দ্রৌপদী মুর্মুকে সামনে রেখেই চলছে ইতিহাস পালটে দেওয়ার খেলা
পরপর রামনাথ কোবিন্দ এবং দ্রৌপদী মুর্মুর বাছাই মানে আসলে সবকা সাথ সব কা বিকাশ নীতির বাস্তবায়ন- এমন বার্তাই দিতে চাইছে বিজেপি। এমনকী দ্রৌপদী মুর্মু সেই কথা বলেও ফেলেছেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বিজেপি তাদের এই পদক্ষেপটিকে ডি...
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্রৌপদী মুর্মুর নাম মনোনয়ন করে বিজেপি আরও একবার বুঝিয়ে দিল অঙ্ক কষে পা ফেলায় এদেশে তাদের জুড়ি মেলা ভার। কুড়ি জনের মধ্য থেকে বাছা হয়েছে দ্রৌপদী মুর্মুকে। তিনি রাষ্ট্রপতি হলে দেশ প্রথম আদিবাসী সমাজের এক মহিলা প্রতিনিধিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পাবে। হাওয়া বলছে, সেই সম্ভাবনাই বেশি। দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্রৌপদী মুর্মুর নাম বাছাই, শুধুই একটি যোগ্য মুখকেই বেছে নেওয়া নয়, এই ঘটনাকে দেখতে হবে সংঘের রাজনৈতিক অভিজ্ঞানের আরও এক সাফল্য হিসেবে। ২০২৪ লোকসভা ভোটের প্রস্তুতিপর্বের রামতাস এই সিদ্ধান্ত।
ভারতে রাষ্ট্রপতি পদটি আলংকারিক। তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ, পদচ্যুতি, সামরিক ঘোষণা, ফাঁসি রদে তাঁর ভূমিকা থাকে। এই পদে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের অগ্রাধিকারই লক্ষ করা গিয়েছে স্বাধীনোত্তর ভারতে। মাত্র দু'জন দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত রাষ্ট্রপতি পেয়েছি আমরা। ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রপতির পদ পেয়েছিলেন কে আর নারায়ণন। বিরোধীরা তাঁকে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হতে বললেও তিনি সে পথে হাঁটেননি। মোদি সরকারের তরফে রামনাথ কোবিন্দকে মনোনীত করা হয় রাষ্ট্রপতির পদে। এই মনোনয়নেই দ্বিতীয়বার কোনও দলিত রাষ্ট্রপতি পায় আমাদের দেশ। অটল জমানায় এনডিএ আরও একবার রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের সুযোগ পেয়েছিল। সেবার তারা বেছে নিয়েছিল এপিজে আবদুল কালামকে। আজকের সরকার পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আকাশপাতাল তফাৎ সেদিনের। পরপর রামনাথ কোবিন্দ এবং দ্রৌপদী মুর্মুর বাছাই মানে আসলে সবকা সাথ সব কা বিকাশ নীতির বাস্তবায়ন- এমন বার্তাই দিতে চাইছে বিজেপি। এমনকী দ্রৌপদী মুর্মু সেই কথা বলেও ফেলেছেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বিজেপি তাদের এই পদক্ষেপটিকে ডিভিডেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে ভবিষ্যতে। নেতারা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন দলিত, আদিবাসী জনগোষ্ঠী থেকে প্রতিনিধি তুলে আনার কাজে তাদের কোনও বিকল্প ছিল না। কিন্তু এই পদক্ষেপকে যদি প্রকারান্তরে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ভোট চাওয়ার পরিসর বাড়ানোর কৌশল হিসেবেই দেখি, ভুল হবে কি?
