রাত দখল শুধু শহুরে মেয়েদের? আজও ডাইনি সন্দেহে খুন হওয়া মহিলাদের কথা বলবে কে?

Reclaim The Night Woman Movement: মানুষরা কি বীরভূমের ডাইনি সন্দেহে হত্যা হওয়া দুই মহিলার জন্যও লড়বেন? নাকি আন্দোলন শহুরে হয়েই থেকে যাবে?

একদিকে চলছে মেয়েদের রাতদখল। হাজারে হাজারে মহিলা পথে নামছেন নিরাপত্তার দাবিতে। সারারাত জেগে বিচার চাইছেন। স্লোগানে মাতিয়ে দিচ্ছেন পশ্চিমবাংলার আকাশ। আর সেই আকাশেরই নীচে, এই বাংলাতেই প্রান্তিক এলাকাগুলিতে নির্বিচারে চলছে ডাইনি হত্যা! হ্যাঁ, এখনও, এই ২০২৪-এও। আরজি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার টানা একমাস ধরে চলছে আন্দোলন। এই আন্দোলন শুধুই কলকাতায় আটকে নেই। শিলিগুড়ি থেকে শুরু করে আসানসোল, বীরভূম সর্বত্রই সাধারণ মানুষ পথে নেমেছেন। এই আন্দোলন যখন চলছে, বিচারের দাবিতে, নিরাপত্তার দাবিতে, ঠিক তখনই ডাইনি সন্দেহে দুই আদিবাসী মহিলাকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে বীরভূমের ময়ূরেশ্বর থানার হরিসরা গ্রামের আদিবাসী পাড়ায়। এই নির্যাতিতা, মৃতাদের হয়ে বিচার চাইবে কে?

আরজি করের আন্দোলন শুধু আর আরজি করে আটকে নেই। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা দুর্নীতি, প্রশাসনের গাফিলতি, সমস্ত ক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থা ও বিচারের নামে প্রহসন নিয়েই তো কথা বলছেন সাধারণ মানুষরা। কিন্তু কোথাকার সাধারণ মানুষ? সেই মানুষরা কি বীরভূমের ডাইনি সন্দেহে হত্যা হওয়া দুই মহিলার জন্যও লড়বেন? নাকি আন্দোলন শহুরে হয়েই থেকে যাবে? বীরভূমের ময়ূরেশ্বরে মারা যাওয়া ওই দুই আদিবাসী মহিলার নাম লোদগি কিস্কু এবং ডলি সোরেন। আরজি কর কাণ্ড নিয়ে বিচার চেয়ে আন্দোলন করছেন যারা তারা কি লোদগি আর ডলির বিচারও চাইবেন না? ১৪ সেপ্টেম্বর রাত দখলের সময় যখন বর্ধমানের শক্তিগড়ে প্রিয়াঙ্কা হাঁসদা নামের যুবতী শৌচকর্ম করতে বেরিয়ে নিহত হয়ে যান তাঁর হয়ে বিচার চাইবে কে?

আরও পড়ুন- মহিলাদের রাতের শিফটে কাজ নয়! কেন রাজ্যকে বিজ্ঞপ্তি মুছতে নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের?

বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের হরিসরা গ্রামের গ্রামবাসীদের অভিযোগ, ১৩ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার রাতে ওই দুই মহিলাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাঁদের খুন করে দেহ নালায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ জানিয়েছিল, গ্রামের সেচ নালা থেকে দুই মহিলার দেহ উদ্ধার হয়েছে। অভিযোগ, রাতে বাড়ি থেকে টেনে বার করা হয়েছিল দুই মহিলাকে, তারপর তাঁদের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক মারধর করে দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় নালার জলে। লোদগি কিস্কুর কন্যা রানি কিস্কু জানিয়েছেন, ডাইনি সন্দেহেই তাঁর মাকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করুক এই দাবি করেছেন তিনি, বলেছেন দোষীর কঠোরতম শাস্তি হোক। সত্যিই কি পুলিশ নিরাপত্তা দিতে পারবে বা দিতে চাইবে গ্রামীণ আদিবাসী পরিবারের কন্যাদের? প্রান্তিক অঞ্চলে আন্দোলন করবে কে?

গত শনিবারই ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। রবিবার আরও সাত জনকে ধরা হয়েছে। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন মহিলারাও। পুলিশ জানতে পেরেছে, কয়েকদিন আগে গ্রামেরই কয়েকজন ওই দুই মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দেয়। তখনও তাঁদের মারধর করা হয়েছিল। পুলিশে না যাওয়ার জন্য শাসানোও হয়। তাহলে গ্রামের পরিসরে এই মহিলাদের নিরাপত্তা দেবে কে? কেই বা পথে নামবেন লোদগি, ডলি বা প্রিয়াঙ্কাদের হয়ে? তাহলে রাজ্যজুড়ে যে নিরাপত্তার দাবির স্লোগান উঠছে এই স্লোগানে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষদের ঠাঁই নেই? ঠাঁই কেবল, মাথায় ছাদওয়ালা কর্মক্ষেত্রের অন্দরে নিরাপত্তার দাবির? ইটভাটার মহিলা শ্রমিকদের বাঁচাবে কে? নিরাপত্তার স্লোগান কেবল মেট্রো, বাস, অ্যাপ ক্যাবে সওয়ার হওয়া মহিলাদের জন্য? দীর্ঘ অন্ধকার পথ হেঁটে টিউশন যাওয়া গ্রামীণ কিশোরীর নিরাপত্তা নিয়ে কে প্রশ্ন তুলবে?

