সেনার হাতে বড় ক্ষমতা দিল ইউনূস সরকার! কী কী করতে পারে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী?
Bangladesh Army Executive Magistrate: কী এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতা? এতে সেনাবাহিনী কোন বিশেষ ক্ষমতা পেতে চলেছে?
সারা বাংলাদেশজুড়ে এখন বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করতে চলেছে সেনাবাহিনী। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়েছে সরকার। আগামী দুই মাস অর্থাৎ ৬০ দিন এই সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে বলে অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে। সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট যে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন দেশের আইন নিয়ে সেই সিদ্ধান্ত অনেকাংশেই নিতে পারবে সেনা।
উল্লেখ্য, গত জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। হাসিনার তৎকালীন সরকার সেই আন্দোলন দমাতে নির্বিচারে নিপীড়ন চালায়। আন্দোলনের আঁচ এতটাই বেড়ে যায় যে শেষ অবধি পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে হয় শেখ হাসিনাকে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর ঠিক তিন দিনের মাথায় ৮ অগাস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় বাংলাদেশে।
এখনও কিন্তু সারা বাংলাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। সেদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানা আলোচনাও জারি রয়েছে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিল অন্তর্বর্তী সরকার। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। কিন্তু কী এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতা? এতে সেনাবাহিনী কোন বিশেষ ক্ষমতা পেতে চলেছে?
আরও পড়ুন- বাংলাদেশের রদবদল কি আদানিদের বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সুখবর?
বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ৬৪, ৬৫, ৮৩, ৮৪, ৮৬, ৯৫ (২), ১০০, ১০৫, ১০৭, ১০৯, ১১০, ১২৬, ১২৭, ১২৮, ১৩০, ১৩৩ ও ১৪২ ধারার অধীনে যে সমস্ত অপরাধগুলো ঘটে, এবার সেগুলি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন সেনাবাহিনীর বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা পাওয়া কর্মকর্তারা। এর ফলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কোনও অপরাধ সংঘটিত হলে তাঁরাই অপরাধীকে গ্রেফতার করতে বা গ্রেফতার করার নির্দেশ দিতে পারবেন। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা উল্লিখিত ধারা অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যবস্থাও নিতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে সেনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে গুলিও চালাতে পারে। বাংলাদেশের আইনানুসারে একজন ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে যে কোনও স্থানে আদালত বসাতে পারেন এবং বিচার করতে পারেন। সেনাও এবার সেই ভূমিকা নিতে পারে।
উপরোক্ত আইনের ধারা অনুযায়ী একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যা যা করতে পারেন—
ধারা ৬৪ : ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা বা গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া এবং হেফাজতে রাখার ক্ষমতা।
ধারা ৬৫ : গ্রেফতার করার ক্ষমতা বা তাঁর উপস্থিতিতে গ্রেফতারের নির্দেশনা, যার জন্য তিনি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন।
ধারা ৮৩ ও ৮৪: ওয়ারেন্ট অনুমোদন করার ক্ষমতা বা ওয়ারেন্টের অধীনে গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপসারণের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা।
ধারা ৯৫(২): নথিপত্র ইত্যাদির জন্য ডাক ও টেলিগ্রাফ কর্তৃপক্ষের দ্বারা অনুসন্ধান এবং আটক করার ক্ষমতা।
ধারা ১০০ : ভুলভাবে বন্দি ব্যক্তিদের হাজির করার জন্য অনুসন্ধান-ওয়ারেন্ট জারি করার ক্ষমতা।
ধারা ১০৫ : সরাসরি তল্লাশি করার ক্ষমতা। তাঁর (ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি) উপস্থিতিতে যে কোনও স্থানে অনুসন্ধানের জন্য তিনি সার্চ ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন।
