পুলিশ কমিশনার পদ থেকে সরলেন বিনীত! কেন মনোজেই আস্থা রাজ্য সরকারের?

Kolkata Police Commissioner: মঙ্গলবার সেই মতোই কমিশনার পদ থেকে সরানো হল বিনীতকে। বদলে কমিশনার পদে এলেন মনোজ ভর্মা। ১৯৯৮ ব্যাচের আইপিএস অফিসার মনোজ।

অবশেষে পূরণ হল জুনিয়র ডাক্তারদের অন্তত একটি দাবি। কলকাতা পুলিশের কমিশনার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল বিনীত গোয়েলকে। আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে প্রায় ৩৯ দিন ধরে কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। প্রায় দু'সপ্তাহ ধরে স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধর্নামঞ্চে আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন তাঁরা নির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল কলকাতা পুলিশের সিপি বিনীত গোয়েল, স্বাস্থ্য অধিকর্তা ও সচিবের অপসারণ। সোমবার রাতে পাঁচ বারের চেষ্টায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অবশেষে বৈঠকে বসে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর তরফে আশ্বাস মিলেছিল তাঁদের কয়েকটি দাবি পূরণের। সেই দাবি মেনেই মঙ্গলবার সরিয়ে দেওয়া হল কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। তাঁর জায়গায় কমিশনার পদে আনা হল মনোজ ভর্মাকে। যিনি এতদিন এডিজি আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে ছিলেন। শুধু পুলিশ কমিশনারই নয়, কলকাতা পুলিশের আরও কয়েকটি পদে রদবদলের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে রাজ্যপ্রশাসনের তরফে।

কলকাতা পুলিশের ডিসি (উত্তর) অভিষেক গুপ্তকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইএফআর-এর সেকেন্ড ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার পদে। তাঁর জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে দীপক সরকারকে। তিনি শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (পূর্ব) ছিলেন। অন্য দিকে, কলকাতা পুলিশ কমিশনার পদে বসানো হয়েছে মনোজ বর্মাকে। তিনি ছিলেন রাজ্যের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা)। তাঁর জায়গায় নতুন এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) হচ্ছেন জাভেদ শামিম। শামিম এত দিন ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা বিভাগ (আইবি)-এর এডিজি। ওই পদে বসানো হল জ্ঞানবন্ত সিংহকে। তিনি এত দিন ছিলেন ডিরেক্টরেট অফ ইকোনমিক অফেন্সেস-এর ডিরেক্টর। বিনীত এখন নিযুক্ত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএএফ)-এর এডিজি পদে। ওই পদে ছিলেন ত্রিপুরারি অথর্ব। তাঁকে ডিরেক্টরেট অফ ইকোনমিক অফেন্সেস-এর ডিরেক্টর পদে বসানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: বিনীত গোয়েল, স্বাস্থ্য অধিকর্তা অপসারিত! জুনিয়র ডাক্তারদের জয় না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের?

এদিকে বিনীত কুমার গোয়েলকে কমিশনার অব পুলিশ পদ থেকে সরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএএফ)-এর এডিজির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর আগে কমিশনার পদ থেকে বিনীতকে সরানোর দাবি নিয়ে লালবাজার অভিযান করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সেখানে গিয়ে প্রাক্তন কমিশনার বিনীতের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই সঙ্গে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রতীকি মেরুদণ্ড। এই আবহে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সিপি অনেক বার এসেছিলেন পদত্যাগ করার জন্য। কিন্তু তিনি তা করতে দেননি। সম্প্রতি বিনীত গোয়েলের অপসারণ-সহ একাধিক দাবি নিয়ে স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধর্নায় বসেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। চলতে থাকে তাঁদের কর্মবিরতি। এর মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের তরফে তাঁদের কাজে ফেরার অনুরোধ করা হয়। বহুবার অনুরোধ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কিন্তু দাবিপূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে সরানো যায়নি চিকিৎসকদের। এরই মধ্যে একাধিক বার ব্যর্থ হয় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে চিকিৎসকদের বৈঠক। শেষপর্যন্ত সোমবার রাতে মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাসভবনে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে দেখা হয় মমতার। সেদিনই তাঁদের কমিশনার বদলের দাবিতে সম্মত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