আরও পড়ুন- ফুটপাতের মেয়েটির জন্যেও আমরা গলা ফাটাবো কবে?

আরজি কর কাণ্ডের প্রেক্ষিতে মেয়েদের রাত দখল সহ অন্যান্য কর্মসূচির পুরোভাগে রয়েছেন শতাব্দী দাস। তিনি অবশ্য বলছেন, “কোনও নারীবাদী আন্দোলন হলেই সেটাকে শহরকেন্দ্রিক বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবৃত্তি মানুষের থাকে। শুধু কলকাতা শহরে ১৪ তারিখ তো মেয়েরা নামেনি। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করছেন প্রায় ১৫০ জায়গার মেয়েরা। তারা সকলেই শহরের নন। বীরভূম, মেদিনীপুর, বর্ধমানের বহু অংশের মেয়েরাই সেখানে আছেন। আন্দোলন ব্যাপক আকার নিয়েছে বলে মানুষের প্রত্যাশাও আকাশছোঁয়া হয়েছে। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে আন্দোলনের বয়স সবে একমাস। এখনও বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের কাজ চলছে। এটার দীর্ঘস্থায়ী ফল পেতে দীর্ঘ সময়ই লাগবে। লিঙ্গন্যায়ের উপর ভিত্তি করে শহরের সঙ্গে গ্রামের সমন্বয় সাধনের কাজটা শুরু হয়ে গিয়েছে।" সমাজকর্মী শতাব্দী জানাচ্ছেন, বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চল, যেখান থেকে এই ধরনের খবর উঠে আসছে সেখানে 'ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম' পাঠানোর চেষ্টাও করছেন তারা। ১৪ অগাস্ট রাত্রে শক্তিগড়ে যে আদিবাসী যুবতীর খুন হয়, সেই অঞ্চলে একটি দল গিয়েছিল। বীরভূমেও পাঠানো যায় কিনা তা তারা দেখছেন। তবে তাতে সময় তো লাগবেই।

তাহলে আরজি কর কাণ্ড নিয়ে মূল আন্দোলন কি এই মহিলাদের ব্যাতিরেকেই? শতাব্দী জানাচ্ছেন, সমস্ত নির্যাতিতার কথাই ধীরে ধীরে উঠে আসছে। রাতের সভা বা রাতের বৈঠক বলে একটি বিষয় তারা চালু করতে চলেছেন যা বিভিন্ন জেলায় হবে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে হবে, একেবারেই কলকাতা কেন্দ্রিক হবে না। "মেয়েদের সুরক্ষিত গণ পরিসর বা সুরক্ষিত কর্মজগতে কী কী চাই, সেই দাবিদাওয়া তো শহরে বসে আমরা ঠিক করতে পারি না। ধরা যাক, শক্তিগড়ের প্রিয়াঙ্কা হাঁসদা। তাঁর তো বাড়িতে শৌচালয় অবধি নেই। সেটা তো তাঁর মূল চাহিদা ছিল। এই চাহিদা তো আমি কলকাতায় বসে বলতে পারব না। ফলে সেই দাবি যাতে তাঁদের থেকেই উঠে আসে এই চেষ্টাই করছি আমরা," বলছেন শতাব্দী।

মেয়েদের রাত দখলের ডাক প্রথম দিয়েছিলেন রিমঝিম সিনহা। রিমঝিম বলছেন, "প্রথম থেকেই বহু গ্রাম-মফসসলের মহিলারা যোগাযোগ করেছেন এবং এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এমন বহু মহিলার থেকে আমি ফোন পেয়েছি যারা বলেছেন রাত এগারোটার পর যাতায়াতের কিছু পাবেন না তাই তারা রাত ৯ টা থেকে ১১ টা পথে নামবেন। আমার মাকে যিনি অসুস্থতার কারণে দেখাশোনা করেন তিনিও জানান, তাঁর পাড়ার জমায়েতে যাচ্ছেন তিনি। আমরা এই মুহূর্তে প্রায় ১০০জন কো-অর্ডিনেটরের সঙ্গে কথা বলছি যারা বাঁকুড়া পুরুলিয়ার গ্রামের বাসিন্দা। সেখান থেকে তারা যে ধরনের দাবির কথা তুলে ধরছেন সেই দাবিও যাতে প্রকাশ্যে আনা যায় আমরা চেষ্টা করছি।" রিমঝিমের মতে, এই আন্দোলন আসলে প্রত্যেক পেশার সঙ্গে জড়িত মহিলাদের সুরক্ষার, স্বাধীনতার আন্দোলন। ডাক্তারি বা কর্পোরেট পেশার সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের কথাই কেবল এই আন্দোলনে বলা হচ্ছে না। শুরু শহুরে মহিলাদের দাবি নয় গৃহশ্রমিকদের কথাও বলা হবে, চা-বাগানের মহিলা শ্রমিকদের কথা, মহিলা শ্রমিকদের শৌচাগারের কথা তুলে আনবে এই আন্দোলন। 

More Articles