প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে তথাকথিত নিম্নবর্ণর অন্তর্ভুক্তিকরণে বিজেপি যে যত্নশীল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তথাকথিত নিম্নবর্গের থেকেই উঠে এসেছেন। গত শতকের আটের দশকের শেষ থেকেই বিজেপি দলে নিম্নবর্ণের স্থান বাড়াতে শুরু করে। আরএসএস নেতা কে এন গোবিন্দাচার্যর নিদান এই দৃষ্টিভঙ্গির জমি তৈরি করেছিল। ক্রমে বিজেপিতে জায়গা পান কল্যাণ সিং, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার, সুশীল মোদি, নরেন্দ্র মোদিরা। নরেন্দ্র মোদি নিজে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই প্রশাসনে উচ্চবর্ণের গুরুত্ব কমাতে শুরু করেন। কেশুভাই প্যাটেল, সুরেশ মেহতা, এমনকী তাঁর অতি-ঘনিষ্ঠ বলে রাজনৈতিক মহলে পরিচিত হরেন পান্ডিয়াও বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছেন মোদির চাণক্যনীতির দৌলতে। ২০১৪ সালে মোদী এক জনসভা থেকেই বলেন, নতুন বিজেপি উচ্চবর্ণের দল নয়। এই সময় থেকে মুরলীমনোহর যোশী বা লালকৃষ্ণ আদবানিদের সঙ্গে দূরত্ব রচনা করতেও দেখা যায় তাঁকে। দল পরিচালনা, প্রশাসনিক পদে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনের মতো ক্ষেত্রগুলি তো বটেই, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও সেই সংঘ-ভাবনারই প্রতিফলন আমরা দেখছি। অর্থাৎ, রাষ্ট্রপতি মনোনয়নে আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তিকরণই নয়, সংঘের আদি আদর্শের বাস্তবায়ন, অর্থাৎ হিন্দুত্বের বলয় সম্প্রসারণ হিসেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। একজন 'হিন্দুত্ব'-ঘেঁষা আদিবাসী এনডিএ দ্বারা মনোনীত হয়ে এই পদে এলে, ভবিষ্যতে ভোট চেয়ে কাকুতিমিনতি করি বা না করি, এমনিতেই লক্ষ আদিবাসীর মন হিন্দুত্বে সমর্পিত হবে, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবে বিজেপি। কিন্তু প্রশ্ন হল, একজন দলিতের অন্তর্ভুক্তিকরণ বা একজন আদিবাসীর অন্তর্ভুক্তিকরণের দৃষ্টান্ত শত শত অন্তর্ভুক্তিকরণের পথ প্রস্তুত করে ঠিকই, আদিবাসী বা দলিতের দৈনিক অবমাননা কমাতে সাহায্য করে কি? তার আদিবাসী বা দলিত সত্তাটির প্রতি যথাযথ সম্মান এতে প্রদর্শিত হয় কি? উচ্চবর্ণের ঘৃণা তাতে প্রশমিত হয় কি? তাছাড়া বিকাশের অর্থ কি হিন্দুত্বের খাতায় নাম লেখানো? কেউ যদি নিজেকে অন্তর্ভুক্ত না করে বিকশিত হতে চায়, সুযোগ আছে?
আরও পড়ুন: জ্ঞানবাপী আসলে ব্যর্থতা লুকনোর গোদি-মিডিয়া পালা
'অন্তর্ভুক্তিকরণ' কথাটিতে বারবার জোর দিচ্ছি কেন? কারণ মনোনীত হওয়ার পরেই দ্রৌপদী মুর্মু যা করলেন, চলে গেলেন শিব মন্দিরে ঝাঁটা হাতে মেঝে পরিষ্কার করতে। ভারত জানল, রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের পাঠ যিনি পড়েছেন, তিনি জানেন, রাষ্ট্রপতিকে হতে হবে নিরপেক্ষ, সমদৃষ্টিসম্পন্ন, তাঁর ব্যক্তিগত ঝোঁক যাই থাকুক না কেন, তাকে আলাদা রেখে তিনি জনসমক্ষে সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রকল্পটিই তুলে ধরবেন, নিজেকে কোনও একটি পক্ষ হিসেবে চেনানোর চেষ্টা করবেন না। প্রথম দলিত রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন তাঁর কাজের মেয়াদে কখনও কোনও ধর্মস্থানে যাননি। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গুজরাত দাঙ্গার বিরোধিতা করেছিলেন। ফলে এই মনোনয়নে হিন্দুত্বের ছাতার বেরটা বড় করার প্রয়াস চোখ এড়াচ্ছে না। বরং মনে পড়ে যাচ্ছে, পদ্মশ্রী-প্রাপক কমলি সোরেনের কথা, যিনি বহু বছর ধরে আদিবাসীদের হিন্দুত্বদানের কাজ করে এসেছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর জনজাতি সংগঠন ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’-এর সক্রিয় কর্মী কমলি পুরস্কৃত হয়েছেন সমাজসেবার জন্য। একজন আদিবাসী বা দলিতকে মর্যাদা দেওয়া মানে কি তাকে আরও একবার ধর্মান্তরিত করা? এতে কি একজন আদিবাসী বা দলিতের প্রতি ন্যায়বিচার আদৌ সুনিশ্চিত হয়, উচ্চবর্ণ লালিত ছুঁৎমার্গ কি আদৌ চলে যায়? বিরসা মুণ্ডা বা সিধু-কানুদের পরিচয় কি হিন্দুত্বে, না কি হিন্দুত্বের বিরুদ্ধাচার করে আদিবাসীদের স্বতন্ত্র স্বর তৈরি করায়!