মঙ্গলবার সেই মতোই কমিশনার পদ থেকে সরানো হল বিনীতকে। বদলে কমিশনার পদে এলেন মনোজ ভর্মা। ১৯৯৮ ব্যাচের আইপিএস অফিসার মনোজ। এতদিন রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) পদ সামলেছেন তিনি। আগে সামলেছেন কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের দায়িত্বও। কলকাতা পুলিশে ডিসি ডিডি (স্পেশাল), ডিসি (ট্র্যাফিক) পদেও ছিলেন তিনি আগে। মঙ্গলবার বিকেলে নবান্ন জানিয়েছে, মনোজকেই কলকাতার নতুন পুলিশ কমিশনার করা হল। আলোচনায় অবশ্য উঠে এসেছিল বেশ কয়েক জন আইপিএস অফিসারের নামই। তবে শেষ পর্যন্ত মনোজেই সিলমোহর দিয়েছে নবান্ন।

১৯৬৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্থানের সওয়াই মাধোপুরে জন্ম মনোজ বর্মার। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করা মনোজ ২০১৯ পর্যন্ত দার্জিলিঙের আইজি পদে ছিলেন। তার পরে তাঁকে নিয়ে আসা হয় ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের দায়িত্বে। ভাটপাড়া এবং কাঁকিনাড়ায় গোলমালের সময় তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের সিপি করা হয় সেই সময়। একটা সময়ে তিনি উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ব্যারাকপুর) ছিলেন। তখনও পুলিশ জেলা ভাগ হয়ে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট হয়নি। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন রাজ্য রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। তখনও রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার। সেই সময়ে জঙ্গলমহল জুড়ে মাওবাদীদের কার্যকলাপ তুঙ্গে। মনোজ সেই কার্যকলাপ রুখতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেছিলেন। ‘কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স’-এর দায়িত্বেও ছিলেন মনোজ। এর পর ডিআইজি পদমর্যাদায় উন্নীত হয়ে মনোজ চলে যান শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটে। তার পর দার্জিলিঙের আইজি। সেটা ২০১৭ সাল। পাহাড়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সেই সময়ের আন্দোলনও মনোজ সামলেছিলেন দক্ষতার সঙ্গে।

২০১৯ সালে উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের প্রধান করে মনোজকে পাঠায় রাজ্যসরকার। সিপি হিসাবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উত্তপ্ত ব্যারাকপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন মনোজ। ব্যারাকপুরে থাকাকালীন একধিক বার তাঁকে জরুরি পরিস্থিতিতে ‘অ্যাকশনে’ নামতে দেখা যায়। এক বার ভাটপাড়ায় গোলমালের সময়ে হেলমেট না পরেই গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিলেন। হাত দিয়েই ইট-পাটকেল আটকানোর চেষ্টা করেন মনোজ। সেই সময় বাহিনী এবং নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা না করে খালি হাতে অ্যাকশনে নামার জন্য তাঁর ভূমিকা কিছুটা সমালোচিতও হয়। তবে মনোজ সে সবকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি কখনও। মনোজ দুর্নীতি দমন শাখার এডিজি-ও ছিলেন। ২০১৭ সালে রাজ্য সরকারের তরফে পুলিশ পদকও পেয়েছিলেন মনোজ। পরে ২০১৯ সালে পেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ পদক। ওই বছর স্বাধীনতা দিবসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁকে ওই পদক দেন। ভাটপাড়ায় শান্তি ও স্বাভাবিকতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই মনোজকে ওই পদক দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন:দু’দফা দাবি নিয়ে আপস নয়, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগেই স্পষ্ট বার্তা জুনিয়র ডাক্তারদের

সন্দেশখালি কাণ্ডেও মনোজের ভূমিকা ছিল রাজ্য সরকারের কাছে বিশেষ প্রশংসনীয়। সেই আস্থাবান মনোজেই এবার কলকাতার ভার তুলে দিলেন মমতা। আরজি কর কাণ্ডকে ঘিরে ঘরে বাইরে যে বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে তৃণমূল, এবং পুলিশমন্ত্রী হিসেবে যার দায় বর্তেছে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর উপরেই, সেই পরিস্থিতি থেকে রাজ্য সরকারকে উদ্ধার করতে পারবে নয়া সিপি মনোজ। আপাতত তো তাঁর উপরেই ভরসা রাখতে চাইছে বাংলার সরকার।

 

More Articles