মেইতেই-কুকি হিংসার আড়ালে খোদ মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী? কী বলছে বিস্ফোরক অডিও ক্লিপ?
Manipur Tapes Biren Singh: ওই রেকর্ডিংটিতে মুখ্যমন্ত্রী বীরেনকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে উপহাস করতে শোনা যায়। রাজ্যে 'বোমা' ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করছেন তিনি।
নতুন করে অশান্ত হয়েছে মণিপুর। আবারও মেইতেই আর কুকিদের নিয়েই তুলকালাম। এবার এই অশান্তির নেপথ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে একটি অডিও টেপ। দ্য ওয়্যার সম্প্রতি কিছু অডিও টেপ তদন্ত কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে। যদি এই অডিও টেপ সত্য হয় তাহলে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়ে যাবে, মণিপুরে যা হিংসা তা ঘটেছে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশেই! ওই অডিওতে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিংয়ের গলা শোনা গেছে। যদিও ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সরকার দাবি করেছে, এই অডিওগুলি 'এডিটেড'। কুকি এবং মেইতেইদের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার চেষ্টাতেই নাকি এমন ভুয়ো অডিও ছড়ানো হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর ভাই, রাজেন্দ্রো নংথিংবাম এবং ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্যসভার সদস্য এল. সানাজাওবা ফেসবুকে হুমকিও দিয়েছেন। তারা বলছেন, মেইতেইরাই 'শত্রু'-দেরকে অডিও টেপগুলি পাঠিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, সানাজাওবা হচ্ছেন আরামবাই টেঙ্গোলের প্রতিষ্ঠাতা। এটি একটি বিতর্কিত এবং উগ্র মেইতেই গোষ্ঠী। সানাজাওবা এবং নংথিংবামের দাবি, মেইতেইরা বিক্রি হয়ে গেছে। তাঁদের নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকরা লুকিয়ে রয়েছে।
গত ২২ অগাস্ট সানাজাওবা ফেসবুক লেখেন,
“মেইতেইরা নিজেদের নেতাকেও চেনে না… আমি কথা বলতে চাই না, তাতে সমস্যা বাড়বে, কাজে করে দেখাব… শত্রুরা গৌণ, মেইতেই বিশ্বাসঘাতকদের (খেলেন্দ্রো) আগে সামলাতে হবে...আর কথা বলতে চাই না...”
বিজেপির নেতা সানজাওবা 'খেলেন্দ্রো' শব্দটি 'বিশ্বাসঘাতক' অর্থে ব্যবহার করেছেন। খেলেন্দ্রো আসলে একজনের নাম। সুবেদার খোনথৌজাম খেলেন্দ্রো সিং ছিলেন একজন মেইতেই এবং একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা। ১৮৯১ সালের অ্যাংলো-মণিপুর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা এই খেলেন্দ্রোর মদতেই বিখ্যাত মেইতেই রাজকুমার টিকেন্দ্রজিৎ সিংকে গ্রেফতার করে। পরে ইম্ফলে টিকেন্দ্রজিৎকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অসমের শিলচরে খেলেন্দ্রোর নামে একটি রাস্তা রয়েছে। খেলেন্দ্রোই প্রথম মেইতেই অফিসার হিসেবে নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় গান স্যালুট পেয়েছিলেন। কমিশনে সাক্ষ্যদাতাতের সানজাওবা এই খেলেন্দ্রর সঙ্গেই তুলনা করেছেন।
সানাজাওবা যে আরামবাই টেঙ্গোল গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন সেটি একটি র্যাডিক্যাল মেইতেই গোষ্ঠী। গতবারের মেইতেই-কুকি জাতিগত সংঘাতের সময় পুলিশের গাড়িতে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। উপত্যকার জেলাগুলিতে কুকিদের পাশাপাশি মেইতেই নাগরিক এবং পুলিশ কর্মীদের উপর আক্রমণ করার অভিযোগও রয়েছে এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। মেইতেই হয়েও যারা আরামবাই টেঙ্গোলের কাজের সঙ্গে একমত নন, তাঁদেরই নিশানা করে এই গোষ্ঠী। খোদ মুখ্যমন্ত্রীই সানাজাওবার ঘনিষ্ঠ। আরামবাই টেঙ্গোলের সদস্যদের সঙ্গে বহুবারই দেখা গেছে তাঁকে।
