খরচে কমানোই একমাত্র লক্ষ্য? ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ নীতির নেপথ্যে কোন পরিকল্পনা বিজেপির?

One Nation One Election: বিজেপি 'এক দেশ-এক নির্বাচন'-এর নামে 'এক দলীয় ব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে না তো? রাজ্যে রাজ্যে ডবল ইঞ্জিন সরকার আনাই কি শাসক দলের প্রধান লক্ষ্য?

যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করতে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটি গড়েছিল সরকার পক্ষ। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে সেই কমিটি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে ৮ খন্ডে বিভক্ত ১৮ হাজার পাতার রিপোর্ট পেশ করে। গত বুধবার রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। আগামী সংসদ অধিবেশনেই পেশ করা হতে পারে বিল। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই ব্যবস্থা চালু করা নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন। বিরোধীরা এতে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। গত বছর অগস্টে, জি-২০ সম্মেলনের কিছু দিন আগেই সরকার পক্ষ সংসদের বিশেষ অধিবেশনের কথা জানায়। তখন ঘোষণা করে দেওয়া হয় 'এক দেশ-এক নির্বাচন'-এর কথা। প্রধানমন্ত্রী নিজে দাবি করছেন, যুক্ত নির্বাচন কার্যকর হলে নাকি গণতন্ত্র প্রাণবন্ত হবে। পাশাপাশি ভোটের বিপুল খরচেও রাশ টানা যাবে। আরও দাবি করা হয়েছে, বার বার নির্বাচন নাকি উন্নয়নে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই ব্যবস্থা চালু হলে কি সত্যি নির্বাচনের বিপুল খরচ থেকে রেহাই মিলবে? স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র ব্যবস্থা টিকে থাকবে? এই ভোট ব্যবস্থাকে বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: মোদি-মন্ত্রিসভার সিলমোহর, ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করতে কেন এত মরিয়া বিজেপি সরকার?

১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভারতে 'এক দেশ-এক নির্বাচন' ছিলই। ভারতের স্বাধীনতার ১০ বছর পর কেরলেই প্রথম অ-কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। দেখা গিয়েছে, ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কেরল বাদে দেশের সব রাজ্যেই কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় ছিল। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, সে সময় ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর আজকের ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তফাৎ কোথায়? বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, স্বাধীনতার সময় আঞ্চলিক দলগুলি থাকলেও, আজকের মতো তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। বর্তমান ভারতে প্রায় অনেক রাজ্যেই আঞ্চলিক দল ক্ষমতায় রয়েছে। ১৯৬৭ সালের পর এই আঞ্চলিক দলগুলি ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বদল এনেছে। যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হলে আঞ্চলিক দলগুলির ক্ষমতা ক্রমশ কমে যাবে। পর্যবেক্ষকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, বড় দলগুলির চোখ ধাঁধানো প্রচার এবং সামাজিক মাধ্যমের প্রচারের ঠেলায় হারিয়ে যাবে আঞ্চলিক দলগুলি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলি কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলোর জন্য লড়াই করে। এ জন্যই এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিরোধী।

