রতিক ওই হামলায় নিহতের সংখ্যা ৯। আহত হয়েছেন প্রায় চার হাজারের কাছাকাছি। শুধু লেবাননই নয়, সিরিয়ারও একাধিক এলাকায় পেজার হামলা চালানো হয়েছে। দেশের হাসপাতালগুলি হিমশিম খাচ্ছে আহতদের ভিড় সামাল দিতে। কার্যত এই সাইবার হামলার দায় ইজরায়েলের কাঁধেই ঠেলেছে লেবাননের সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ। ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদকেই দায়ী করা হচ্ছে এই ভয়াবহ হামলার জন্য।

লেবাননের সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ, যারা নাকি ইরানপুষ্টও বটে, তাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই চলছেই ইজরায়েলের। শুধু হিজবুল্লাহই নয়, প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন হামাসকে মদত জোগানোর পিছনেও রয়েছে এই ইরানই, তেমনটাই মনে করা হয়। গাজায় ইজরায়েলের হামলার পর থেকেই প্রায় নিয়মিত মিসাইল, ড্রোন নিয়ে ইজরায়েলের উপরে হামলা চালিয়ে গিয়েছে হিজবুল্লাহ। একসঙ্গে ইজরায়েলের দিকে লেবাননের দিক থেকে ছুটে গিয়েছে একশো-দেড়শো ড্রোন বা রকেট। যা সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে ইজরায়েলের মহাশক্তিশালী আয়রন ডোমও। কার্যত একদিকে গাজার সঙ্গে চলমান যুদ্ধ, অন্যদিকে হিজবুল্লাহের লাগাতার এই আগ্রাসী হামলা, খানিকটা হলেও বিব্রত করেছিল ইজরায়েলকে। হিজবুল্লাহ ও ইরানকে সবক শেখাতে এর মধ্যে বেশ কয়েকবার লেবানন ও সিরিয়ায় হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। তার পরেও হামলার তীব্রতা বাড়ায় হিজবুল্লাহরা। ইজরায়েলের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত গুলিবিনিময়ও কার্যত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে হিজবুল্লাহর। এই পরিস্থিতিতে হিজবুল্লাহ ও ইরানকে আঘাত ফিরিয়ে দিতে বড়সড় কোনও ছক কষতে পারে ইজরায়েল, এমন একটা আশঙ্কা তো ছিলই।

আরও পড়ুন: ৯ জনের মৃত্যু, ২৭৫০ জন আহত! লেবাননে কীভাবে ঘটল পেজার বিস্ফোরণ?

হিজবুল্লাহের তরফে স্বাভাবিক ভাবেই দাবি, এর নেপথ্যে রয়েছে মোসাদ। পৃথিবীর যত ক'টি দেশের কাছে গুপ্তচর সংস্থা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ইজরায়েলের মোসাদ। মোসাদের নেটওয়ার্ক যে ঠিক কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং তাদের কার্যকলাপ কতদূর যেতে পারে, তা হিসেব করে বোঝা শক্ত। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির বিমান দুর্ঘটনা ও তাঁর মৃত্যুর নেপথ্যেও এই মোসাদের হাত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিল একটি মহল। ইরান ও ইরান সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে ইজরায়েলের যেরকম উত্তাপ বিনিময় চলছে গত কয়েক মাস ধরে, তাতে এই হামলার নেপথ্যেও মোসাদের হাত থাকা আশ্চর্যের কিছু নয় বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। এমনকী আমেরিকাও সেই তত্ত্বেই সায় দিয়েছে। এই পেজার হামলার নেপথ্যে ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হাত রয়েছে বলেই মনে করছে তারাও।

যতদূর জানা গিয়েছে, হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চালানোর জন্য সাম্প্রতিক কালে ব্য়বহার শুরু করে পেজার নামক এই মেসেজিং ডিভাইসের। কারণ এই ডিভাইসের মাধ্যমে জিপিআরএস ট্র্যাকিং সম্ভব হয় না। ফলে প্রাথমিক ভাবে এই ডিভাইস মোবাইলের থেকে সুরক্ষিত। হ্যাক করাও তুলনামূলক কঠিন এটিকে। অভিযোগ করা হয়েছে, আগে থেকেই সেই ডিভাইসগুলির মধ্যেই তিন গ্রাম করে বিস্ফোরক লুকিয়ে রেখেছিল গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। সময় মতো পালা ছিল ডিটোনেটর প্রেস করার। যার জন্য এই  দিনটিকেই বেছে নিয়েছিল হামলাকারীরা।