মুখ্যমন্ত্রীর ভাই রাজেন্দ্রো নংথিংবাম (রাজেন্দ্রো নং) প্রথমে নিজের ফেসবুক পেজে লেখেন,
"যারা শত্রুদের খবর দিচ্ছেন, আপনারা মেইতেই। আপনারা যেন মনে করবেন না যে, আমরা আপনাদের মতো বিশ্বাসঘাতকদের মুখোশ খুলে দেব না।" তারপর তিনি আবারও লেখেন, "আমাদের মেইতেই বিশ্বাসঘাতকদের খুঁজে বের করতে হবে যারা আমাদের বিক্রি করে দিয়েছে।"
আরও পড়ুন- মণিপুরের বুকে এখনও জমাট চাপ চাপ অন্ধকার
এই হুমকিগুলি দেখে একটি বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে, অডিও টেপগুলিতে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে এবং বীরেন সিং সরকার যেমনটা দাবি করছে যে এগুলি 'এডিটেড', তা আসলে সত্য নয়। কিন্তু ওই অডিওতে কী এমন বিস্ফোরক তথ্য রয়েছে? দ্য ওয়্যারের প্রকাশিত ৪৮ মিনিটের অডিও টেপে মণিপুরের হিংসা বিষয়ে যে ব্যক্তিকে কথা বলতে শোনা যাচ্ছে তিনি বীরেন সিং কিনা তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ না করতে পারলেও অডিওর তারিখ এবং বিষয়বস্তু নিশ্চিত করা গেছে। কিছুজনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই কথাবার্তাগুলি হয়। যদিও তাদের কেউই নিরাপত্তার ভয়ে এই অডিওর গলা শনাক্ত করতে ইচ্ছুক নয়।
দ্য ওয়্যার জানিয়েছিল, ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছেন বলে দাবি করা কিছু ব্যক্তি জানিয়েছেন, ওই অডিওর কণ্ঠটি আসলে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের। তিনি ওই ব্যক্তিদের উপস্থিতিতেই রেকর্ডিংয়ের সমস্ত কথা বলেছিলেন। পুরো অডিও ক্লিপটিই গুয়াহাটি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) অজয় লাম্বার নেতৃত্বে তদন্ত কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালের ৪ জুন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই কমিশন প্রতিষ্ঠা করে।
মণিপুরের হিংসা নিয়ে এই অডিওর গলা যদি সত্যিই বীরেন সিংয়ের হয় তাহলে প্রমাণ হয়ে যেতে পারে, সরকারের জটিলতার কারণেই এই গৃহযুদ্ধ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে রাজ্যে। ওই রেকর্ডে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শাসক মণিপুরে পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে বলেই মেইতেই এবং কুকিদের মধ্যে মেরুকরণ তীব্রতর হয়েছে। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মে থেকে চলা হিংসায় মৃতের সংখ্যা ২২৬। ৩৯ জন নিখোঁজ। মেইতেই এবং কুকি-জো দুই সম্প্রদায়ের প্রায় ৬০,০০০ মানুষ এখনও বাস্তুচ্যুত। মণিপুরে বিজেপি সরকার, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মণিপুরে রক্তপাত বন্ধ করতে ব্যর্থ। মেইতেই এবং কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যেও পারস্পরিক কোনও শান্তিচুক্তিতেও তারা ব্যর্থ।
আরও পড়ুন- মণিপুরে চুপ থাকা মানে মেরি-রতন থিয়ামদের অপমান করা! মোদির উদ্দেশ্যে মণিপুরের সাংসদ
কী রয়েছে অডিওতে?
দ্য ওয়্যার প্রকাশিত ওই রেকর্ডিংটিতে মুখ্যমন্ত্রী বীরেনকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে উপহাস করতে শোনা যায়। রাজ্যে 'বোমা' ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করছেন তিনি। অমিত শাহের আদেশ অমান্য করার এবং যারা রাজ্য পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে হাজার হাজার প্রাণঘাতী অস্ত্র হাতিয়ে নিয়েছে তাদের রক্ষা করার বিষয়ে কথা বলেছেন বীরেন সিং।
হিন্দি এবং মেইতেইলন ভাষা মিশিয়ে কথা বলার সময় বীরেন সিংকে বলতে শোনা যায়:
“যখন অমিত শাহ এখানে এসেছিলেন, তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন:
‘বীরেন জি!’
'হাঁ স্যার!'
