নির্বাচনী বন্ড: কে কত টাকা দিয়েছে কোন দলকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই জানবে দেশ?

Electoral Bond Supreme Court: দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে, ১২ মার্চ অর্থাৎ আগামিকালের মধ্যে, কারা নির্বাচনী বন্ডে টাকা দিয়েছেন, তা জানাতে হবে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল, নির্বাচনী বন্ড বাতিল করা হলো। এরপর থেকে কোনও ব্যক্তিই আর নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কোনও রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, এই রায় দেওয়ার সময়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত খুব নির্দিষ্ট করে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে নির্দেশ দেয়, এই বছরের মার্চ মাসের ৬ তারিখের মধ্যে দেশের নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে জানাতে হবে, কে বা কোন সংস্থা কত টাকার বন্ড
কিনেছে এবং কোন কোন রাজনৈতিক দল তা পেয়েছে।

এই রায়ের প্রায় ১৫ দিন কেটে যাওয়ার পরে আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পেরনোর দু’দিন আগে এসবিআই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে এই তথ্য জানানোর জন্য আরও সময় চায়। তারা আবেদন করে, এই নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত তথ্য সবার সামনে নিয়ে আসতে ৩০ জুন অবধি তাদের সময় দেওয়া হোক। পরিষ্কার বোঝা যায়, ব্যাঙ্কের উপর সরকারের চাপ আছে এবং সরকার তাদের মাধ্যমেই এই সময়সীমা পেছনোর আর্জি জানিয়েছে, যাতে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে এই তথ্য বাইরে না আসে। এসবিআই, ‘দ্য ব্যাঙ্কার টু এভরি ইন্ডিয়ান’ অর্থাৎ দেশের সমস্ত মানুষের ব্যাঙ্কের সমস্ত লেনদেনের
দায়ভার যাদের হাতে, সেই ব্যাঙ্ক এই সাধারণ তথ্যটুকু প্রকাশ করতে পারছে না, এ বিশ্বাসযোগ্য নয়। যে ব্যাঙ্ক সারাক্ষণ আরও বেশি ডিজিটাল হতে বলে, সমস্ত গ্রাহকের খুঁটিনাটি যাদের মাউসের ডগায়, সেই ব্যাঙ্ক কোনও ব্যক্তি কত নির্বাচনী বন্ড কিনেছে তা বলতে পারছে না? একজন ব্যক্তি এক কোটি বা তার বেশি টাকা নগদ ব্যাঙ্কে এনে নির্বাচনী বন্ড কিনে গেছেন বা বলে গেছেন যে অমুক রাজনৈতিক দলের জন্য এই অনুদান দেওয়া হলো এবং ওই ব্যক্তি যেহেতু তাদের ব্যাঙ্কের গ্রাহক নন, তাই এই তথ্য প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, বা তাদের সমস্ত নথি নষ্ট হয়ে গেছে - এসব ছেঁদো যুক্তি কোনও প্রেক্ষিতেই তো খাটে না। তাহলে তথ্য প্রকাশ করতে সমস্যাটা কোথায়?

আরও পড়ুন-ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক তহবিলে কোটি কোটি টাকা! কত পেল বিজেপি?

যেদিন দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত রায় দেয়, সেদিন সমস্ত রাজনৈতিক দল এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছিল। একমাত্র বিজেপি তাদের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদকে দিয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছিল, এই রায় ভালো করে দেখে, তারপর মন্তব্য করা হবে। দেশের গণতান্ত্রিক সমস্ত ব্যক্তি, সংগঠন সেদিন দু'হাত তুলে বলেছিল, দেরি হলেও এই রায়ের ফলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া আগামী দিনে স্বচ্ছ হবে। বিজেপি ভয় পেয়েছিল সেদিন। তাঁদের আশঙ্কা ছিল এই নাম যদি স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে জনগণের সামনে চলে আসে, তাহলে বিজেপির সঙ্গে বেশ কিছু বড় কর্পোরেটের আঁতাত দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিরোধীরা যে বারবার আদানি-আম্বানি এবং মোদির যোগসাজশের অভিযোগ তুলছে, তা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়ে যাবে। তাহলে বিজেপির দুর্নীতির বিরোধী লড়াই, কিংবা মোদির ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’ স্লোগান মিছে হয়ে যায়! বাংলার বিজেপির নতুন সদস্য অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যা বলছেন যে, তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একমাত্র জাতীয় স্তরের দল বিজেপি, তাও আর বিশ্বাসযোগ্য থাকবে না। বিজেপি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিল, এই তথ্য সামনে এলে, যারা এই নির্বাচনী বন্ডে টাকা দিয়েছে তারা বিনিময়ে কী পেয়েছে তা নিয়েও হইচই শুরু হবে? কী কী আইন সেইসব বড় কর্পোরেটদের জন্য পরিবর্তন করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে চলা কোনও তদন্ত স্থগিত করা হয়েছে কিনা, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, ইডি বা সিবিআইকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে টাকা তোলা হয়েছে তাও স্পষ্ট হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের দৌলতে এবং তথ্য জানার অধিকার আইনে বেশ কিছু সংস্থার কথা জানাও গেছে। শুধু ইডির ভয় দেখিয়ে ৩৩৫ কোটি টাকা নির্বাচনী বন্ডে তোলা হয়েছে সেই খবর যেমন সামনে এসেছে, আবার ১২ কোটি টাকা লাভ করা সংস্থা ৪০ কোটি টাকা দিয়েছে, সেই খবরও পাওয়া গেছে।