'এক দেশ, এক নির্বাচন' করার ক্ষেত্রে বিজেপির প্রধান যুক্তি হল - নির্বাচনী প্রচারে বিপুল অর্থের খরচ থেকে রক্ষা। কিন্তু গুগল অ্যাডস ট্রান্সপারেন্সি সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ১ জানুয়ারি থেকে ১০ এপ্রিলের মধ্যে অনলাইন নির্বাচনী প্রচারে মোট ১১৭ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজনৈতিক দলগুলি। তাঁর মধ্যে বিজেপি খরচ করেছে তিনভাগের একভাগ। যা প্রায় ৩৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস খরচ করেছে ৭.৫৬ কোটি টাকা। প্রশ্ন উঠছে, বিজেপি সত্যি যদি নির্বাচনী খরচ নিয়ে সচেতন হত, তাহলে কি এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করত? বলে রাখা ভাল, যেই নির্বাচনে বিজেপি 'এক দেশ - এক নির্বাচন' - এর কথা প্রচার করেছে, সেই নির্বাচনী প্রচারেই আবার জলের মতো টাকাও খরচ করেছে।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলি সব মিলিয়ে খরচ করেছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, ৬০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪৫ শতাংশই খরচ করেছিল শাসকদল বিজেপি। বিজেপির 'ইলেক্টোরাল বন্ড' দুর্নীতির তথ্য সামনে আসার পর চোখ কপালে উঠেছিল সাধারণ মানুষের। ইলেক্টোরাল বন্ডে বিজেপি একাই পেয়েছিল ৮,২৫২ কোটি টাকা , যা পুরো অনুদানের ৫৭ শতাংশ। প্রশ্ন উঠেছিল, এত টাকার অনুদান. তা-ও আবার একটি মাত্র দলকে কেন? অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন-এর স্বামী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ পরাকলা প্রভাকর বলেছিলেন, 'এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি।' প্রশ্ন উঠছিল, বিজেপি সরকার কি তবে নিজেদেরই চালু করা ইলেক্টোরাল বন্ড ব্যবস্থা তুলে দেবে? ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেখে গেছে তাদের নির্বাচনী প্রচারের বিপুল খরচের সঙ্গে কোনও দল টেক্কা দিতে পারেনি। মিটিং, মিছিল, পোস্টার, ব্যানার, হোডিং, কাটআউট, প্রচার ভ্যানে হিসেবের বাইরে খরচ করে গেরুয়া শিবির।

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনী আবহেই বিদেশের সংবাদমাধ্যমগুলিতে প্রায় ৫০টি প্রতিবেদন নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে প্রকাশ করা হয়েছিল। বিরোধীরা বারবার অভিযোগ তুলেছে, ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীকে অনিয়ম করে বহু সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। ঝাঁসির সভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধি বলেছিলেন, "নরেন্দ্র মোদি তাঁর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের ১৬ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মুকুব করেছেন, যা কি না গত ১৪ বছরের 'মনরেগা'-র বরাদ্দ করা টাকার সমান।" প্রশ্ন উঠছে, এই সকল আর্থিক লেনদেনে কি রাশ টানতে আদৌ প্রস্তুত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি?

আরও পড়ুন: প্রশ্ন তুলছে সুরাট-ইন্দোর, এক দেশ এক ভোট এলে ভোটাধিকার থাকবে আদৌ?

বিজেপি 'এক দেশ-এক নির্বাচন'-এর নামে 'এক দলীয় ব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে না তো? রাজ্যে রাজ্যে ডবল ইঞ্জিন সরকার আনাই কি শাসক দলের প্রধান লক্ষ্য? এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগে-পিছু না ভেবেই অতি দ্রুততার সঙ্গে জিএসটি এবং বিমুদ্রাকরণ করেছিলেন। পরবর্তীতে দেখা গিয়েছে, এই দুটি সিদ্ধান্তেই লাভবান হওয়া তো দূর, বরঞ্চ নানাভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে ভারতবাসী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিএসটি-র ফলে রাজ্য সরকারগুলিকে যেমন অথর্ব করা হয়েছে, অন্যদিকে বিমুদ্রাকরণে চূড়ান্ত ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের। মনে রাখতে হবে, প্রতিবারই মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রকে অবহেলা করার ট্রেন্ড শুরু করেছে। এ বার নির্বাচনী প্রচারে মোদির মূল বক্তব্য ছিল - সংবিধান পরিবর্তন, হিন্দুরাষ্ট্র গঠন এবং 'এক দেশ, এক ভোট'-এর বাস্তবায়ন। অযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের বিলোপ, তিন তালাক নিষিদ্ধ করে পদ্মশিবির তিনটি মৌলিক ক্ষেত্র কার্যকর করে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক সূচনা করে ফেলেছে। এবার হাতে কলমে হিন্দুরাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতেই এই 'এক দেশ-এক নির্বাচন' ব্যবস্থা নয়তো, প্রশ্ন ওঠে বইকি।

 

More Articles