ধারা ১০৭ : শান্তি বজায় রাখার জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা।
ধারা ১০৯ : ভবঘুরে ও সন্দেহভাজন ব্যক্তির ভালো আচরণের জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা।
ধারা ১১০ : ভালো আচরণের জন্য নিরাপত্তা প্রয়োজনীয় ক্ষমতা।
ধারা ১২৬ : জামিনের নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা।
ধারা ১২৭ : বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার আদেশদানের ক্ষমতা।
ধারা ১২৮ : বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য বেসামরিক শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা।
ধারা ১৩০ : বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা।
ধারা ১৩৩ : স্থানীয় উপদ্রবে ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবস্থা হিসেবে আদেশ জারি করার ক্ষমতা।
ধারা ১৪২ : জনসাধারণের উপদ্রবের ক্ষেত্রে অবিলম্বে ব্যবস্থা হিসেবে আদেশ জারি করার ক্ষমতা।
এসব ক্ষমতা ছাড়াও, যেকোনও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর অধীনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার জন্য সরকার এবং সেই সঙ্গে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা সংশ্লিষ্ট এখতিয়ারের মধ্যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই আইনের অধীনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর উপস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধ বা ঘটনাস্থলে তাঁর বা তাঁর সামনে উন্মোচিত হওয়া অপরাধগুলো বিবেচনায় নিতে পারেন। অভিযুক্তের স্বীকারোক্তির পর ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট আইন অনুযায়ী অপরাধীকে সাজা দিতে পারেন, তবে কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে দুই বছরের বেশি নয়।
কিন্তু বাংলাদেশে তো আইন সামলানর জন্য পুলিশ আছেই, তাহলে কেন সেনাকে এই বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হলো? অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সেদেশের দৈনিক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে কিছু কিছু এলাকায় নাশকতা ঘটছে। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলগুলিতে নাশকতার পরিকল্পনা চলছে আর দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে নানা কর্মকাণ্ড ঘটছে। বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের নজরে এসেছে। তাই এই পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনীকেই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে তা সীমিত সময়ের জন্যই। পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেনাবাহিনীকে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন- ধর্ম বা রাজনীতি দিয়ে কোনও বাংলাদেশির সঙ্গে বৈষম্য হবে না! ইউনূসের আপ্তবাক্য ফলবে?
বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে ওয়াকিবহাল মহল বলছে, হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে আইন ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে গেছে। ইউনূস সরকার স্থিতাবস্থা নিয়ে আসার চেষ্টা করলেও সাধারণ মানুষ আস্থা দেখাতে পারছেন না। নানা অংশে সাম্প্রদায়িক হিংসা ঘটছে। সর্বোপরি, বাংলাদেশের পুলিশের প্রতি কোনও আস্থা নেই সাধারণ মানুষের। যেহেতু হাসিনা সরকারের অনুগত ছিল এই পুলিশ এবং হাসিনা সরকার বেছে বেছে পুলিশে নিয়োগ করেছেন তাই সেই একই পুলিশের প্রতি আস্থা থাকছে না মানুষের। এমতাবস্থায় সেনাকে এই ক্ষমতা সরকারকেই দিতে হতো। নাহলে সেনা কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তা আইন বিরুদ্ধ হয়ে যেত। ভবিষ্যতে সেনার বিরুদ্ধে মামলা করা যেত।
হাসিনা সরকার পতনের পর বাংলাদেশে বিভিন্ন থানা লুঠ হয়েছে। অস্ত্র লুঠ হয়েছে। সেই অস্ত্র কিন্তু এখনও উদ্ধার হয়নি। কাদের হাতে ওই অস্ত্র গেল, কারা কীভাবে সেই অস্ত্র ব্যবহার করছে কোনও হদিশ নেই। সামনে পুজো। সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে হানাহানির আশঙ্কাও অমূলক না। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের মনে আস্থা ফেরানো দরকার। ইউনূস সরকার তাতে কিঞ্চিৎ ব্যর্থ হচ্ছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাই সেনাকে এমন গুরুভার অর্পণ করতেই হলো।