চিকিৎসকদের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে ঝোড়ো ইনিংস! চেনেন আইনজীবী করুণা নন্দীকে?
RG Kar Case at Supreme Court: আরজি কর কাণ্ডে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই মামলায় জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স ওয়েস্ট বেঙ্গলের হয়ে লড়ছেন করুণা।
আরজি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল বাংলা, তোলপাড় দেশেও। মঙ্গলবার সেই মামলার চতুর্থ শুনানি ছিল সুপ্রিম কোর্টে। স্বাভাবিক ভাবেই সেই মামলার দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা দেশ। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স ওয়েস্ট বেঙ্গলের হয়ে মামলা লড়েছেন আইনজীবী করুণা নন্দী। কার্যত তাঁর দৃঢ় এবং স্পষ্ট সওয়ালের সামনে কোণঠাসা হতে হয়েছে রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বলকে।
২০২৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনোনীত হন এই বাঙালি কন্যা। বাঙালি হলেও তাঁর জন্ম ভোপালে। তার পর বড় হয়ে ওঠা দিল্লিতেই। ফলে বাংলা ভালো বলতে পারেন না। কিন্তু যেটা দুর্দান্ত পারেন, সেটা আইনের লড়াই। আর সেটাই মঙ্গলবার করে দেখিয়েছেন করুণা। দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে পাশ করার পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়েন তিনি। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ল সোসাইটি জার্নালের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। পরে এলএলএম অর্জনের পরে নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মানবাধিকার ফেলোশিপও পান। তার পর দীর্ঘ দিন নিউ ইয়র্কে আইন প্র্যাকটিস করেছেন। ক্লিফোর্ড চান্সেরও গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে ছিলেন দীর্ঘদিন। তার পরে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন ৪৮ বছরের এই আইনজীবী।
আরও পড়ুন: নির্ভয়ার মাকে বলেন, ‘ধর্ষকদের ক্ষমা করে দিন’! জুনিয়র ডাক্তারদের হয়ে লড়া ইন্দিরা জয়সিং কে?
করুণার বাবা সমীরণ নন্দী পেশায় চিকিৎসক ও মেডিক্যাল অ্যাকাডেমিক। এইমস ঋষিকেশের সভাপতিও ছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৮৫ সালে পদ্মশ্রীও পান তিনি। মা সুস্মিতা নন্দী লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে পড়েছেন। উত্তর ভারতের স্প্যাস্টিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাও তাঁরই হাতে। একই সঙ্গে ব্রিটেন, আমেরিতা ও ভারত, তিনটি দেশেই আইন প্র্যাকটিস করার ছাড়পত্র রয়েছে করুণার কাছে। সম্ভবত এই মুহূ্র্তে ভারতে আর কোনও আইনজীবীর ওই লাইসেন্স রয়েছে কিনা সন্দেহ।
ভারতের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে করুণার নাম। ১৯৮৪ সালে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত মামলায় তাঁদের হয়ে লড়েন করুণা। ইউনিয়ন কার্বাইডের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ চাওয়া সারভাইভার গ্রুপ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে যাতে গণ্য করা হয়, সেই মামলাতেও নারী অধিকার সংস্থার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন করুণা। শুধু তাই নয়, কুইয়ার সম্প্রদায়ের অধিকারের মামলাতেও লড়তে দেখা গিয়েছে তাঁকে। নির্ভয়া কাণ্ডের পর ২০১৩ সালে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনে সংশোধন আনার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ চাওয়া হয়েছিল। সেই মামলায় বিচারপতি জে এস ভার্মা কমিটির তরফে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আইনজীবী করুণাকে। সেই বিলের খসড়া তৈরির ব্যাপারেও বিশেষ অবদান ছিল তাঁর। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের জন্য জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদেও কাজ করেছেন করুণা।
খাদ্যের মৌলিক অধিকার অনুযায়ী ১.২ বিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় দু-তৃতীয়াংশকে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য সরবারহের আইন স্বীকৃত হয় তাঁর হাত ধরেই। এমন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ মামলার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে আইনজীবী করুণা নন্দীর নাম। এবার তাঁর নাম জুড়েছে আরজি কর কাণ্ডের সঙ্গেও।
আরজি কর কাণ্ডে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই মামলায় জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স ওয়েস্ট বেঙ্গলের হয়ে লড়ছেন করুণা। মঙ্গলবার সুপ্রিম শুনানির প্রথমার্ধেই ঝোড়ো ব্যাটিং দেখা গিয়েছে করুণার। একদিকে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স ওয়েস্ট বেঙ্গলের পক্ষে ছিলেন তিনি, অন্যদিকে জুনিয়র ডাক্তারদের হয়ে লড়েন আর এক দাপুটে আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং। কার্যত তাঁদের ঝড়ের মুখে কপিল সিব্বলের মতো বরিষ্ঠ আইনজীবীকেও যেন একটি জড়োসড়ো লাগে। এদিন শুনানিতে করুণা জানান, জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে বলে বলা হয়েছে। এটা ঠিক নয়। সিনিয়র ডাক্তারেরা কাজ করছেন। একই সঙ্গে হাসপাতালের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি নিয়েও প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন করুণা। চিকিৎসকদের যৌথমঞ্চের আইনজীবী সাফ জানান, কাজে না ফেরার জন্য নিরাপত্তাহীনতাই মূল কারণ। নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারলে কাজে ফিরতে কোনও সমস্যা নেই তাঁদের। একই সঙ্গে সিভিক ভলিন্টিয়ারের মতো অস্থায়ী পদ দিয়ে হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ নিয়েও আপত্তি জানান তিনি। আরজি করে চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ও একজন সিভিক ভলিন্টিয়ার, সে কথাও উল্লেখ করতে ভোলেনি করুণা।
আরও পড়ুন:জুনিয়র ডাক্তারদের হয়ে মরিয়া লড়াই! সুপ্রিম কোর্টে সিব্বলকে যোগ্য জবাব ইন্দিরার
বরাবরই যে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে যে কোনও মামলায় শান্ত ভাবে সওয়াল-জবাব করার জন্যই বিখ্যাত করুণা। সহকর্মীরা বলেন, করুণার স্নায়ুর জোর উল্লেখ করার মতোই। কীভাবে যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে প্রতিপক্ষের জন্য লড়াইয়ের ময়দানকে আরও শক্ত করে দেওয়া যায়, এবং তা-ও একটুকু উত্তেজিত না হয়ে, তা আইনজীবীদের শেখার করুণার থেকে। কার্যত আরজি কর মামলা নিয়ে তেমনই এক শুনানির সাক্ষী ছিল সুপ্রিম কোর্ট। এই মামলার শুনানি যে আগামী দিনেও করুণা-ইন্দিরার মতো আইনজীবীদের হাত ধরে উল্লেখযোগ্য জায়গায় পৌঁছবে, তা আশাই করা যায়।