১২ ঘণ্টা উপোস করলে ঝড়ের গতিতে কাজ করবে মস্তিষ্ক! কী বলছে গবেষণা?

ইন্টারমেটেন্ট ফাস্টিং ডায়েট কিন্তু সবার জন্য নয়। আপনি যদি গ্যাস, অম্বল কিংবা আলসারের ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন, তবে আপনার এই ডায়েট একেবারেই এড়িয়ে চলা উচিত।

বর্তমানে কর্মব্যস্ততার যুগে মানুষের হাতে বাড়ির তৈরি খাবার অফিসে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় থাকে না বললেই চলে, আর এই ক্রমাগত বাইরের তেল-ঝাল-মশলাযুক্ত অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে দ্রুত গতিতে বেড়ে চলে ওজন। যাঁরা ওজন কমানোর চটজলদি উপায় খুঁজতে নেটমাধ্যমের বিভিন্ন আর্টিকল কিংবা ইউটিউব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে থাকেন, তাঁরা হয়তো কমবেশি ইন্টারমেটেন্ট ফাস্টিং-এর ব্যাপারে শুনে থাকবেন। এই ডায়েটের প্রয়োগ করে, লকডাউন পরিস্থিতিতে প্রায় ২০ কিলো ওজন কমিয়ে কিছুদিন আগেই নেটমাধ্যমে সাড়া ফেলেছিলেন একজন অতি-চর্চিত কমেডিয়ান, ভারতী সিং। তিনি আরও জানান, ওজন কমানোর জন্য তাঁকে কোনওরকম এক্সারসাইজের সাহায্য নিতে হয়নি। কিছুদিন আগে অবধি কিটো ডায়েটের মাধ্যমে প্রায় চল্লিশ কিলো ওজন কমিয়ে মিডিয়া-মহলে হইচই সৃষ্টি করেছিলেন সইফ-কন্যা সারা আলি খান। দ্রুত ফলাফল প্রদানের পাশাপাশি আবার কিটো ডায়েটের বেশ কিছু সমস্যা থাকার কারণে ইদানীং সময়ে প্রচুর মানুষ বেছে নিচ্ছেন এই ফাস্টিং ডায়েটকে। তবে অনেকেই আবার দীর্ঘ সময় ধরে অভুক্ত থাকার এই প্রক্রিয়াকে খুব একটা স্বাস্থ্যকর বলে মনে করেন না। নানা মুনির নানা মত যেখানে আছে, সেখানে বরং চলুন, জেনে নেওয়া যাক, বিজ্ঞান কী বলছে এই ডায়েটের বিষয়ে।

'ফাস্টিং' কথার আক্ষরিক অর্থ হল উপোস। ভারতীয় সংস্কৃতিতে উপোসের বিষয়টি কিন্তু বহুদিন ধরেই ছিল। তবে সে উপোস সচসাচর করা হয় কোনও পার্বণের দিনে কিংবা একাদশীতে। ইন্টিমেটেন্ট ফাস্টিং হলো সেই উপোসেরই এক ভিন্নতর রূপ। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় উপোস রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেহের পুষ্টি-চাহিদার অনুপাতে খাওয়া– এই হলো ইন্টারমেটেন্ট ফাস্টিং-এর মূল মন্ত্র। লস এঞ্জেলেসের সিটি অফ হোপের ন্যাশনাল মেডিক্যাল সেন্টারের নিউরোসার্জারি বিভাগের একজন অধ্যাপক, জান্দিয়াল এমডি বলেছেন, মস্তিষ্ক হল একটি ‘হাইব্রিড ভিকেল’। তাঁর মতে, মানব-মস্তিষ্ক সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে, যখন শর্করা এবং ফ্যাটকে ক্রম পর্যায়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

আয়ুর্বেদ কী বলছে?
এই ফাস্টিং ডায়েটের সপক্ষে যুক্তি দিয়েছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রও। আয়ুর্বেদ বলছে, আমরা যা খাই, তা আমাদের শারীরিক পুষ্টি-চাহিদার থেকে পরিমাণে অনেকখানি বেশি। শাস্ত্র অনুসারে, আমাদের প্রতিটি খাবারের মাঝে আট ঘণ্টার ব্যবধান থাকা অত্যন্ত জরুরি, যাতে আমাদের শরীর গৃহীত খাবারগুলি হজম করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। কিন্তু যেহেতু আমরা কেউই আট ঘণ্টার ব্যবধানে খাবার গ্রহণ করি না, সেই কারণেই নাকি স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। এইসব যুক্তির ভিত্তিতেই আয়ুর্বেদও বহুকাল ধরেই উপবাসের কথা বলে এসেছে।

আরও পড়ুন: Indian Rail Pod Hotel| রেল স্টেশনেই এবার শান্তির ঘুম! অভিনব উপহার ভারতীয় রেলের

বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতে
জাপানের একজন কোশ-জীববিজ্ঞানী, ইয়োসিনোরি ওহসুমি, কোষের বার্ধক্যজনিত গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ২০১৬ সালে। সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘ জীবন লাভের ক্ষেত্রে উপোসের ভূমিকা নিয়েই তিনি তাঁর গবেষণাটি করেছিলেন। তাঁর গবেষণার তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পরেই বলতে গেলে, বিশ্বজুড়ে এই ফাস্টিং ডায়েটের বিবর্তন ঘটে।

উপোসের সঙ্গে মস্তিষ্কের কার্যকারিতার সম্পর্ক কী?
উপোস কেবলমাত্র ওজন কমাতে কিংবা হজম-শক্তি তরান্বিত করতেই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে না, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও উপোসের অবদান অনস্বীকার্য। বিজ্ঞান বলছে, একজন মানুষ যখন দিনের বেশিরভাগ সময় ধরে খাবার খায়, তখন মস্তিষ্কের বেশিরভাগ শক্তি সেই খাবার হজম করতেই ক্ষয় হয়ে যায়। এইভাবে এককথায় মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওভাসকুলার মেডিসিন বিভাগের একজন ক্লিনিক্যাল অধ্যাপক এবং বেঞ্জামিন হর্ন নামক একজন পিএইচডি গবেষকের মতে, আমরা যদি ১২ ঘণ্টা না খেয়ে থাকি, তবে শরীর তার দেহের সঞ্চিত খাদ্যের মাধ্যমেই শক্তি জোগানোর চেষ্টা করবে এবং এই কাজটি করার জন্য মস্তিষ্ককে পূর্বের তুলনায় বেশি সক্রিয় হতে হবে। তাই উপোস হলো মস্তিষ্কের কাছে একটা চ্যালেঞ্জস্বরূপ। এই সময় মস্তিষ্ক তার অভিযোজিত স্ট্রেস রেসপন্স পথকে সক্রিয় করে এবং এর ফলে একদিকে আমাদের স্ট্রেস যেমন খানিকটা হ্রাস পায়, সেরকমভাবেই শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, আমরা যখন অভুক্ত অবস্থায় থাকি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক অধিক সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। এই সময়ে মস্তিষ্কে প্রোটিনের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যা নিউরোট্রাফিক ফ্যাক্টর নামে পরিচিত, এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কে নিউরোন উৎপাদনের পরিমাণেরও বৃদ্ধি ঘটে।

যেহেতু উপবাসের সময় বাইরে থেকে অতিরিক্ত কোনও শর্করা বা ফ্যাট-জাতীয় খাবারের জোগান শরীর পায় না তাই বাধ্য হয়েই দেহে সঞ্চিত ফ্যাট প্রদাহের মাধ্যমেই শক্তি উৎপাদিত হয়। এই ফ্যাট প্রদাহের কারণে সৃষ্টি হয় কিটন, যা পক্ষান্তরে দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং মস্তিষ্কের খাদ্যরূপে কাজ করে থাকে। ওয়েবএমডি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিহাইন্ড দ্যা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ নামে এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, এই ফাস্টিং ডায়েট মানবদেহের স্নায়ুতন্ত্রকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এবং স্নায়ুস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। যখন আমরা উপোস করি, তখন শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা এবং TMAO (Trimethylamine N-oxide) নামক একটি যৌগ কমতে থাকে, যার ফলস্বরূপ লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যা হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক। এছাড়াও, এই প্রক্রিয়ার মধ্যমে BDNF (Brain-derived neurotrophic factor) নামক অন্য এক যৌগ দেহে সুষম মাত্রায় অবস্থান করে, যা স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখে।

শুধু এখানেই শেষ নয়, উপোসের সময় মানব কোশগুলি যেহেতু খানিক সময়ের জন্য কাজ থেকে বিরতি পায়, তাই এইসময় কোশগুলি তার আভ্যন্তরীণ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠে এবং মাইট্রোকন্ড্রিয়াও পরিশোধিত হয়। স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং ওজন কমানোর পাশাপাশি এই ফাস্টিং ডায়েট মানবদেহের আর্থ্রাইটিস, স্ট্রেস, মাইগ্রেন এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা সমাধানেও ভূমিকা নিয়ে থাকে।

তবে এই ইন্টারমেটেন্ট ফাস্টিং ডায়েট কিন্তু সবার জন্য নয়। আপনি যদি গ্যাস, অম্বল কিংবা আলসারের ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন, তবে আপনার এই ডায়েট একেবারেই এড়িয়ে চলা উচিত। এছাড়াও যে কোনও ডায়েট পরিকল্পনা করার আগে একবার হলেও একজন পেশাদার ডায়েটেশিয়ানের পরামর্শ নেওয়া অবশ্যিক।

 

More Articles