তাহলে সরকার এবং স্টেট ব্যাঙ্ক মিলে কি তথ্য গোপন করতে চাইছে? পরোক্ষে তাদের সহায়তা করছে ভারতের নির্বাচন কমিশন? স্টেট ব্যাঙ্ক, সরকার
এবং নির্বাচন কমিশন এদের কারও দায় নেই, ভারতীয় নির্বাচকদের কাছে স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু রাখার। একটি বেসরকারি সংস্থা, অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটসের তরফ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আবার একটি মামলা করা হয়েছে স্টেট ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে। সেই মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আর্জি জানানো হয়েছে, কেন দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার শাস্তি হবে না? প্রাক্তন অর্থ সচিব সুভাষ গর্গ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই তথ্য দিতে স্টেট ব্যাঙ্কের খুব বেশি হলে এক দিন লাগার কথা। যেখানে একজন গ্রাহকের সমস্ত তথ্য না থাকলে স্টেট ব্যাঙ্ক গ্রাহকের অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ করে দেয়, সেখানে এই তথ্য কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? যদিও নির্বাচনী বন্ডের শর্তাবলীতে লেখা আছে, এই তথ্য স্টেট ব্যাঙ্ক বাইরের কোনও ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করতে বাধ্য নয় কিন্তু কোনও আদালত চাইলে তা দিতে তারা বাধ্য। এরপর সর্বোচ্চ আদালত যদি স্টেট ব্যাঙ্কের এই সময় বাড়ানোর আর্জিকে মান্যতা দিয়ে ৩০ জুন অবধি সময়সীমা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে বলতে হবে, ব্যাঙ্ক, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অশুভ আঁতাতের সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও জড়িত। কিন্তু সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বৃহৎ স্বশাসিত সংস্থা কি নিজেদের কর্দমাক্ত করতে চাইবে?

আরও পড়ুন- ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে সাধারণ জনগণের কিছুই এসে যায় না

বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর কিন্তু পাওয়া জরুরি। কিন্তু কে দেবে উত্তর?

১। যে ব্যাঙ্ক ডিজিটাল হওয়ার লক্ষ্যে প্রতিদিন তার গ্রাহকদের ঠেলে দেয়, যে ব্যাঙ্ক শুধুমাত্র এই কারণে বিভিন্ন গ্রাহকদের হয়রানি করে রোজ, সেই ব্যাঙ্কের কেন এই ধরনের একটি তথ্য জানাতে পাঁচ মাস লাগতে পারে? যে তথ্য একটি মাউসের ক্লিকে ৫ মিনিটে পাওয়া সম্ভব, সেই তথ্য দিতে গড়িমসি কেন?

২। স্টেট ব্যাঙ্ক কেন শেষের দিন আসার আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করল? কাদের কাছে দায়বদ্ধ তারা, কোটি কোটি গ্রাহক না কি সরকারের মাথা? 

৩। যে স্টেট ব্যাঙ্ক ৪৮ কোটি অ্যাকাউন্ট, ৬৬ হাজার এটিএম, ২৩ হাজার ব্রাঞ্চ রোজ সামলায়, তাদের কী করে, মাত্র ২২ হাজার নির্বাচনী বন্ডের তথ্য জানাতে ৫ মাস লাগবে?

৪। তাহলে কি দেশের এক নম্বর ব্যাঙ্ক, বিজেপির অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি এবং মোদির কালো টাকা বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে সন্ত্রস্ত?

৫। একটি রাজনৈতিক দল এবং একটি ব্যাঙ্ক যদি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করতে পারে, তাহলে যে কোনও ব্যক্তিই তো আর আদালতের কোনও নির্দেশ না-ও মানতে পারে।

সামনেই লোকসভা নির্বাচন। যে কোনও নির্বাচকের জানার অধিকার আছে, তিনি যাঁকে ভোট দিচ্ছেন তাঁর পিছনে কোন কর্পোরেটের কোন অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বা আছে, যা লুকনোর চেষ্টা করছে ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক। যে কর্মীরা এই ব্যাঙ্কে কাজ করেন, নিজেদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার জন্য শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন করেন, তাঁরা তো সবাই শাসকদলের সমর্থক নাও হতে পারেন। তারা কেন এই তথ্য বার করার জন্য কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছে না? দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে, ১২ মার্চ অর্থাৎ আগামিকালের মধ্যে, কারা নির্বাচনী বন্ডে টাকা দিয়েছেন, তা জানাতে হবে। আগামী ১৫ তারিখের মধ্যে নির্বাচন কমিশন কারা সেই টাকা পেয়েছেন, সেই তথ্য প্রকাশ করবেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্টেট ব্যাঙ্ক এই তথ্য না দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা রুজু করা হবে। তবে কারা এই নির্বাচনী বন্ডে টাকা পেয়েছে, তা এখনই না মেলালেও চলবে। তাহলে কীভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হবে, কোন রাজনৈতিক দল কোন কর্পোরেটের থেকে টাকা পেয়ে কোন আইন বদল করেছে? তবে আজকের রায়ের পরে নির্বাচনে যে দল দাঁড়াবে তাঁদের দায়বদ্ধতা তৈরি হবে হয়তো মানুষের কাছে‌‌।

More Articles