মোদি-মন্ত্রিসভার সিলমোহর, ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করতে কেন এত মরিয়া বিজেপি সরকার?

One Nation One Election: বুধবার সেই 'ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন' পদ্ধতি কার্যকরের পথেই আরও এক ধাপ অগ্রসর হল কেন্দ্র সরকার।

'এক দেশ এক নির্বাচন'। দীর্ঘদিন ধরেই দেশে সেই নিয়ম চালু করতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি। একদিন আগেই এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। জানিয়েছিলেন, শীঘ্রই 'এক দেশ, এক ভোট' প্রক্রিয়া লাগু হতে চলেছে দেশে। তার পরেই সেই প্রক্রিয়া চালু করা নিয়ে সবুজ সঙ্কেত দিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভা। সব ঠিক থাকলে আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনেই নাকি সংসদে পেশ হতে চলেছে এই সংক্রান্ত বিল।

কার্যত বলা যেতে পারে বুধবার সেই 'ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন' পদ্ধতি কার্যকরের পথেই আরও এক ধাপ অগ্রসর হল কেন্দ্র সরকার। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর পৌরহিত্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়। আর সেই বৈঠকেই 'এক দেশ, এক নির্বাচন'-র রিপোর্টে অনুমোদন পড়ে গিয়েছে। যে বিষয়টি নিজেদের তৃতীয় দফায় কার্যকর করতে মরিয়া মোদি সরকার। বুসূত্রের খবর, 'এক দেশ, এক নির্বাচন'-র আওতায় পুরো দেশে একইসঙ্গে লোকসভা নির্বাচন এবং প্রতিটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন করার সুপারিশ করা হয়েছে। আর সেই নির্বাচনের ১০০ দিনের মধ্যে পুরসভা এবং পঞ্চায়েতের ভোট করার সুপারিশ করা হয়েছে রিপোর্টে। যতদূর জানা যাচ্ছে, বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাশ হয়ে গিয়েছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশ। এর পরের ধাপ স্বাভাবিক ভাবেই সংসদে এই সংক্রান্ত বিল পেশ।

আরও পড়ুন: প্রশ্ন তুলছে সুরাট-ইন্দোর, এক দেশ এক ভোট এলে ভোটাধিকার থাকবে আদৌ?

২০২৩ সালেই 'এক দেশ এক ভোট' কার্যকরের দিশা-নির্দেশ খুঁজতে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটি গড়েছিল মোদি সরকার। লোকসভা ভোটের আগেও বারবার এই নীতি কার্যকর করা নিয়ে শোরগোল তুলেছিল বিজেপি। যার প্রবল বিরোধিতা আসে বিরোধীদলগুলির তরফে। লোকসভা ভোটের আগে গত ১৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে গিয়ে একসঙ্গে লোকসভা এবং সব ক’টি বিধানসভার নির্বাচন করানোর সুপারিশ করে আট খণ্ডে বিভক্ত ১৮ হাজার পাতার রিপোর্টটি জমা দিয়েছিল কোবিন্দ কমিটি। সেখানে হাজির ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ কমিটির অন্য সদস্যেরাও। এর পরই এই পদ্ধতি লাগু করার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় সরকার। গত মাসে লালকেল্লায় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নিয়ে সওয়াল করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি যুক্তি দেন, ঘন ঘন নির্বাচনে দেশের উন্নয়নমূলক কাজে বাধা পড়ে। প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, গোটা দেশ এই প্রক্রিয়াকে সমর্থনও জানাচ্ছে। সব রাজনৈতিক দলগুলিকে এই বিষয়ে সমর্থন করার আহ্বানও জানান তিনি। মোদির সেই বার্তার পর জল্পনা তৈরি হয়েছিল এনডিএ সরকারের চলতি মেয়াদেই কার্যকর হবে 'এক দেশ এক নির্বাচন' রীতি।