'আরে! তুম বোম মারতা হ্যায়?’ [হাসি]‘বোম মারতা হ্যায়?’ মানে, সেদিন থেকেই তিনি আমাকে বোমা ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দেন। 'মাত মারনা, বোম মাত ইউজ করনা', তিনি ডিজি [ডিজিপি] এবং সকলকে ডেকে [আমাদের] নির্দেশ দিয়েছিলেন।
অমিত শাহ চলে যাওয়ার পর আমি ওদের বলেছিলাম; হোই! চুপকে সে করনা হ্যায়, ওপেন নহি করনা হ্যায়।"
সম্ভবত এখানে বীরেন শাহ অমিত শাহের মণিপুর সফরের সময়ের কথা বলছেন। সেই সময়ে রাজ্যের ডিজিপি ছিলেন পি. ডুঞ্জেল, রাজ্য ক্যাডারের ১৯৮৭ ব্যাচের আইপিএস অফিসার। তিনি কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ। অমিত শাহের সফরের পরপরই ২০২৩ সালের জুন মাসে ডুঞ্জেলকে অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি (হোম) করে দেওয়া হয়। বীরেন সিং সরকারে অধীনে নতুন ডিজিপি হন রাজীব সিং। তখন চাকরি থেকেই অবসর নিয়ে নেন ডুঞ্জেল।
গত বছর অমিত শাহের সফরের পর আদিবাসী উপজাতীয় নেতাদের ফোরামের (ITLF) জারি করা বেশ কয়েকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও কুকি গ্রামে ৫১ মিমি মর্টার বোমা ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। অর্থাৎ অশান্তি বাড়াতে বোমার ব্যবহার হচ্ছিল। ২০২৩ সালের জুনে, অসম রাইফেলস এবং রাজ্য পুলিশের একটি যৌথ দল অনুসন্ধান অভিযানের সময় ইম্ফল পূর্ব জেলা থেকে একটি ৫১ মিমি মর্টার বোমা উদ্ধার করেছিল।
অডিও রেকর্ডিংয়ে বীরেন সিংয়ের যে কণ্ঠস্বর শোনা গেছে, তাতে তিনি নিজেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের নেতা হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, যে নেতা কুকিদের উপর 'বোমা মারতেও' আপত্তিও করবে না। বীরেন বলছেন,
"...কুকিরা আমাকে গালি দেবে, কুকথা বলবে...কেন বলবে না...? আমি অনেক ধ্বংস করেছি… বাজেয়াপ্ত করেছি। তাহলে আমাকে গালি দেবে না কেন? কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে... ওরা কি দেখতে পাচ্ছে না আমি কীভাবে বিষয়টা দেখছি? আমার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
কুকিদের হতাহতের সংখ্যা একটু বেশি। প্রায় ৩০০ কুকি মারা গেছে। শুরুতে মায়ানমার থেকে লুঙ্গি পরারা এসেছিল, তারা এখনও আছে কিন্তু ভারতীয় সেনা প্রচুর সংখ্যায় আসার পর তাদের অনেকেই পিছু হটে। তখন আমি খুব হতাশ ছিলাম। আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম যে, যে মেইতেইদের রাজার আশ্রয়ে রাখা হয়েছিল - তারা উপত্যকায় নেমে আক্রমণ শুরু করেছিল। আমি গভীরভাবে প্রভাবিত হই, এটা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে...
আমার এই কথা বলা উচিত নয় কিন্তু দেবতারা সাক্ষী থাকুক, আমি যদি এই আসনে না থাকতাম, আমি শপথ করে বলছি, আমি যদি এই আসনে না থাকতাম, আমি যদি মুখ্যমন্ত্রী না হতাম, আমি বোমা মারতাম। আমি খুব স্পষ্ট করে বলছি, বোমা মারতাম!”
এখন প্রশ্ন উঠছে, যদি ওই অডিও ক্লিপের গলা বীরেন সিংয়ের হয়, তাহলে তিনি কি গত বছর সত্যিই রাজ্য পুলিশ কমান্ডোদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অমিত শাহের নির্দেশ অমান্য করে কুকি এলাকায় বোমা মারার? সত্যিই কি বীরেন সিং বলছেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী না হলে কুকিদের উপর বোমা ছুঁড়তেন? রেকর্ডিংটি মেইতেই এবং কুকিদের মধ্যে জাতিগত হিংসা নিরাময়ে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বীরেন সিংয়ের ভূমিকা সম্পর্কেই একটি মূল প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। হিংসা বিপর্যস্ত রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কি বীরেন সিং নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছেন আদৌ? নাকি তিনি প্রমাণপত্রগুলিও পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন?