পিঠ চাপড়ে জাত চেনালেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো, সেরার কৃতিত্ব এমবাপেরই!
Mbappe : ম্যাক্রোঁ পিঠ চাপড়ে বুঝিয়ে দেন তাঁর কৃতিত্ব, যেন দেশের সবথেকে বিশ্বস্ত সৈনিক এমবাপেই।
একেই বলে ওস্তাদের মার শেষ রাতে। জয়ের মুকুটই সব নয়, বরং জয়ের অমন উচ্ছ্বাসের পাশেই নিজেকে স্বমহিমায় ধরে রাখার মতো দুরূহ কাজটা করতে পারে কজন? এমবাপে করে দেখিয়েছেন। গত রাতে যখন বিজয় উল্লাসে ঝলমল করছে নীল সাদা শিবির, তখন মাঠের এক কোণে আহত বাঘের মতো দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ক্যামেরা বোধ হয় একটি বার ভুল করেই সেই দিকে ফিরেছিল। বারেবারে চোখ মুছছেন এমবাপে। অথচ ইতিমধ্যেই ঝুলি ভর্তি রেকর্ড তাঁর। এমনকী কাঙ্ক্ষিত ওই সোনার বুটখানাও দখল করেছেন অচিরেই। কিন্তু পাহাড় প্রমাণ দলের যে ভার নিয়ে কাতারে নোঙর ফেলেছিলেন তিনি তার শেষটুকু আলোময় করতে পারেনি ফাইনালের কাতার ময়দানে। স্বপ্নভঙ্গের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত জয়ের হিসেব কষতেও ভুলে গিয়েছিলেন টিমম্যান এমবাপে।
ইতিহাস লিখেও ট্র্যাজিক নায়ক এমবাপে! নিজের প্রথম বিশ্বকাপে জয়, দ্বিতীয় বিশ্বকাপে সোনার বুট, বিগত ৫৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাট্রিক অথবা একাধিক বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করা পঞ্চম ফুটবলার, রেকর্ডের পর রেকর্ড তাঁর ঝুলিতে। আর এ সবই মাত্র ২৪ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। তাই একা মেসি নন, যোগ্য সম্মানের দাবিদার এমবাপেও। আসলে মহাকাব্যিক পরিসরে সমস্ত মুখ্য চরিত্রই মহিমান্বিত।আর বিশ্বকাপ তো মহাকাব্যের থেকে কম কিছুই নয়।স্থানবিশেষে প্রতিনায়কের গৌরবের সামনে নায়ককেও ম্লান মনে হয়। তাই ট্রাজেডি গ্রাস করলেও প্রতিনায়ক হয়ে থেকে গেলেন এমবাপে।
আরও পড়ুন - ‘কালো’দের ফ্রান্স! সাদা চামড়ার দেশে অন্য এক লড়াই জিতলেন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলাররা
একদিকে মেসির মতো তারকা ফুটবলারের শেষ জয়ের গগনচুম্বী আশা, অন্যদিকে তরুণ ফুটবলার এমবাপের জানকবুল লড়াই। মেসি কিন্তু সঙ্গে পেয়েছিলেন তাঁর পুরো নীল সাদা দলকে। প্রত্যেকে জান লড়িয়ে দিয়েছে মেসির জন্য। আলভারেজ, ডি মারিয়া থেকে শুরু করে এমি মার্টিনেজ প্রত্যেককে পাশে পেয়েছেন ফাইনালের ময়দানে। অন্যদিকে এমবাপে খেললেন পুরো একা।
প্রথম আশি মিনিট ০-২ গোলে পিছিয়ে ফ্রান্স। আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মধ্যে ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে জয়োল্লাস। সকলেই ধরে নিয়েছেন আর খেলায় ফিরতে পারবে না ফ্রান্স। এদিন শুরু থেকেই অবশ্য মাঠে ঝিমিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল ফ্রান্সকে। তাই হয়তো খানিক রাশ আলগা করেছিলেন মেসিরাও। কিন্তু তখনও বাকি আসল ক্লাইম্যাক্স। কেউ বুঝতেই পারেনি হাফ টাইমের বিরতির মধ্যেই অন্য একটা ছক কষে রেখেছিলেন এমবাপে। মাত্র দেড় মিনিটের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড করে দি আর্জেন্টিনাকে। প্রথম গোলটি আসে পেনাল্টি থেকে। সেই ঘা সারতে না সারতেই আবার এমবাপে ঝড়। একার দক্ষতায় ঘুরিয়ে দিলে চাকা। খেলায় ফিরল ফ্রান্স। এরপর একস্ট্রা টাইমে খেলা গড়ালে, সেখানেও এক চুল জায়গা ছাড়েননি তিনি। মেসি করা গোলটি সঙ্গে সঙ্গে হিসেব মতো পরিশোধ করেন। নিজের দিক থেকে ঠিক যতটুকু দেওয়ার ছিল সবটুকু দিয়ে ফেলেন, অথচ হারতে হল। না মেসি ম্যাজিকের সামনে মোটেই পরাস্ত হননি এমবাপে, হয়েছেন আর্জেন্টিনার টিম গেমের কাছে।নাহলে অন্তিম পেনাল্টিতে নিজের ভাগের গোলটা নিশ্চিত করেও দলের সতীর্থদের খেলায় ফস্কে যেত না দ্বিতীয় বিশ্বকাপের শিরোপাটিও।
দল হারে পেনাল্টি শ্যুট-আউটে, কিন্তু সোনার বুট হয় তাঁরই। অথচ ম্যাচ শেষে একটা অমোঘ অন্ধকার ঘনিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে ঘিরে। সোনার বুটের ঝলকানিও তাতে আলো ছড়াতে পারেনি। কী যেন একটা চলছিল তাঁর মধ্যে! একটা না মেলা অঙ্কের হিসেব কষছিলেন অনবরত। আর ঠিক কতটা নিজেকে উজাড় করে দিলে বিশ্বকাপের ট্রফিটা নিজের কাছেই রেখে দিতে পারতেন?
আরও পড়ুন - এমবাপে হারলেন তবু বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে যে বিরল কৃতিত্ব ছিনিয়ে নিলেন
হিসেব মেলেনি ঠিকই কিন্তু তাঁকে ঘিরে ফরাসি উন্মাদনা বুঝিয়ে দিয়েছে আগামীর নায়ককে তাঁরা পেয়ে গিয়েছেন অবশ্যম্ভাবী। শুধু তাই নয়, এমবাপেকে সান্ত্বনা দিতে আসেন খোদ ফরাসি প্রেসিডেন্ট। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে সেই ভিডিও। মাত্র ২৪ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এমন কৃতিত্ব যে অবিস্মরণীয় তা প্রেসিডেন্ট বুঝিয়ে দেন তাঁর বক্তব্যে। সোনার বুট হাতে নিয়ে যখন পুরস্কার বিতরণী চলছে তখনও ম্যাক্রোঁ আলিঙ্গন করে জড়িয়ে ধরেন ফরাসি তরুণকে। পিঠ চাপড়ে বুঝিয়ে দেন তাঁর কৃতিত্ব, যেন দেশের সবথেকে বিশ্বস্ত সৈনিক এমবাপেই।
বিশ্বকাপের ফাইনালে এর আগের হ্যাট্রিকটি করেন জিওফ হার্স্ট, ১৯৬৬ সালে। তারপর থেকে কেউই দাঁত ফোটাতে পারেনি সেই রেকর্ডে। অথচ মাত্র ২৩ বছরের এক তরুণ ফুটবলার যেন অচিরেই মিলিয়ে দিলেন সব হিসেব। অঙ্ক পরীক্ষার খাতায় সবচাইতে সহজ উপপাদ্য কি এটাই ছিল এমবাপের?