হিন্দু কে? এই প্রশ্ন যদি কেউ করেন, তাহলে ফিরে যেতে হবে ব্রিটিশের হাতে তৈরি ইতিহাসে। ব্রিটিশ আদমশুমারির স্বার্থে তৈরি হিন্দুত্বের ধারণাটি বেশ গোলমেলে এবং অসম্পূর্ণ। ১৮৭২ সালে প্রথম জনগণনার সময় হিন্দু, বৌদ্ধ, পারসিক, খ্রিস্টধর্মীদের আলাদা করার একটা চেষ্টা চোখে পড়ে। এই সময় একদলকে অ্যানিমিস্ট বা প্রকৃতিপূজারি বলে আলাদা বর্গভুক্ত করা হয়েছিল। অন্যদিকে হিন্দু ছাতার তলায় এসেছিলেন বৈষ্ণব এবং শৈবরা। ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে যারা বেদ অস্বীকার করে, ব্রাক্ষণ কর্তৃত্বে সমর্পিত নয়, গোভক্ষণ করে বা গরুকে পূজ্য বলে মানে না, তাদের হিন্দু বলে স্বীকার করা হয়নি। এর প্রায় এক শতক পরে একবিংশ শতকের প্রথম দশকের গণনায় দেখা গেল, প্রায় ১৭০০ এমন গোষ্ঠী রয়েছে, যারা সরাসরি কোনও মূল ধর্মে সম্পৃক্ত নয়, তাদের অন্যান্য গোষ্ঠীর মর্যাদাই দেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালে এই অন্যান্য ধর্মের কলামটা জনগণনা থেকে তুলে দেওয়া হলে আদিবাসীরা তার প্রতিবাদ করেছে দেশজুড়ে। তারা নিজেদের সনাতন হিন্দুয়ানির অংশ করতে চায়নি। চেয়েছিল সারনা ধর্মকে পৃথক ক্যাটাগরি হিসেবে রাখা হোক আদমশুমারিতে। তখন আবার উল্টে সংঘ-ঘনিষ্ঠরা বলতে চেয়েছিল, আদিবাসীরা আদতে হিন্দুই। ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্রৌপদী মুর্মুর মনোনয়ন এই গাজোয়ারিতেই শিলমোহর।
এই মুহূর্তে খুব স্পষ্টভাবে বলা জরুরি, ভারতে বিজেপি যে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের ধারণাকে চালান করতে চায়, সেই ধারণা ভারতের বিবিধের সহাবস্থানের মূল ধারণার পরিপন্থী। প্রতিটি জনজাতিরই নিজস্ব ইতিহাস আছে, অবদমিতেরও নিজের ভাষা আছে, নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেকথা সে বলবেই, যেভাবেই হোক। রাষ্ট্রপতির নাম বাছাইয়ে যে কৌশল বিজেপি নিল, তা সেই ইতিহাসকে বদলে দিতে পারবে না।