এই পেজারগুলি তৈরি করানো হয়েছিল গোল্ড অ্যাপোলো নামক একটি সংস্থাকে দিয়ে। যদিও তারা হিজবুল্লাহদের ব্যবহৃত এই পেজার তৈরির দাবিটি অস্বীকার করেছে। তাঁদের বক্তব্য, এই যন্ত্রগুলি আদপেও তাদের তৈরি হয়। সংস্থার প্রধান হু চিন-কুয়াং সাংবাদিক বৈঠক করে তেমনটাই জানিয়েছেন। তাইওয়ানের অর্থনীতি মন্ত্রণালয়ের তরফেও জানানো হয়েছে, তাইওয়ান থেকে লেবাননে সরাসরি পেজার রপ্তানির কোনো রেকর্ড নেই।এ বিষয়ে ইজরায়েলের তরফে কোনও সরকারি বিবৃতি সামনে আসেনি। যদিও নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে দাবি করা হচ্ছে, হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর কম্য়ান্ডারদের হাতে পেজার পৌঁছনোর আগেই ইজরায়েল তাতে কলকাঠি নেড়ে রেখেছিল। যে ইজরায়েলের নজরদারির হাত থেকে বাঁচতে মোবাইল ছেড়ে পেজারের দ্বারস্থ হয়েছিল হিজবুল্লাহরা, সেখানে আগে থেকেই যে বাসররাতে কালসাপ ঢুকিয়ে রেখেছে মোসাদ, তা কীভাবেই বা জানবে লেবাননের এই জঙ্গিগোষ্ঠী! নিউ ইয়র্ক টাইমসের দাবি, তাইওয়ানে যখন পেজারগুলি তৈরির বরাত দেওয়া হয়, সেসময়েই খেলা খেলে রেখেছিল মোসাদ সদস্যেরা। ঠিক ব্যাটারির পাশেই সঞ্চিত রাখা হয়েছিল ওই তিন গ্রাম করে বিস্ফোরক। ফলে লেবাননে পৌঁছনোর আগেই সম্ভাব্য এক-একটি বোমায় তৈরি হয়েছিল পেজারগুলি।

ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভালো নয় এ কথা ঠিকই, তবে এই মুহূর্তে তাদের সঙ্গে নতুন করে কোনও সংঘাতে জড়াতে চায় না আমেরিকা। এদিকে, ইজরায়েলের সঙ্গে আমেরিকার সদ্ভাবের কথা কারওরই অজানিত নয়। তবে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়ে ইজরায়েলকে সব সময়ই বাধা দিয়ে এসেছে আমেরিকা। ইজরায়েলের সঙ্গে সদ্ভাবের কারণে এই পেজার হামলার ঘটনায় আমেরিকার নাম জড়াতে পারে, তা বুঝতে পেরেই আগেভাগে সতর্ক বাইডেনের দেশ। কদিনের মধ্যেই সেখানে ভোট। আর তার ঠিক আগে নিজেদের ভাবমূর্তি পরিষ্কার রাখতেই বন্ধু দেশ ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থার আগেভাগেই এই হামলার দায় ঠেলে রেখেছে তারা। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার প্রত্যয় দিয়ে জানিয়েছেন, এই ঘটনার সঙ্গে আমেরিকা কোনও ভাবেই জড়িত নয়। এমন কিছু ঘটতে চলেছে, তার খবরও তাদের কাছে ছিল না।

কিছুদিন আগেই হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। তার পরেই ইজরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিল ইরান। দিন কয়েক আগেই মধ্য সিরিয়ার হামা প্রদেশে বিধ্বংসী হামলা চালিয়েছিল বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সেনা। সেই হামলার প্রত্যুত্তরও রকেটে রকেটে দেয় হিজবুল্লাহ। তার পরেই লেবাননে এই বিধ্বংসী পেজার হামলা। এই পরিস্থিতিতে ইরান যে ইজরায়েলকে উত্তর ফিরিয়ে দিতে ভয়াবহ কিছু করতে পারে, সেই আশঙ্কায় কাঁপছে গোটা বিশ্ব। আমেরিকা আগে থেকেই ইরানকে অনুরোধ করে রেখেছে, কোনও ভাবে যেন রাগের বশে অস্থিরতা না বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। হিজবুল্লাহ ও ইজরায়েলের মধ্যে কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানের পথ বাতলানোর কথাই বলেছেন মিলার।

এই পেজার হামলা যে দু'দেশের মধ্যে বিরাট একটি যুদ্ধের শুরুয়াৎ-বিন্দু হয়ে উঠতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমশ। যদিও গত সপ্তাহেই হিজবুল্লাহের উপপ্রধান নাইম কাসেম জানিয়েছিলেন, তাদের তরফে যুদ্ধে যাওয়ার তেমন কোনও ইচ্ছা নেই। তাতে দু'পক্ষেরই ক্ষতি। যদিও মেঘের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ হয়েই যুদ্ধ করতে বেশি পছন্দ করে লেবাননের এই জঙ্গিগোষ্ঠী। ইজরায়েলে একের পর এক রকেট হামলাই তার প্রমাণ।

এর আগেও মোসাদের তৎপরতায় লেবানন যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তাদের অপারেশন বালমাস সিক্স সেই যুদ্ধকে দিশা দেখিয়েছিল। ইরানে পূর্বেও একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে মোসাদ। ইরানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী ড. আরদেশির হোসেনপুরকে হত্যার নেপথ্যে ছিল তাদের হাত। এমনকী ইরানের বাহিনীর শীর্ষপদেও কৌশলে মোসাদের লোক ঢুকিয়ে রেখেছিল তারা। যে কিনা পরবর্তী কালে দেশের সহকারী প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদও পান। এমনই ধুরন্ধর তাদের নেটওয়ার্ক। এ হেন মোসাদের পক্ষে যে কোনও কাজই অসম্ভব নয়, তা এক কথায় মানবে ওয়াকিবহাল মহল। ফলে পেজার হামলার নেপথ্যেও যে সেই ধুরন্ধর নেটওয়ার্কের হাত থাকতে পারে, তা মেনেছে অনেকেই।

আরও পড়ুন:হামাসের কায়দায় ইজরায়েলে হামলা হিজবুল্লাহের, নতুন যুদ্ধের শঙ্কায় কাঁপছে বিশ্ব

সাম্প্রতিক এই হামলায় কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে লেবানন ও সিরিয়ার বড় অংশের জনজীবন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে হামলার একাধিক ভিডিও। দেখা গিয়েছে লেবাননের রাজধানী এবং তার সংলগ্ন এলাকার রাস্তায় পড়ে শয়ে শয়ে মানুষ। কারও হাত উড়েছে, কারও আবার পা। কেউ আবার চোট পেয়েছেন মাথায়। পরিজনদের খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটছেন মানুষ। সরকারি সূত্রে খবর, এই হামলায় হিজ়বুল্লার একাধিক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের তালিকায় রয়েছে এক কিশোরীও। এমনকী ইরানের রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত এই হামলায় আহত হয়েছেন বলে খবর। একদিকে হিজবুল্লাহ-ইজরায়েল সংঘাত, অন্যদিকে গাজায় ইজরায়েলের চালিয়ে যাওয়া যুদ্ধ, সব মিলিয়ে মধ্য এশিয়া তো বটেই, গোটা বিশ্বই এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতিতে এই পেজার হামলার ফলাফল কী হতে পারে ইজরায়েলের জন্য, নতুন কোনও বড়সড় হামলার শুরুয়াৎ হয়ে উঠতে পারে কিনা এই ঘটনা, তা নিয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছে গোটা দুনিয়ার।

More Articles