২০১৪ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই 'এক দেশ, এক নির্বাচন'-র বিষয়টি  নিয়ে কথা বলে আসছেন মোদি। সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ সংক্রান্ত মামলাতেও সুপ্রিম কোর্টে মোদি সরকার ধাপে ধাপে উপত্যকার পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভার ভোটের আয়োজনের কথা জানায়। সরকারের ‘সেঞ্চুরি ডে’তে সে জল্পনায় সিলমোহর দেন খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এবার সেই প্রক্রিয়ায় সবুজ সংকেত দিল মোদির মন্ত্রিসভা। এ বিষয়ে সরকার পক্ষের দাবি, এই ব্যবস্থা চালু হলে ভোট প্রক্রিয়ার জন্য যে বিপুল অঙ্কের খরচ হয়ে থাকে, তা অনেকটাই কমে যাবে। বিশেষ সূত্রের খবর, 'এনডিএ সরকারের বর্তমান কার্যকালেই এক দেশ, এক নির্বাচন চালু করা হবে।'

তবে এই 'এক দেশ এক ভোট' প্রক্রিয়া নিয়ে থাকছে বেশ কিছু প্রশ্নও। তা ছাড়া, ‘এক ভোট’ ব্যবস্থা চালুর পরে কেন্দ্রে বা কোনও রাজ্যে পাঁচ বছরের আগেই নির্বাচিত সরকার পড়ে গেলে কী হবে,তার এখনও দিকনির্দেশ মেলেনি। যদিও লোকসভা ভোটের সঙ্গেই সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট সেরে ফেলার পক্ষে মোদি সরকারের যুক্তি হল, এতে নির্বাচনের খরচ কমবে। একটি ভোটার তালিকাতেই দু’টি নির্বাচন হওয়ায় সরকারি কর্মীদের তালিকা তৈরির কাজের চাপ কমবে। ভোটের আদর্শ আচরণ বিধির জন্য বার বার সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ থমকে থাকবে না। নীতি আয়োগ, আইন কমিশন, নির্বাচন কমিশনও এই ভাবনাকে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছে বলে কেন্দ্রের যুক্তি।

আরও পড়ুন: বিজেপি আর সংঘ ‘এক দেশ এক নির্বাচন’-এর নামে আসলে কী করতে চাইছে?

যদিও এই বিজেপির আনা এই 'এক দেশ এক ভোট' পদ্ধতির গোড়া থেকেই সমালোচনা করেছে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম-সহ সব কটি দল। তাদের মতে, এই নীতি নিয়ে মোদি সরকার ঘুরপথে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ধাঁচের ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক ভাবনার পরিপন্থী বলেও বিরোধী নেতৃত্বের অভিযোগ। বিশেষত বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির আশঙ্কা, ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকর হলে লোকসভার ‘ঢেউয়ে’ বিধানসভাগুলি ‘ভেসে যাবে’। ফলে মোদির এই সংক্রান্ত বিল সংসদে পেশ করা হলেও তা পাশ করাতে যে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে সরকারকে, তা একরকম প্রত্যাশিত।

এদিকে অন্যবারের তুলনায় এবার বিরোধী দল বেশ মজবুত। প্রায় এক দশক পরে সরকারের বিরোধিতায় রয়েছে একজন বিরোধী নেতা। তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম সংসদ অধিবেশনেই একাধিক বিষয় নিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে বিজেপিকে। বারবার প্রবল এবং তীব্র বিরোধিতায় বিদ্ধ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ দল বিজেপি। এই 'এক দেশ এক নির্বাচন' পদ্ধতি পাশ হওয়া আটকাতে যে জানপ্রাণ লড়িয়ে দেবে বিরোধী দলগুলি, তা-ও প্রত্যাশিত। কিন্তু এর আগেও দেখা গিয়েছে বিরোধী দলের সাংসদদের গণসাসপেনশনে পাঠিয়ে সহজেই বিভিন্ন বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে বিজেপি সরকার। এবারেও কি বিজেপির হাতিয়ার হতে চলেছে তেমনই কোনও কৌশল? রয়েছে সেই প্রশ্নও

 

More Articles